ভোট না দেয়ায় সমাজচ্যুত তিন আদিবাসী পরিবার
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় এক ইউপি চেয়ারম্যানের নির্দেশে তিনটি আদিবাসী পরিবারকে ১৩মাস ধরে সমাজচ্যুত করে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে ওই পরিবারগুলো মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। চেয়ারম্যান ও তার বাহিনীর অব্যাহত হুমকি-ধামকি, অত্যাচার-নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে পড়েছেন পরিবারগুলো। এসব পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তি, বাক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। তাদের দুঃখ কষ্টের কথা শুনে চোখে জল এসে যাবে মানুষের।
ইউপি নির্বাচনে ওই চেয়ারম্যানকে ভোট দেননি এমন সন্দেহে তাদের সমাজচ্যুত করে রাখা হয়েছে বলে জানান ভুক্তভোগি পরিবারের সদস্যরা।
তাড়াশ উপজেলার তালম ইউনিয়নের তারটিয়া গ্রামে বাস করে এই পরিবারগুলো।
আদিবাসী অধ্যুষিত এ গ্রামে বাস করে মোট ৫২টি আদিবাসী পরিবার। এ বিষয়ে ভুক্তভোগি পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে স্থানীয় এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযোগ করা হলেও এর কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।
ভুক্তভোগি পরিবারের সদস্যদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে বেড়িয়ে আসে তালম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্বাস উজ্জামান ও তার বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র।
শনিবার দুপুরে সরেজমিনে ওই গ্রামে গেলে এ প্রতিবেদকের উপস্থিতি টের পেয়ে আদিবাসী পরিবারগুলোর মধ্যে নেমে আসে নিরবতা ও আতংক। অধিকাংশ বাড়ি-ঘরের দরাজা জানালা বন্ধ। বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে গ্রামের লোকজন যাতায়াত করলেও কেউ সমাজচ্যুত পরিবারের সদস্যদের দিকে ফিরেও তাকায় না। ভয় শাস্তির।
এব্যাপরে কথা হয় সমাজচ্যুত একটি পরিবারের প্রধান শ্রী সধু চন্দ্র দাসের (৫০) সাথে। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কয়েকদিন পর চেয়ারম্যান সাহেব পাড়ার লোকজন নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে গ্রাম্য শালিস ডাকেন। ওই শালিসে চেয়ারম্যান সাহেব অন্যায়ভাবে আমাদের সমাজচ্যুত করেন এবং তা নির্দেশনা ঠিকঠাক পালনের নির্দেশ দেন।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, গত ইউপি নির্বাচনে বর্তমান চেয়ারম্যান আব্বাস উজ্জামানকে ভোট দেইনি এমন সন্দেহে নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের সাথে সাথে চেয়ারম্যানের সমর্থকরা একটি মিছিল নিয়ে আমার, আমার ছোট ভাই মদন চন্দ্র দাস ও ভগ্নিপতি মন্টু চন্দ্র দাসের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে।
এসময় স্থানীয় কয়েকজনের সহায়তায় প্রাণ রক্ষার জন্য আমরা তিন পরিবারের প্রধান ও এক ভাতিজাসহ গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাই। হামলাকারীরা আমাদের না পেয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে আমাদেরকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। পরদিন দুপুরে চেয়ারম্যানের সমর্থকরা আমাদের সমিতির নামে লিজ নেয়া পুকুর থেকে সমস্ত মাছ মেরে নিয়ে যায়। এর দুই দিন পর আবারও আমাদের না পেয়ে আমাদের দানকৃত এক শতক জমিতে নির্মিত রাধা গোবিন্দ মন্দির থেকে রান্না করার দুটি ডেকচি, ১৫০টি থালা, কড়াই, বালতি জগসহ মন্দিরের যাবতীয় জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। এসব ঘটনার প্রায় ১৫দিন পর স্থানীয় কয়েকজনের সহযোগিতায় আবারও বাড়ি ফিরে আসলেও বর্তমানে যেভাবে বেঁচে আছি সে বাঁচার কোনো অর্থই হয় না বলে দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি। সধু চন্দ্র দাস আরও বলেন, এদিকে আমাদের দানকৃত জায়গায় মন্দির রয়েছে বলে ওই মন্দিরে অন্যরা পূঁজা অর্চণা করতে পারবে না বলে ওই শালিসে ঘোষণা দেয়া হয়। আগে আমাদের সম্প্রদায়ের সকলে এক সাথে মিলে মিশে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করলেও চেয়ারম্যানের ওই ঘোষণার পর থেকে অন্য আদিবাসী পরিবারের সদস্যরা ধর্মীয় উপাসনা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন।
তিনি বলেন, চেয়ারম্যান আব্বাস উজ্জামানের সমাজচ্যুতের নির্দেশের ফলে আমার চার বছর বয়সের নাতি হৃদয় মারা গেলেও তার সৎকারে যেতে পারিনি। পরিবারের কোনো সদস্য অসুস্থ্য হলে হাসপাতালে নেয়ার জন্য কোনো ভ্যান পাওয়া যায় না। নিকটাত্মীয়রা পর্যন্ত আমার ছয় মাসের ছেলেকে কোলে তুলে নিতে ভয় পায়।
তিনি আরও জানান, নিজের সাড়ে ১৬শতক জমিতে ধান চাষ করে বছরের খোরাক জোটে। জমিতে কেউ সেচ না দেয়ায় নিরুপায় হয়ে এক বছর পতিত থাকার পর এবার জমির ওপর স্যালো মেশিন বসিয়েছি। ছোট ভাই মদনের একটি ভটভটি থাকলেও তা দিয়ে কোনো কাজ করতে পারছে না। পদে পদে তাকে বাধা ও চুরি-ডাকাতির মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেয়া হচ্ছে। এছাড়া, ওই সালিশ বৈঠকে আমাদের সাথে কেউ কথা বললে ১০টি জুতার বাড়ি ও ১০হাজার টাকা জরিমানার নির্দেশ দেন চেয়ারম্যান।
সমাজচ্যুত আরেক পরিবার প্রধান মদন চন্দ্র দাস ঢাকাটাইমসকে বলেন, দিন মজুরের কাজ না করলে পেটে ভাত জোটে না। সমাজচ্যুত থাকায় গ্রামের কেউ কাজে নিতে সাহস পায় না। দূরের গ্রামগুলোতে কাজ করে দুবেলা ভাতের যোগাড় করতে হয়। এছাড়া, এ গ্রামে একটি মাত্র মুদি দোকান। নিত্য প্রয়োজনীয় বাজার সদাই করতে যেতে হয় দূরের কোনো গ্রামে। কারণ, সমাজচ্যুতের কাছে কেনা-বেচা নিষেধ।
সধুর স্ত্রী সবিতা রানী বলেন, তার ভাগিনা রঘুনাথ খাওয়ার জন্য একটা তাল দেয়ার অপরাধে সালিশ বসিয়ে তাকে জুতা পেটা করা হয়। এ ছাড়া, তারই ভাতিজা সুরেশ একদিন গোপনে মদনের বাড়িতে গেলে তাকেও একই শাস্তি দেয়া হয়। রঘুনাথ ও সুরেশ এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন।
একই গ্রামের শতবর্ষি সুনীল দাস ওই তিন পরিবারের সমাজচ্যুতের কথা স্বীকার করে বলেন, ছোট বেলা যাত্রা দেখেছি ‘জোর যার মুল¬ক তার’। আমাদের এখানে চেয়ারম্যান সাহেব সেভাবেই চালাচ্ছেন। সমাজচ্যুত একটি পরিবারের সাথে আমার ভাগ্নির বিয়ে হয়েছে। গত এক বছর ধরে তার সাথে দেখা সাক্ষাত করে পারি না। চেয়ারম্যানের কথা অমান্য করলে বৃদ্ধ বয়সে জুতার বাড়ি খেতে হবে। তাই মনে কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি।
এদিকে, ভুক্তভোগি ও স্থানীয়রা দ্রুত এ জুলুম-নির্যাতন থেকে পরিত্রাণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করে বলেন, আমরা কারও সাথে বিরোধ চাই না। সমাজের আর দশজন মানুষের মতো সবার সাথে মিলে মিশে বসবাস করতে চাই।
অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে স্থানীয় ইউপি মেম্বর আজিজুল হক ঢাকাটাইমসকে বলেন, সমাজচ্যুতের বিধান কোনো আইনে নেই। অথচ, আমার এলাকার এ তিনটি পরিবারকে চেয়ারম্যান সাহেব সমাজচ্যুত করে রেখেছেন। বিষয়টি মীমাংসার জন্য চেয়ারম্যান সাহেবকে বেশ কয়েক বার তাগাদা দিয়েছি। তিনি শধু সময় ক্ষেপণ করছেন।
এ প্রসঙ্গে তালম ইউপি চেয়ারম্যান আব্বাস উজ্জামানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ওই পরিবারগুলো সমাজচ্যুতির কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, বিষয়টি আমার ইউনিয়নে হলেও আমি অবগত নই। এর সাথে আমার কোনো সংশি¬ষ্টতাও নেই।
এ ব্যাপারে তাড়াশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মনজুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, আমি বিষয়টি অবগত নই। কেউ অভিযোগ করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
(ঢাকাটাইমস/৩০মে/প্রতিনিধি/ইএস)
মন্তব্য করুন