মুজিববর্ষ হোক সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বছর

মো. তাজুল ইসলাম
| আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২০, ১০:০৭ | প্রকাশিত : ১১ জানুয়ারি ২০২০, ১৯:৩০

কিউবার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোর একটি উক্তি দিয়ে শুরু করতে চাই। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখি নাই, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি।’ পাহাড়সম ব্যক্তিত্ব হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর ক্ষণগণনা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, নানা বিভাগ ও অধিদপ্তর এই বছরটি পালন করছে নানা স্লোগানে। পুলিশ বলছে ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার’। বাংলাদেশ সরকারের আইন ও বিচার বিভাগও মুজিববর্ষ ঘিরে নানা কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বিচার বিভাগের স্লোগান এ রকম হতে পারে- ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, সামাজিক ন্যায়বিচার।’

সামাজিক ন্যায়বিচার কী এবং জাতির পিতা কীভাবে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তা এই লেখার মধ্যে সবিস্তারে না হলেও মূল বক্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করব।

বর্তমান পৃথিবীতে শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত প্রয়োজন। সামাজিক ন্যায়বিচারের মূল লক্ষ্য হলো প্রত্যেককে তার হক বা প্রাপ্য অংশ পরিপূর্ণভাবে দিয়ে দেয়া। এক্ষেত্রে ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু, সাদা-কালো, আরব-অনারব, সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু, দল-মত হিসাব করে কেউ কোনো রকম অন্যায়-অবিচার ও জুলুম-নির্যাতনের শিকার হবে না। বঙ্গবন্ধু অনেকগুলো নীতি বাস্তবায়নে জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তার মধ্যে সমাজতন্ত্র তথা সামাজিক ন্যায়বিচার ছিল চতুর্থ নীতি।

বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় বিশ্বে দুটি সমাজবিপ্লব সফল হয়েছিল। একটা মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে গণচীন এবং অপরটা লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা। সমাজতন্ত্রে মার্কসবাদী দর্শনের ভিত্তিতে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে আজকের সেই সমাজতন্ত্রের পরিণতি দেখে বঙ্গবন্ধুর সময়ের বিদ্যমান বাস্তবতার তুলনা করা সমীচীন নয়। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন বঙ্গবন্ধু মার্কসবাদী দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তা না হলে শোষণমুক্ত সমাজের কথা তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বলতেন না। তবে ষাট ও সত্তরের দশকে বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন, ব্যক্তিমানুষ স্বার্থ, রাষ্ট্র ও সমাজে বিলীন হওয়া উচিত নয়। বঙ্গবন্ধু কোনো গণ্ডির, দেশের বা বিশেষ দর্শনের নীতিতে বিশ্বাস করতেন না। তিনি ভাবতেন নিজ দেশের জনগণের প্রয়োজন ও প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। সেই দর্শনে থাকবে শোষিত-বঞ্চিত, অবহেলিত ও সাধারণ মানুষের মুক্তির কথা। বঙ্গবন্ধু সেই পথ বাঙালিকে দেখিয়ে গিয়েছেন। প্রয়োজনে দৃঢ়তার সঙ্গে বিদ্যমান প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করে বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আর্থ-সামাজিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। এই কাজটি তার কন্যা শেখ হাসিনা শুরু করেছেন।

সারা জাতির উচিত তার নেতৃত্বে আস্থা রেখে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ ও জাতি গঠনে কাজ করে যাওয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পিতার কর্মসূচি থেকে বিন্দুমাত্র সরে যাননি। বিশ্ব বাস্তবতার কারণে হয়তো কোনো সময়ে কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে মাত্র। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথেই শেখ হাসিনা এগিয়ে চলেছেন এবং সামনের দিনগুলোতে চলবেন। বঙ্গবন্ধুর সামাজিক ন্যায়বিচারের চিন্তা-চেতনা, ইসলামের ইতিহাসের সামাজিক ন্যায়বিচারের একটা বিষয় আলোকপাত করা জরুরি বলে মনে করি।

সেখানে দেখা গেছে আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক রাসুলুল্লাহ (সা.) সামাজিক ন্যায়বিচারের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, সম্পদের সুষম বণ্টন, জীবন, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পারস্পরিক ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, সমাজের সবার মাঝে সাম্য প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি কার্যাবলির মাধ্যমে তিনি এক শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। এর জন্য তিনি শরিয়তের বিধান যেমন কার্যকর করেন, তেমনি সবাইকে আখিরাতমুখী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করেন। আখিরাতের কঠিন জবাবদিহির ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করেন। এভাবে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি এমন এক শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন, যার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

আধুনিক বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে আমাদের অবশ্যই রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সামাজিক ন্যায়বিচারের দিকে লক্ষ্ করতে হবে এবং এর থেকে শিক্ষা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগকে পুরোপুরি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। কেননা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগকেই এগিয়ে আসতে হয়।

দেশ ও জাতিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সরকারের তিনটি অঙ্গ- শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা অতীব জরুরি এবং সেটি করে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। শাসন বিভাগের আধিপত্য ব্রিটিশ আমল থেকে সুস্পষ্ট এবং সর্বজনবিদিত, যেটি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কোনোদিনই কাম্য নয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করে নয় বরং জাতির পিতার মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তিলে তিলে গড়া স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হওয়া দরকার। তাহলে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সহজসাধ্য হয়।

গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে নেতা নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা সুসংহত করতে হবে, রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের আরও বেশি জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। আধিপত্য বিস্তার রোধে প্রধানমন্ত্রী যে শুদ্ধি অভিযানের সূচনা করেছেন, তাতে সবার সমর্থন জোগানো উচিত। শুদ্ধি অভিযান যাতে আরও দীর্ঘায়িত হয় সে ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকদের সর্বাত্মক একাত্মতা ঘোষণা করে জাতির পিতার গড়া আওয়ামী লীগকে জাতির সামনে একটি গণকল্যাণমুখী রাজনৈতিক দল হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে।

শুধু নিজের আখের গোছানোর রাজনীতি না করে সত্যিকারের রাজনীতিবিদ হয়ে প্রমাণ করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের আধিপত্য বিস্তার নয় বরং বঙ্গবন্ধুর সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী। তাহলে রাজনীতি, রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দল তাদের পুরানো ঐতিহ্য ফেরাতে সক্ষম হবে।

দেশের প্রশাসন বিভাগ, পুলিশ, আইনজীবী, ভূমি অফিস, ডাক্তার, বিচারক, কোর্ট স্টাফ, বিচারপ্রার্থী জনগণ তথা সরকার শুধু দিবস পালন করে ক্ষান্ত থাকলে হবে না। চিন্তা করার সময় এসেছে পুলিশ বিভাগের দীর্ঘকালীন প্রশ্নবিদ্ধ তদন্ত ব্যবস্থা, প্রশ্নবিদ্ধ মেডিকেল রিপোর্ট, জবাবদিহিহীন ওকালতি মোটাদাগে প্রশ্নবিদ্ধ প্রসিকিউশন, দুর্নীতিযুক্ত ভূমি প্রশাসন, আদালতের কর্মচারীদের যোগ্যতার ঘাটতি অর্থাৎ অযোগ্য লোককে নিয়োগ, মামলার সংখ্যা অনুপাতে বিচারকস্বল্পতা এবং স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক সুবিধাবাদী জনগণ দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি, অসততা, অসাধুতা, অনৈতিকতা, লোক ঠকানো, অসময়ানুবর্তিতা ও আইনের অপপ্রয়োগ দিয়েও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। ১৭ কোটি জনগণের জন্য মাত্র ১ হাজার ৭০০ জন বিচারক দিয়ে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে দেশের বিদ্যমান আইন, দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচারপদ্ধতি ও বিচারের সঙ্গে জড়িত সব অংশীজনের (স্টেকহোল্ডার) মানসিক পরিবর্তন অতিব জরুরি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী হোক বদলে যাওয়ার উপযুক্ত সময় এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বছর।

বঙ্গবন্ধু যে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন বা ভাবতেন, তা ক্যাসিনোতে সময় নষ্ট করে, টেন্ডারবাজিতে মনোযোগ দিয়ে, শিক্ষাঙ্গনে হত্যার রাজনীতি করে, কাউকে ’বড় ভাই’ বলে তৈলমর্দন করে বাস্তবায়ন হবে না। সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি ধারণ ও পালন করতে হবে। তাহলে জাতির পিতার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার ভিশন-২০২১ ও ২০৪১ এবং ইলেকশনের সময় ঘোষিত ইশতেহার বাস্তবায়ন হবে, এক কথায় দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

আরও বিশ্বাস করি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনীতিবিদদের হাত ধরেই গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচার শতভাগ নিশ্চিত হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু সব সময় সোচ্চার ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ন্যায়বিচারের কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও সে একজনও যদি হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’

তাই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। প্রতিটি রাষ্ট্রেরই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে দায়-দায়িত্ব রয়েছে। তেমনি জনগণের আস্থার প্রতিও। মামলা-মোকদ্দমা দ্রুত নিষ্পত্তি করে বিচারকে আরও গতিশীল ও জনবান্ধব করতে বিচার বিভাগের দায়ভার রয়েছে।

লেখক: বিচারক, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :