ক্ষমতার ‘রস আস্বাদনে’ সেরা মওদুদ
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী বাংলাদেশি সরকারের (মুজিবনগর সরকারের) পোস্ট মাস্টার জেনারেল ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও সুবিধাভোগী ছিলেন তিনি। পরে অবশ্য দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে যান। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান সরকার গঠন করলে উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। পরে এরশাদ সরকারের আমলে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে যোগ দেন জাতীয় পার্টিতে। সেখানেও মন্ত্রিত্ব পান তিনি। শেষে উপরাষ্ট্রপতি করা হয়েছিল তাকে।
তিনি হলেন মওদুদ আহমেদ। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপিবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশও নেন তিনি। পুলিশের হাতে নির্যাতিতও হন। আর এক পর্যায়ে বলেন, এই জীবনে আর দল বদল করবেন না। তবে ৯৬ সালের নির্বাচনে হেরে গিয়ে আবার দলবদল করেন। যোগ দেন বিএনপিতে। আর ২০০১ সালের নির্বাচনে জিতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দায়িত্ব পান বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের।
অর্থাৎ রাজনৈতিক জীবনের একটি বড় অংশই ক্ষমতার আশেপাশেই ছিলেন মওদুদ আহমদ। দেশের তিনটি বড় রাজনৈতিক দলের সুবিধাভোগী ছিলেন এই নেতা। রাজনীতিতে তার ঘনিষ্ঠরাই ঠাট্টার ছলে বলেন, রাজনীতিতে ক্ষমতার রস আস্বাদনে সেরা ব্যারিস্টার মওদুদ। তার জুড়ি মেলা ভার।
ছাত্রজীবন থেকেই কমবেশি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মওদুদ আহমদ। ঢাকা কলেজের ছাত্রসংসদের আপ্যায়ন সম্পাদক দিয়ে শুরু। তারপর অ্যাডভোকেট ফরমান উল্লাহ খান খেলাফত রাব্বানী প্রতিষ্ঠা করলে মওদুদ আহমদ ওই সংগঠনের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশক্তির নেতা হন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে লড়তে তরুণ ব্যারিস্টার মওদুদের ভূমিকা ছিল। বৃটিশ আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসিকে বাংলাদেশে আনতে তার অবদান ছিল। তিনিও ছিলেন ওই আইনজীবীর সহযোগী হিসেবে। ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর গোলটেবিল বৈঠক হয়। সেখানেও ছিলেন মওদুদ। মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের পোস্টমাস্টার জেনারেল নিয়োগ করা হয় তাকে।
ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মওদুদও বদলে যান। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা এলে ১৯৭৭ সালে উপদেষ্টার দায়িত্ব পান মওদুদ। বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে আহ্বায়ক করে গঠিত জাগদলের ১৯ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিতেও ছিলেন তিনি। পরে জিয়াউর রহমানকে আহ্বায়ক করে বিএনপি করা হলে সেখানেও সদস্য হন একসময় বঙ্গবন্ধুর আশেপাশে থাকা মওদুদ। ১৯৭৯ সালে তিনি জিয়াউর রহমান সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তবে সরকার প্রধানের সিদ্ধান্তে অমত করায় মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন তিনি।
এরপর ক্ষমতায় আসেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দলের শৃঙ্খলা না মানায় ১৯৮৫ সালের ২৫ জুন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হন মওদুদ আহমদ। এরশাদ সরকারের প্রথম দিকে ১০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন মওদুদ। কিন্তু এরশাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেই দণ্ড থেকে রেহাই পান বিচক্ষণ এই নেতা। জাতীয় পার্টি গঠনে ভূমিকা রাখেন। উপহার হিসেবে ১৯৮৫ সালে এরশাদ সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী হন। পরে ৮৬ সালে উপপ্রধানমন্ত্রী, ৮৮ সালে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতার দায়িত্ব পান মওদুদ আহমেদ। ৮৯ সালে তিনি উপরাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ পান। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতন হলে কিছু সময়ের জন্য মওদুদ আহমদ অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন।
পরে ১৯৯১- সালে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আবারও দল বদলান মওদুদ আহমদ। ফিরে আসেন বিএনপিতে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য পদ পান তিনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে ধানের শীষ নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী করা হয় তাকে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নোয়াখালী-৫ আসনে হারার পর খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেয়া বগুড়া-৭ আসনে উপনির্বাচনে বিএনপির টিকিটে জিতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মওদুদ।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। তবে মওদুদ আহমদ ঠিকই আলোচনা থেকেছেন। ‘এ স্টাডি অব পলিটিক্যাল অ্যান্ড মিলিটারি ইন্টারভেনশন ইন বাংলাদেশ’-বইয়ে কর্নেল তাহেরের বিচারের বিষয়টি তুলে ধরেন। যেখানে জিয়াউর রহমানের সমালোচনা করেন তিনি। পাশাপাশি এক/এগারোর প্রেক্ষাপটে লেখা ‘বাংলাদেশ: ইমারজেন্সি অ্যান্ড দ্য আফটারমাথ : ২০০৭-২০০৮’বইয়ে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের প্রসঙ্গ টেনে সমালোচিত হন।
এই বইয়ে মওদুদ লেখেন-‘খালেদা জিয়ার কাছে ওই সময়ে তার নিজের দুই সন্তান তারেক ও কোকোর ভাগ্যই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা ছাড়া কোনো আলোচনায় যেতে রাজি ছিলেন না খালেদা জিয়া। নানা রকম চাপেও অনড় ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। সে সময়ে দেশের মানুষের নেত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন কিংবা একজন রাজনীতিবিদের চেয়েও একজন মা হিসেবে দুই সন্তানের মুক্তির বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন খালেদা জিয়া।’
(ঢাকাটাইমস/০৫জুন/এইচএফ/ডব্লিউবি)
মন্তব্য করুন