ঠাঁকুরগাঁওয়ে সুদের কারবারি সাঈদের কাছে জিম্মি কয়েক গ্রামের শতাধিক পরিবার

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ঢোলারহাট ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামের বাসিন্দা আমির হোসেন। গাড়িতে মালামাল লোড-আনলোডের (কুলির) কাজ করেন তিনি। সে আয়ে তিন সন্তানসহ ৫ সদস্যদের পরিবারের ভরণপোষণ চালাতেন। হঠাৎই ডায়বেটিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন তিনি।
প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হতে পারেননি আমির। পরে স্থানীয় সুদের ব্যবসায়ী আবু সাঈদের কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা ধার নেন। পরে নেন আরও ২০ হাজার। দুই ধাপে নেওয়া ৬০ হাজার টাকা কাল হয়ে দাঁড়ায় আমিরের জন্য। সুদসহ ১ লাখ ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করলেও ৬ লাখ টাকার মামলা দিয়েছেন আবু সাঈদ। এর আগে হুমকি-ধামকিসহ নানাভাবে হয়রানিও করেছেন আমিরের পরিবারকে।
আমিরের স্ত্রী ফাতেমা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামীর অসুস্থতার কারণে সাঈদের কাছে ৬০ হাজার টাকা নিছিলাম। অনেক লাভ চালাইছি, পরে আসল টাকার জন্য হুমকি-ধামকি দেয়। পরে আমার ৫ শতক জমি বিক্রয় করে ৮০ হাজার টাকা পরিশোধ করি। তখন এই টাকায় সাঈদ মানে না। মোট সুদে-আসলে ওকে টাকা দিলাম ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। ১০ হাজার টাকা আরও দাবি করে ও। পরে ওই টাকা না দিতে পারায় আমাদের নামে ৬ লাখ টাকার মামলা দিয়েছে। আমি এর সুষ্ঠ বিচার চাই।’
ভুক্তভোগী আমির বলেন, ‘সাঈদের কারণে আমি তিন মাস বাসা ছেড়ে পালিয়ে ছিলাম। আমি অসুস্থ হওয়ার কারণে ওর কাছ থেকে টাকা ধার নিই। কিন্তু এই ধারের টাকাই আমার জন্য বিপদ হয়ে গেছে। সুদের টাকা দেওয়ার পরেও আসল টাকার জন্য অনেক চাপ দিছে। পরে জমি বিক্রয় করে আসল টাকা শোধ করলেও তার দাবির শেষ নাই। এখন ৬ লাখ টাকার মামলা দিছে। সারাদিন দিনমজুরের কাজ করি আর মামলার খরচ চালাই। আমি এটার সুষ্ঠ বিচার দাবি করি। আমি তো সাঈদের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা নিইনি। মিথ্যা মামলা দিছে আমার নামে। আমি তার বিচার চাই।’
আমিরের মতই আরও অনেকে সাঈদের জালে পা দিয়ে সর্বশান্ত হয়েছেন। সুদে-আসলে টাকা পরিশোধ করেও মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে মামলা, পুলিশ দিয়ে হয়রানি, বেঁধে পেটানোসহ নানা রকম নির্যাতনের স্বীকার এলাকার মানুষ। টাকা দেওয়ার আগে ফাঁকা চেকে, স্ট্যাম্প ও জমির দলিল নেওয়া। পরে সেই চেকে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে মামলা করেন আবু সাঈদ। তার এমন কর্মকাণ্ডের শিকার কয়েক গ্রামের শতাধিক পরিবার।’
সাঈদের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে বিপাকে পড়া আরেক ভুক্তভোগী ঠাকুরগাও সদর উপজেলার ঢোলারহাট ইউনিয়নের উত্তর বোয়ালিয়া গ্রামের রবিউল ইসলামের ছেলে আলমগীর হোসেন। আরেকজন হোটেল জালাল। তিনি ঢাকায় পলাতক ছিলেন কয়েকমাস। ওই গ্রামের স্বাধীন রায়ের ছেলে গোপাল চন্দ্র রায় ভারত পালিয়ে চলে গেছে। মাধবপুর গ্রামের মৃত দুলালের ছেলে শাহ আলম, একই গ্রামের আমির হোসেনের স্ত্রী ফাতেমা বেগমসহ আরও অনেকে।
সুদের জালে পা দেওয়া ভুক্তভোগী ঢোলোরহাট এলাকার আবুল কালাম বলেন, ‘সমস্যার কারণে আমি সাইদের কাছ থেকে লাভের উপর ৬০ হাজার টাকা নিয়েছিলাম। পরে ১ বছরে শোধ করছি ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। মাঝে টাকা ১-২ মাস দেরি করে দেওয়ার জন্য সাইদ পুলিশ দিয়ে হুমকি দেয় আমাকে। অনেকবার বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখায়। এলাকায় সাইদ নামকরা সুদের ব্যবসায়ী।
ওই এলাকার আরেক ভুক্তভোগী আনোয়ার বলেন, ‘আমি টাকা নেওয়ার পরে কয়েকমাস সুদ দিতে পারি নাই সাঈদকে। টাকা নিছিলাম ৪০ হাজার। তার বিপরীতে সুদ দিয়েছি ১ লাখ ২০ হাজার। পরে টাকা দিতে পারছিলাম না, সে জন্য সাঈদ পুলিশ পাঠিয়ে হুমকি দেয়। ভয়ে আমি অন্য জেলায় পালিয়ে ছিলাম তিন মাস। টাকা জোগাড় করে আরও ৬০ হাজার টাকা দিয়ে এখন নিজ এলাকায় দিনমজুরের কাজ করে জীবন চলছে। সুদের উপর টাকা নিয়ে আমার পরিবার একবারে নিঃশ্ব হয়ে গেছে।’
আলী হোসেন আকবর নামে আরেকজন বলেন, ‘২০ হাজার টাকা ধার নেওয়ার বিপরীতে সাঈদ আমার নামে ৩ লাখ টাকার মামলা দিয়েছে। ২০ হাজার নিয়ে ৬০ হাজার টাকা শোধ করেছি। টাকা দিতে দেরি হওয়ায় ৩ লাখ টাকার মামলা দেয়। পরে এলাকায় মীমাংসা করে তার হাত থেকে মুক্তি পাই। আমি সাঈদের বিচার চাই। বিপদে পড়া মানুষের সুযোগ নিয়ে সে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে।’
এ ব্যাপারে সাঈদের সঙ্গে দেখা করে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি ক্যামেরার সামনে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে গোপন ক্যামেরায় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা পাওয়ার বিপরীতে ৬ লাখ টাকার মামলা দেওয়ার কথা স্বীকার করেন। এছাড়া বিভিন্নজনকে ধারে টাকা দেওয়ার বিষয়টিও কবুল করেন।
ঠাকুরগাও জেলা সমবায় কার্যালয়ের উপ-সহকারী নিবন্ধক একেএম জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘জেলায় ঋণ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নিবন্ধিত সমবায় সমিতি প্রায় চারশো। নিবন্ধন ছাড়া সুদের ব্যবসার সমিতি রয়েছে সাত শতাধিক। যারা কোনো ধরনের নিয়মের তোয়াক্কা না করেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণ আইনের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে পারে। এসব বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে আমি মনে করি।’
ঠাকুরগাওয়ের পুলিশ সুপার শেখ জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সুদের ব্যবসা ধর্মেই হারাম ও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমরা অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেব।’
(ঢাকাটাইমস/১৫ডিসেম্বর/এজে)

মন্তব্য করুন