অশান্ত পৃথিবী, সমসাময়িক বাস্তবতা

অজয় দাশগুপ্ত
| আপডেট : ১০ মে ২০২৪, ১১:৫৮ | প্রকাশিত : ১০ মে ২০২৪, ১১:৪১

জীবন এখন কোথাও নিরাপদ না। আমরা আমাদের দেশের কথা বলি, ভাবি। কিন্তু শুধু কি বাংলাদেশ? আজ যদি আপনি বিশ্বের দিকে চোখ রাখেন দেখবেন উন্নত রাষ্ট্রের নামে পরিচিত দেশগুলোর সমাজ ও সামাজিক পরিবেশ ভয়াবহ রকমের উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো। আমেরিকাকে দুনিয়ার সেরা একটি দেশ বলেই আমরা জানি। কিন্তু কেন সেরা? সে বিচার এখন দূরঅস্ত। চীন, রাশিয়া, ভারত যে যতই এগিয়ে যাক বা পিছাতে থাক সার্বিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রই সবদিক থেকে শীর্ষে রয়েছে। এই শীর্ষে থাকা যেন তার অধিকার হয়ে গেছে। নানা বিচারে এখনো তাদের সেরা জায়গাটা রয়েছে; এটাই যেন মানতে হবে। কিন্তু আপনি কি চীন, রাশিয়া বা ভারতের স্কুলে এমন কিলিং মিশন হতে দেখেন? ছোটো বাচ্চাদের, শিশুদের এভাবে গুলি করে মারার রেকর্ডে আমেরিকা সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। এখানে আসলে সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারও নয়; দলবদ্ধভাবে এমন নৃশংস শিশুহত্যা বিশে^র আর কোনো দেশেই আমরা ঘটতে দেখি না। কয়েকদিন পরপরই এমন এক-একটা নিষ্ঠুর, নির্দয় ও অমানবিক একদল শিশুহত্যার ঘটনা সংবাদমাধ্যমে দেখতে হয় আমাদের; এসব নৃশংস ঘটনায় বুকের তাজা রক্ত হিম হয়ে এলেও এই অমানবিক ও অতর্কিত গুলি করে ভবিষ্যৎ প্রজম্নের শিশুদের হত্যার ঘটনাগুলো কিছুতেই থামছে না ।

মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক জান্তা বাহিনী এবং বিদ্রোহী আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাত চলছে গত কয়েক মাস ধরেই। সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর ক্রমবর্ধমান সংঘাত-সংঘর্ষে এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তিন শতাধিক বিজিপি সদস্য আশ্রয় নিয়েছিলেন বাংলাদেশে। সরকারি একাধিক সীমান্ত চৌকি বিদ্রোহী আরাকান আর্মির দখলে যাওয়ায় সে সময় তাদের পালাতে বাধ্য হতে হয়েছিল। পরে তাদের একটি বড়ো অংশকে ফেরত পাঠানো হলেও দেড়শো’র মতো মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর আশ্রয়ে ছিলেন। গত কয়েকদিনে নতুন অনুপ্রবেশের ফলে সে সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে ২৬০ জনে। প্রতিবেশী মিয়ানমারে কী হচ্ছে আসলে? আগ্রাসী রাখাইনদের রোহিঙ্গাদের নিধন ও বিতাড়নের পর এখন বিদ্রোহীদের সাথে সেনাদের যুদ্ধ চলছে। একটা দেশের ভেতর কী পরিমাণ জুলুম আর যুদ্ধাবস্থা চলমান থাকলে সে দেশের সরকারি সৈন্য পাশর্^বর্তী দেশে পালিয়ে আসে বা আসতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশ তাদের উদারতার কারণেই আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে বারবার। আবার দেখা গেল ফেরতও যাচ্ছে তারা। এইসব বাস্তবতার পরও আমরা মনে করি আমাদের সমাজেই শুধু বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি। বাস্তবতার নিরিখে কিন্তু আসলে তা নয়। এই যে আমাদের শান্তির শহর সিডনি- এতদিন আমরা এখানে এমন কোনো ঘটনার কথা চিন্তাও করিনি। অথচ নয়নাভিরাম বন্ডাই বিচের লাগোয়া শপিংমলে ঘটে গেল ন্যক্কারজনক এক হত্যাকাণ্ড। একটি শিশুও গুলিবিদ্ধ হয়েছে সে ঘটনায়। শেষ পর্যন্ত জানে বাঁচলেও শিশুটির মা মারা গেছেন আততায়ীর ছুরির আঘাতে। জানা যায়- পাকিস্তানি সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে সে এ দেশে এসেছিল একজন শরণার্থী হয়ে। দুঃখজনক যে- কাজের প্রথম দিনেই জীবন হারিয়েছে এই যুবক। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের এই যুবক এখন পাকিস্তানের হিরো।

আসলে দেখা যাচ্ছে কোথাও নির্বিঘ্ন শান্তি নাই। ফিলিস্তিনের গাজায় গত আট মাস ধরে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। শিশু, নারী কেউ বাদ যায়নি। ফিলিস্তিনের গাজা অঞ্চলে গত বছরের ৭ই অক্টোবরের পর থেকে প্রায় আট মাস ধরে চালানো ইসরায়েলি হামলায় সেখানে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে কেবল আগের রেকর্ডই অতিক্রম করে চলেছে। এই সাত মাস ধরে হামলার পর থেকেই গাজায় যেকোনো ধরনের ত্রাণ সহায়তাকে বাধা দিচ্ছে ইসরায়েল। ত্রাণের অভাবে সেখানে গাজার শিশুরা না খেয়ে মারা যাচ্ছে- তবুও সেখানে ত্রাণ যেতে দিচ্ছে না বর্বর ইসলায়েলি সৈনরা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছেÑ গাজার অনাহারকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ইসলায়েল। ইইউর পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল গাজা ভূখণ্ডে সাহায্য প্রবেশের অভাবকে মানবসৃষ্ট বড়ো বিপর্যয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ বিপর্যয় থেকে কীভাবে মুক্তি মিলবে তার কোনো পরিত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে না। এখন ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের মুখোমুখি সারা দুনিয়া। এই লড়াই হবে কি না আর হলে কী হবে সেটা জানলেও চুপ রয়েছে বিশ্ব-মিডিয়া। এই যে চরম বাস্তবতা এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ আজ মোটামুটি একটি ভারসাম্যমূলক শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করছে। কিন্তু আমাদের অশান্তি বা খারাপের উৎসটা আসলে অন্য জায়গায় ।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল যে আদর্শে, যে মূল্যবোধে তার অবনতি সমাজকে পলে-পলে দগ্ধ করছে। আমি বাইরের দেশে (অস্ট্রেলিয়ার সিডনিসহ বিভিন্ন শহরে) দেখছি সমাজের অবনতি আর পাপই মূলত মানুষের প্রধান সমস্যা। মানুষের হাতে টাকা থাকলেই যে মানুষ সম্পূর্ণ নিরাপদ কোনোভাবেই তা কিন্তু নয়। এখানে যে যে দেশ ও যে ঘটনাগুলোর উল্লেখ করেছি তাদের আর্থিক অবস্থা ও জীবনযাপনের সাধারণ মান কিন্তু আমাদের চাইতে ঢের ভালো। রাষ্ট্রীয় কঠোর বিধিবিধানের দ্বারা তাদের সমাজও কিন্তু অনেক বেশি সুসংহত। অথচ তাহলে আজ কেন বারবার একদল অমানুষ অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে? এর মূল কারণ অশান্তি। সমাজসৃষ্ট বিবেচনাহীন মানবিক মূল্যবোধ আর নৈতিকতার চরম অধঃপতন এখন চারপাশেরই প্রবলভাবে দৃশ্যমান। এক সময় যেটাকে আধুনিক মনে করা হতো সে আধুনিকতার নাগপাশই তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ধরেছে। মানুষের জীবনযাপনের একটি অভিশাপের নাম একাকীত্ব। এটাকে অস্বীকার করা যাবে না কোনোভাবেই। এই একা থাকার কারণে যে নৈরাজ্য আর অশান্তি বাসা বাঁধে মানুষের মনে এর কারণেই মন হয়ে ওঠে বিষাক্ত। সেই বিষপান করেই ক্ষেত্রবিশেষে অনেক যুবক আজ মারমুখো ও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে। তারা নিজেরা তো ভালোভাবে বাঁচেই না- উল্টো অন্যদেরও ভালোভাবে বাঁচতে দেয় না।

একসময় আমাদের দেশে আতঙ্কের মূল কারণ ছিল জঙ্গীবাদ আর সন্ত্রাস। আপাতত সেগুলো আর মাথাচাড়া দিতে পারছে না। কিন্তু বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে আমাদের দেশের তারুণ্যকে যেভাবে প্রলুব্ধ ও উত্তেজক করা তোলা হচ্ছে তা নিশ্চিতভাবেই ভবিষ্যতের জন্য খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়। খেয়াল করলে দেখা যাবে- সমাজে আধুনিকতা আর বিশ্বাস এখন পারস্পরিক সাংঘর্ষিক একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিনিয়ত একদল মানুষ কোনো না কোনোভাবে বিচ্ছৃঙ্খল হতে উস্কানি দিচ্ছে। চোখ-মুখ খিঁচিয়ে কেউ কথা বলতে পারলেই কি বুদ্ধিজীবী বনে যাওয়া যায় কোনোভাবে? যা জানা থাকে তাই শুধু বলা সংগত আর যেটা জানা নাই সেখানে নীরব থাকাই কি শ্রেয় নয়? কিন্তু দেখা যায়- যেটা জানা নাই সেটাই কেউ কেউ ডাবল করে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলার চেষ্টা করেন। ভাবখানা এমন যে- তিনি সর্বজান্তা। এই হঠাৎ গজিয়ে ওঠা দিগগজ বক্তারা একটি বিষয়ে এমন মতামত দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত থাকেন যে- তিনি যা বলছেন তার বাইরে আর কিছু কেউ জানে না, আর কারো এ ব্যাপারে মতামত দেওয়ারও কিছু নাই। এখন স্বঘোষিত পণ্ডিত নামের এই মূর্খদের কবলে পড়েছে আমাদের সমাজ। এর পরিণাম যে ভয়াবহ হতে বাধ্য তা আঁচ করতে কোনো দূরদর্শী জ্ঞানের অধিকারী হতে হয় না। সুযোগ পেলে এক সময় এই দানবরূপী স্বগোষিত পণ্ডিতরা (!) কীভাবে যে আমাদের সমাজে আক্রমণ করে বসবে সেটাই ভাববার বিষয়।

বাইরের দেশে যে কারণে এখন অশান্তি আর নৈরাজ্য তার মূল কিন্তু সমাজে অশিক্ষা ও সীমাহীন ভোগবাদিতা। আমাদের এখানকার সমাজে এখন আর শিক্ষা কোনো ব্যাপার না। শিক্ষা যদি ঠিক পথে এগুতে পারতো তাহলে আর যাই হোক মৌলবাদী চিন্তার এমন প্রসার ঘটতো না। মূলত রাজনীতিবিহীন এইসব দেশে উত্তেজনার কারণগুলো হয় একান্তভাবেই সামাজিক। কারণ এই উত্তেজনাকে পাহারা দেওয়ার কোনো অভিভাবক নাই। ভালো হোক মন্দ হোক অভিভাবকরূপে একদল মানুষ এগুলো পাহারা দেবেন এটাই তো রীতি। দেশে হোক বিদেশে হোক সে সহনশীলতার রীতি এখন আর নাই। সর্বত্রই জুটেছে মিডিয়ার একক আধিপত্য। কিন্তু মিডিয়াকে দোষারোপ করার আগে ভাবতে হবে তাদের কাজ হচ্ছে খবর বিক্রি। বিক্রেতা সবসময় চান তার প্রডাক্ট হট কেকের মতো চলুক। ফলে তাদের খবর সংগ্রহের জন্য এবং পরিবেশনের জন্য নেগেটিভ বিষয়ে আগ্রহ বেশী থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আমার ধারণা এখানেও নজরদারীর একটা ব্যাপার আছে। যা নিয়ন্ত্রণ নয় কিন্তু যার একটা নীতিমালা থাকে। সে নীতিমালা থাকলেই কেবল বাক্স্বাধীনতা হয়ে ওঠবে অর্থবহ। তখন কেউ চাইলেও মনগড়া কোনো কথা বলে আমাদের জাতীয় সংগীতের স্রষ্টা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যাপারে নেতিবাচক ও কটূক্তি করতে পারতো না। পারতো না বৈশাখ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে বাজে কথা বলতে। জোর করে আমরা শোভাযাত্রা কতদিন করতে পারবো জানি না। আর তা যদি স্বতস্ফুর্ত হয় তো তাকে কেউ বন্ধও করতে পারবে না- এটা ঠিক। প্রয়োজন স্বচ্ছ আর স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড। অথচ সে জায়গাটায় পদে পদে বাধা। দেখে শুনে মনে হয় আনুকূল্য আর পাহারা ছাড়া আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও মঙ্গল বিষয়টাই আজ অসহায়।

প্রগতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক চিন্তার যথাযথ অভাবের ফলে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে সেটা কি মনে করিয়ে দিচ্ছে না যে- দেশে প্রতিক্রিয়াশীলতার এক নীরব অভ্যুত্থান ঘটে যাচ্ছে? যদি তা হয় তাহলে বাদবাকি সমাজ যে আবারো বিপদে পড়বে বা পড়তে পারে সেটাই তো আমাদের আশঙ্কার বিষয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একা সামাল দিয়ে চলেছেন সবকিছু। তিনি আছেন বলে যেকোনো ধরনের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অন্যায় সীমা লঙ্ঘন করতে পারছে না হয়তো। কিন্তু তিনি একা কতদিক দিয়ে কয়টা বিষয় সামাল দেবেন? এ বিষয়ে সকলের মধ্যে তো সর্বোচ্চ সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের চাওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা সফল রাষ্ট্র নায়ক শেখ হাসিনার আমলে আমরা যেমন এখন বহু উন্নত দেশের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছি, ঠিক তেমনি আগামী দিনগুলোতেও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে চলতে পারবো। আমাদের সামাজিক জীবনের শান্তি ও কল্যাণ সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়বে এটাই কামনা। এখন বিশ্বের ধনী ও অতিমাত্রায় সভ্য দেশ ও সমাজের দিকে তাকালে আমাদের অনেক বিষয়েই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ওঠতে হয়। আতঙ্ক যুদ্ধাবস্থার, আতঙ্ক নির্ভিকভাবে জীবনযাপনের, আতঙ্ক সামাজিক সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার। পৃথিবী হয়ে ওঠুক সকলের জন্যই শান্তি ও সৌহার্দপূর্ণ এক অনাবিল স্বস্তিদায়ক আবাসভূমি। বিশ্বজুড়ে শান্তিপ্রিয় সকল মানুষের চাওয়া এটাই।

অজয় দাশগুপ্ত: কলাম লেখক, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক ও ব্যাংকার

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :