পর্যটন শিল্পের বিকাশকে এগিয়ে নিন

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন
 | প্রকাশিত : ২০ মে ২০২৪, ১১:২২

বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশের সম্ভাবনা নেই ঠিক তা নয়। বাংলাদেশ একটি অমিত সম্ভাবনার দেশ পর্যটন শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে। সঠিক পরিকল্পনায় দেশের পর্যটন স্পটগুলো উন্নত ও আকর্ষণীয় করা সম্ভব হলে পর্যটকদের একটি বিশাল অংশ এসব জায়গায় একা, সপরিবারে কিংবা দলবদ্ধভাবে ভ্রমণ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠবে। বেশিরভাগ মানুষের হাতে রয়েছে এখন অনেক অনেক টাকা। অনেক মানুষই এখন দেশ বিদেশের বিভিন্ন পর্যটন স্পটে ঘুরতে যায়। সপরিবারে বেড়াতে যায়। যাদের কম টাকা আছে তারা অবশ্য দেশের মধ্যেই ঘুরে বেড়ায়। যাদের একটু বেশি টাকা আছে তারা নেপাল-ভারত-ভুটান-সিকিম ইত্যাদি দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ায়। যাদের আরো বেশি টাকা আছে তারা মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াও ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়াও ঘুরে বেড়ায়।

এতো গেল আমাদের দেশের পর্যটকদের কথা। কিন্তু বিদেশের পর্যটকরা আমাদের দেশে না এলে এই দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে খুব একটা বেশি লাভ নেই। অথচ বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটকের বড়োই অভাব। বিদেশি পর্যটকরা যাতে এই দেশে বেড়াতে আসে এবং এই দেশের অনেক জায়গাও পর্যটন করার মতো সেটা মনে করার এবং সেটা নিয়ে কাজ করার মতো সময় এসে গেছে।

বাংলাদেশেও দেখার মতো অনেক জায়গা আছে। আছে অনেক ঐতিহ্য। তাই বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পকে আর অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। একথা এখন দিবালোকের মতো সত্য যে, বর্তমান বিশ্বে পর্যটন একটি অতি বড়ো মাপের শিল্প। আমাদের দেশে শিল্প বলতে এক সময় পাট শিল্পকে এবং বর্তমানে গার্মেন্টস শিল্পকে বোঝানো হচ্ছে। পর্যটনও যে একটি বড়ো মাপের শিল্প হতে পারে তা আমাদের দেশের জনসাধারণ এখনো হয়তো জানেই না। বাংলাদেশে পর্যটনও হতে পারে জাতীয় আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। আমাদের রয়েছে অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ। যার যথাযথ ব্যবহার আমাদেরকে পৌঁছে দিতে পারে সাফল্যের দ্বারে। এজন্য দরকার সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টা। বাংলাদেশ যে প্রাকৃতিকভাবে একটি সুন্দর দেশ তা সবাইকে জানাতে হবে। পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে বাংলাদেশের দ্বার।

বাংলাদেশের অনেক মানুষ হয়তো জানেন না যে- আমাদের কক্সবাজারের মতো বড়ো আর সুন্দর সি-বিচ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এটি বেশ ঢালু আর প্রশস্ত। প্রাকৃতিক এ সি-বিচ বিধাতার অপার দান বলতে হবে। বেশিরভাগ দেশের সি-বিচ হয় খাড়া আর সংকীর্ণ। কিন্তু তারা সেটাকেই সাজিয়ে-গুছিয়ে এবং সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এমন সুন্দর করে রেখেছে যে- পর্যটকরা দলে দলে ছুটে যায় সেই সব সমুদ্র উপকূলে। দুহাতে তারা খরচ করে টাকা। আয় হয় সেসব দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে। বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানও হয় এতে। অর্থনীতির ভিত হয় শক্তিশালী।

অথচ আমাদের দেশে কখনো এদিকে নজর দেওয়া হয়নি। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত যে বিশাল প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত (সি-বিচ) আছে তাকে ঠিকভাবে সাজাতে পারলে ঝঁকে ঝাঁকে বিদেশি পর্যটক আমাদের দেশে আসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পৃথিবীতে লাখ লাখ ভ্রমণ বিলাসী লোক রয়েছেন যারা সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন। তাদেরকে বাংলাদেশে টেনে আনতে হবে। এটা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে করা যাবে না। নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা আর বৈচিত্র্যপূর্ণ আনন্দদানের উপাদান-উপকরণ দিয়ে তাদের মনে আকর্ষণ ধরাতে হবে। উন্নত বিশ্বের ভ্রমণবিলাসী মানুষ টাকা খরচ করার জন্য এক পায়ে খাড়া। তাদেরকে টাকা খরচ করার সুযোগ করে দিতে হবে। আমাদের সি-বিচের মূল সমস্যা হচ্ছে এখানে পানি ছাড়া আর দেখার মতো কিছু নেই। হ্যাঁ, সমুদ্রের পানি অবশ্যই দেখবে। তবে তার সাথে আরো বহুবিধ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। কক্সবাজারে সব ধরনের হোটেল বানাতে হবে। যাতে ধনী, গরীব সবার থাকার মতো জায়গা থাকে। ফাইভ স্টার হোটেল থাকতে হবে। ভালো বিমান চলাচলের জন্য আন্তর্জাতিকমানের বিমানবন্দর ব্যবহারের সুযোগ থাকতে হবে। ঢাকা থেকে এখন ট্রেনে কক্সবাজার যাবার জন্য ট্রেনের সুযোগ তৈরি হয়েছে; এই সুযোগ সারা দেশের মানুষের জন্য নিশ্চিত করতে হবে। সব পর্যটক যে বিমানে যাবে কিংবা যেতে পারবে তা তো আর নয়। নাইট ক্লাব, ক্যাসিনো, বার , পাবসহ বিনোদনের সবধরনের সুযোগ থাকতে হবে। যদি দেশের কারো আপত্তি থাকে এই সব এলাকায় কেবল মাত্র বিদেশি ছাড়া আর কেউ যেতে পারবে না- এমন বিধান করা যেতে পারে। পর্যটকদেরকে টাকা খরচের সুযোগ করে দিতে হবে। কক্সবাজারে সমুদ্রে বোটে চড়ার সুযোগ নেই। নৌবিহারের সুযোগ থাকতে হবে। সমুদ্রের সব ধরনের সামুদ্রিক খেলার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সাগরে যেখানে সম্ভব মাছ ধরা দেখানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। মোটকথা সুযোগ সুবিধার কোনো প্রকার ঘাটতি রাখা যাবে না। মানুষকে টাকা খরচ করার জায়গা করে দিতে হবে। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত এক ফুট জায়গাও ফাঁকা না রেখে আধুনিক সুবিধাদি দিয়ে সাজিয়ে তুলতে হবে- যাতে ঝাঁকে ঝাঁকে বিদেশি ও দেশি পর্যটক আসে।

বাংলাদেশে পর্যটক এলে কত ধরনের লাভ যে হবে তা বলে শেষ করা যাবে না। প্রথমত, আমাদের জাতীয় বিমান সংস্থার সুনাম বৃদ্ধি করতে পারলে বিদেশিরা বাংলাদেশ বিমানেই আসবে। ফলে বিমানের লাভ হবে লাখ লাখ টাকা। এর জন্য বিমানের সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। অবশ্য বিমানের বর্তমান যা অবস্থা তাতে প্রবাসী বাংলাদেশিরাই তাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে আসার সময় বাংলাদেশ বিমানে চড়তে চায় না। কিন্তু বিমান ভালো হলে তা যে কেবল পরিবহণ হিসেবে কাজ করবে তাই নয়, তা হবে বাংলাদেশের জন্য একটি বিজ্ঞাপনও। বাংলাদেশ বিমান প্রচার করবে পর্যটন স্পটগুলো। নানাধরনের ভ্রমণ প্যাকেজ দিয়ে বিমান পর্যটক ধরে নিয়ে আসবে এই বাংলাদেশে।

অবশ্য চেষ্টা করলে বিমানের অবস্থার পরিবর্তন করা সম্ভব। একটি বাজেটে বিমানের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রেখে বিমানের সংস্কার করা প্রয়োজন। নতুন নতুন উন্নত মানের এয়ারবাস সংযোগ করতে হবে। দুর্নীতি দূর করতে হবে। সবাইকে সময়নিষ্ঠ হতে হবে। বাংলাদেশ বিমানের সব চেয়ে বড়ো দোষ তার সময়জ্ঞান খুবই টনটনে। নয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়বে এটি এখন কেবল বাংলাদেশের ট্রেনের ক্ষেত্রে নয় বিমানের ক্ষেত্রে আরো বেশি করে সত্য ও প্রযোজ্য। যান্ত্রিক ত্রুটিও বাংলাদেশ বিমানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাই বিমানের উন্নয়নে মনোনিবেশ করা জরুরি। এর কোনো বিকল্প নেই।

পর্যটনের দ্বিতীয় লাভ, বিদেশিরা বাংলাদেশে এসে দু’হাতে টাকা খরচ করবে। তাতে দেশের অর্থনীতি হবে মজবুত। তারা আসার সময় যে ভিসা নিয়ে আসবে তাতেও বাংলাদেশের লাভ হতে পারে। এদেশে এসে তারা যেসব তিন তারকা, চার তারকা, পাঁচ তারকা হোটেলে থাকবে তাতে লাভবান হবে দেশ। হোটেলে কর্মসংস্থান হবে অনেক মানুষের। তারা এদেশে এসে কেনাকাটা করবে। তাতে বিকশিত হবে এদেশের শিল্প। তারা এখানে এসে এদেশের রিকশায় চড়বে। ক্যাব ব্যবহার করবে। এতে এদেশের মানুষের লাভ ছাড়া ক্ষতি হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাদেরকে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে টাকা খরচ করার পথ বাতলে দিতে হবে আমাদেরকে।

বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের জন্য সর্বপ্রথম যা করা প্রয়োজন তা হলো সুনাম। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের কমপক্ষে একটি আকর্ষণীয় জিনিসের সুনাম ছড়িয়ে দিতে হবে। যেমন ভারতের রয়েছে তাজমহল। আমাদেরও তেমনি রয়েছে বিশাল সাগর উপকূল। এত বড়ো বেড়ানোর মতো উপকূল পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এই তথ্যটি আমার মনে হয় বিদেশি পর্যটকদের কাছে আজও পৌঁছেনি। এর জন্য দরকার সুনাম ও প্রচার। কথায় বলে, প্রচারেই প্রসার। বাংলাদেশের পর্যটন খাতের বিকাশে আমার প্রস্তাবগুলো হচ্ছে:

১। সাগর উপকূলকে পর্যটকদের বেড়ানোর উপযোগী করে সাজানো হোক। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে লুইআই কানের মতো ডিজাইনারদের দ্বারা উপকূল সাজানো হোক। এখানে নিরাপত্তার বিষয়টিকেও প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে ছিনতাইকারী আর মাস্তানে ভরপুর। মানুষের নিরাপত্তা এদেশে প্রধান একটি সমস্যা। পর্যটন স্পটসহ সারা দেশ থেকে ছিনতাইকারী আর মাস্তান উৎখাত করা হোক। যেন সারা দেশে মানুষ নির্ভয়ে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে পারে। অন্ততপক্ষে পর্যটন এলাকাগুলোতে ভালো নিরাপত্তা দেওয়া হোক। বিদেশি মেহমানরা যেন খারাপ ব্যবহার না পায়। তারা যেন বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালো ধারণা নিয়ে যেতে পারে।

২। রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থার (বাংলাদেশ ) সংস্কার করা হোক। যেন সকলেই এক বাক্যে বলতে বাধ্য হয়, বাংলাদেশ বিমান খুব ভালো বিমান। বাংলাদেশ বিমানের মতো বিমান আর হয় না। আসুন, আমরা বাংলাদেশ বিমানে চড়ি।

৩। ভিসা পদ্ধতি আরো উন্নত করা হোক। বিদেশি পর্যটকরা যাতে সহজে বাংলাদেশে আসার ভিসা পেতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।

৪। পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য প্রচারের ব্যবস্থা করা হোক। এর জন্য বাংলাদেশের স্যাটেলাইট টিভিগুলোকে কাজে লাগোনো যেতে পারে। বিজ্ঞাপনগুলো যেন ইংরেজিতে হয়।

৫। পর্যটন স্পটগুলোর বিপণিবিতানগুলোতে বিক্রেতা যাতে ইংরেজিতে কথা বলতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। তাদের ব্যবহার ভালো হতে হবে। এমনিতে বিদেশি মানুষ দেখলে দোকানিরা বেশি মাত্রায় লাভের চেষ্টা করে যা করা মোটেই উচিত নয়। বিপণিবিতানে সুন্দর পরিবশে থাকলে তারা কিনতে বেশি উৎসাহ বোধ করবে।

বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশেই পর্যটন শিল্প এখন জাতীয় আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে গৃহীত। আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায় মালদ্বীপ, শ্রীলংকা প্রভৃতি দেশ পর্যটন খাতে অনেক আয় করছে। পর্যাপ্ত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ কেন এ খাতে পিছিয়ে থাকবে? বর্তমানে দেশে সকল ক্ষেত্রে চলছে সংস্কারের জোয়ার। চলমান সরকারের কাছে তাই আমার প্রত্যাশ্যা- তারা পর্যটন খাতের দিকে এখনই সুনজর দেবেন। যাতে করে বাংলাদেশের পর্যটন খাতটি একটি অত্যন্ত লাভজনক শিল্প হিসেবে দাঁড়াতে পারে এবং আমাদের জাতীয় আয়ের একটি অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে বিশেষ অবদান রাখতে পারে।

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন: কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :