শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাচার

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:০০

চট করে কাউকে যদি জিজ্ঞেস করি বলেন তো ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কী দিবস কিংবা আজ কততম শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, অনেকেই হয়ত বলতে পারবেন না। এ জাতীয় দিবসগুলো জাতি হিসেবে আমরা সিরিয়াসলি পালন করি না বলেই এমনটা হয়। মন থেকে পালন করলে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলত; আমরা দেশকে ভালোবাসতাম; ভোগবাদী আর দুর্নীতিপ্রিয় হতাম না।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সরকার, রাজনৈতিক দলসমূহ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে ‘বুদ্ধিজীবী’ কিংবা অন্যান্য জাতীয় দিবস পালন করে। তবে সবাই রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে এসব দিবস পালন করে- একথা বললে দেশপ্রেমিক ও সৎ অংশটির প্রতি অবমূল্যায়ন করা হয়।

সারা বছর ঘুষ খেয়ে, নানা দুর্নীতি করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠা অনেকেই তো আনুষ্ঠানিকভাবে এসব দিবস পালন করে, ছবি তোলে। টেলিভিশনে, সংবাদপত্র, ফেসবুকে এসব ধূর্ত রাজনীতিবিদ, আমলা ও সাংস্কৃতিক সংগঠকদের ছবিই বেশি আসে। অন্যদিকে বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিকসহ অন্যান্য খেটে খাওয়া মানুষ, উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও কৃষিবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে অনবদ্য অবদান রেখে চলেছেন। গ্রামের হাজার হাজার কৃষক হয়ত কোনোদিনই রাজধানী ঢাকায় আসেনি, কিন্তু কী অসীম সততা আর সাধনা নিয়ে প্রতিদিন রাষ্ট্রের প্রতি তার দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করে চলেছে।

বুদ্ধিজীবী দিবসে তাই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি সম্মান জানাতে গিয়ে কিছু তিক্ত, কিন্তু প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে কথা বলা জরুরি হয়ে ওঠেছে। নির্দিষ্ট একটা দিনে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হলেও ১৯৭১ ‘বুদ্ধিজীবী’ নিধনযজ্ঞ প্রায় পুরো নয় মাসজুড়েই চলে। যেমন ২৫ মার্চ যেদিন ঢাকায় হামলা হলো, সেদিনই ইত্তেফাক ও সংবাদের কয়েকজন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়। আর সে ভয়াল রাতের নিষ্ঠুর হামলায় কত শিক্ষক, ছাত্র, লেখক, কবি-সাহিত্যিক-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার মারা গেছেন, তার সঠিক হিসাব রাখা সহজ কাজ নয়।

রাজারবাগের সে প্রতিরোধযোদ্ধা বীর পুলিশ ভাইদের কথাও ভুলে গেলে চলবে না। সেই শুরু, এরপর মুক্তিযোদ্ধারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর তাদের স্থানীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর অত্যাচারও বেড়েছে।

১৯৭২ সালে প্রকাশিত নানা পত্র-পত্রিকার খবর ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ-বক্তৃতা অনুযায়ী, ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর তাদের স্থানীয় দোসররা। ৩০ লাখ মানুষের হত্যাকে স্মরণ করার জন্য বিশেষ কোনো দিবস না থাকলেও, ১৪ ডিসেম্বর নিহত শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তারসহ নানা পেশার মেধাবী মানুষগুলোর হত্যাকে স্মরণ করার জন্য বুদ্ধিজীবী দিবসের প্রচলন করা হয়। দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী আবুল কাশেম ফজলুল হকের এক টেলিভিশন অনুষ্ঠান থেকে জেনেছি, ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উদ্যোগে ‘বুদ্ধিজীবী দিবস’ পালন শুরু হয়।

পরাজয় নিশ্চিত জেনে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি আর্মি অফিসারদের নির্দেশে স্থানীয় জামায়াত, আল-বদর, আল-শামস বেছে বেছে বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবী সন্তানদের হত্যা করে। উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। স্বাধীনতাবিরোধীরা তাদের পরিকল্পনায় কতখানি সফল হয়েছে, তা আমরা পরবর্তী সময়ে দেখতে পেয়েছি। ১৬ ডিসেম্বর শত্রুশক্তির পরাজয় নিশ্চিত হলেও হত্যাকা-ের ধারাবাহিকতা থেমে যায়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে প্রায় পুরো পরিবারসহ হত্যা করা হয়। কদিন পর ৩ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের চার গুরুত্বপূর্ণ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এএইচ এম কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে হত্যা করা হয়। এগুলো ছাড়াও, সেনাবাহিনীতে যেসব অফিসার মুক্তিযুদ্ধফেরত ছিলেন, তাদের প্রায় সবাইকে নানা অজুহাতে কোর্ট মার্শাল করে বা গুলি করে হত্যা করা হয়।

অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পরে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা একই সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশ যেন কখনোই সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হতে না পারে এ জন্য এই হীন প্রক্রিয়া। অবশ্য মেধাবী সন্তানদের হারিয়ে ফেলা শুরু সেই ১৯৪৭ সাল থেকে। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু এলিট ও জমিদার শ্রেণির বিশেষ আগ্রহে, তৎকালীন ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক শক্তির সম্মিলিত প্রয়াসে ধর্মের ভিত্তিতে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তৎকালীন মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের জন্য সমমনাদের নিয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুললেও দিল্লিতে মুসলিম লীগের জিন্নাহ আর কংগ্রেসের জহরলাল নেহেরুর যৌথ বিশ্বাসঘাতকার জন্য সফল হতে পারেননি। হিন্দুদের আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ভারত জন্ম নিলে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের মেধাবী হিন্দু শিক্ষক, বিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের একটা বড় অংশ পূর্ববঙ্গকে প্রায় শূন্য করে দিয়ে ভারতে চলে গিয়েছিলেন।

পূর্ব-পাকিস্তান নাম নিয়ে পূর্ববঙ্গ নতুন করে যাত্রা শুরু করে। দীর্ঘদিন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে বাংলা কোনো পত্রিকা বের হয়নি। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইত্তেহাদ আর মিল্লাত পত্রিকা ছিল প্রথম দিকের ভরসা। পাকিস্তানের জন্মের ঠিক আগে, ১৯৪৭ সালের জুন-জুলাই মাসে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. মুহম্মদ এনামুল হকসহ গুটিকয়েক ‘বুদ্ধিজীবী’ বাংলা ভাষার প্রশ্নে পশ্চিম পাকিস্তানি এলিটদের অপমানজনক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাঙালি জনসাধারণকে সতর্ক করেছিলেন। ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তান টিকবে না, মর্মে সতর্কবাণীও দিয়েছিলেন তারা।

১৯৪৭ এর দেশভাগের ফলে বড় বড় ‘বুদ্ধিজীবী’রা পূর্ববঙ্গ ছেড়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়ায় পাকিস্তান আমলে ‘বুদ্ধিজীবী’ পরিচয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে আওয়াজ তোলার মতো মানুষ ‘বুদ্ধিজীবী’ মহলে খুব বেশি ছিল না। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশে যারা ‘বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে’ বড় বড় পজিশন উপভোগ করেছেন, তাদের অনেকেই পাকিস্তান আমলে ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ হিসেবে কাজ করেছেন বলে কোনো কোনো বইপত্রে লেখা আছে। তবে পাকিস্তান আমলে রাজনীতিবিদ হিসেবে ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত কিংবা সাংবাদিক হিসেবে দৈনিক ইত্তেফাকের মানিক মিয়া ভাষার মর্যাদা ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে আপসহীন চরিত্রের ঐতিহাসিক নজির হয়ে আছেন। তাদের মতো আরও কিছু প্রগতিশীল মানুষের সম্মিলিত ও সময়োচিত তৎপরতায় পশ্চিম পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠীর নানা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আগ্রাসন বাঙালির অগ্রযাত্রাকে সে সময় ব্যাহত করতে পারেনি। আরবি হরফে বাংলা চালু করার মতো অবৈজ্ঞানিক ও আধিপত্যবাদী আচরণও বাঙালি মেনে নেয়নি। বরং স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের প্রক্রিয়ায় বাঙালি একটু একটু করে এগিয়ে গেছে।

প্রকৃত পক্ষে, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের নানাবিধ কর্মতৎপরতা দিয়ে বাঙালি জাতির মানসে এতটাই প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান চর্চায় যে বিশাল ঘাটতি ছিল, তা খুব বড় বাধা হয়ে উঠতে পারেনি। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর আমরা দেখি সরকারি টেলিভিশন বা রেডিও চ্যানেলের ঢাকা অফিস সরকারের নির্দেশ অমান্য করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত টেলিভিশন আর বেতারের শিল্পীরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ কেন্দ্রের মতো মহান গণমাধ্যমের জন্ম দিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের মনোবল চাঙা করতে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা ছিল অসাধারণ।

মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদের অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের কলেজে দিব্যি চাকরি করেছেন, বেতন-ভাতা নিয়েছেন। আমি শুনেছি, কবি শওকত ওসমান ঢাকা কলেজের যে পদ ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, সে পদে পরে এসে একজন জয়েন করেছিলেন। এই ব্যক্তি এখন বাংলাদেশের অন্যতম সুবিধাপ্রাপ্ত ও ‘আলোকিত’ বুদ্ধিজীবী। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে ক্যাম্পাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হামলা চালিয়ে অনেক শিক্ষক-ছাত্রকে হত্যা করেছিল। পরবর্তী নয় মাস, ১৪ ডিসেম্বরের সেই বেদনায়দায়ক দিবসের আগে, ক্যাম্পাসের শিক্ষকরা কী করছিলেন, কতজন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন, কতজন আরাম-আয়েশে দিন-রাত্রি যাপন করেছেন, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। মুরব্বিদের মুখে এবং লেখায় এমনও জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক প্রতিবেশী শেরাটন হোটেলে পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে গলা ভেজাতে আসতেন। ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-রাজনীতিবিদরা যখন স্বাধীনতা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সবাই কী করছিল আমার জানার খুব ইচ্ছা।

বুদ্ধিজীবীদের পরিচয় এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা বহিঃশক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ততার ওপর নির্ভর করে। যতই দেশের সর্বনাশ হোক, বর্তমানের বুদ্ধিজীবীদের একাংশের কোনো নড়চড় লক্ষ্য করা যায় না। অন্যদিকে আরেকদল ‘বুদ্ধিজীবী’ আছেন, যারা অত্যন্ত কৌশলে বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকেন। এদের অনেকেই ‘সুশীল’ সমাজভুক্ত।

স্বাধীন বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীরা জাতিকে এক সূতায় গাঁথতে পারেননি। কিন্তু পুঁচকে বয়সী সব ক্রিকেট খেলোয়াড়রা জাতিকে একতা এনে দিয়েছেন। যে কাজ বইপত্র, গল্প-উপন্যাস, টেলিভিশন-সিনেমা পারেনি, সে কাজে দারুণ ভূমিকা রাখছেন আমাদের ক্রিকেটাররা। একমাত্র ক্রিকেট খেলা হলেই দেখা যায়, হিন্দু-মুসলমানেরা একসাথে হাত হালি দিচ্ছেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াতসহ সব দলের সাপোর্টার নিজ দেশের সাফল্যে উল্লসিত হচ্ছেন।

এত কিছুর পরেও বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়ে যায়নি। সমুদ্রসীমার আইনি লড়াইয়ে ভারত ও মিয়ানমারকে হারিয়ে, বিশ্বব্যাংকের ষড়যন্ত্রকে পায়ে ঠেলে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করে দিয়ে বাংলাদেশ শক্তিমত্তার প্রমাণ দিয়েছে। বাংলাদেশকে বলা হচ্ছে বিনিয়োগবান্ধব পরবর্তী ১১টি দেশের একটি। যদিও দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি রক্ষার লড়াইয়ে বাংলাদেশের পারফর্মেন্স খুব দুর্বল।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :