বাড়ির মালিক বলে কথা

শেখ সাইফ, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২০, ১৫:২৮ | প্রকাশিত : ১৮ মার্চ ২০২০, ১৩:৫২

আঙ্কেল বেসিনের নিচের পাইপটা খুলে পড়ে গেছে। বলতেই বললেন, ’খুলে পড়ে গেছে তো আমি কি করব? লাগিয়ে নিন।’ বাসার মালিক আপনি। এসব সমস্যা আপনি দেখবেন না? ‘না। বাসা যখন দিয়েছিলাম। তখন সবকিছু ভালো ছিল। এখন আপনারা ঠিক করে নিবেন। আর বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়য় যেমন বাসা দিয়েছিলাম তেমন বুঝে নেব’।

কথাগুলো আমি ও আমার বাড়িওয়ালার মধ্যে হচ্ছে। বর্তমান বাসাতে প্রায় পাঁচ বছর আছি। নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করি। এছাড়া ভবনের দশটি ফ্লাটের একটি ফ্লাট আমার ভাড়া নেওয়া। প্রতিমাসে ভবনের যেসব কাজ করা হয় যেমন- ভবনের সিঁড়ির জন্য লাইট, ঝাড়ু, পানির মটর পরিষ্কার করলে, মশার স্প্রে করলে, পানির ট্যাংক পরিষ্কার করলে এমন আরো অনেক খরচ আছে। যা প্রতি ফ্লাটের কাছ থেকে সমান ভাগ করে নেওয়া হয়।

আবার বছর গেলে ভাড়া বাড়ানোর তোড়জোড়। এদিকে দারোয়ানের ভাড়া। পানির মটর বিল, ওয়াসা বিল, ভবনের বিদ্যুৎ বিল, দারোয়ারের রান্নার জন্য গ্যাসের চুলার বিল, ভবনের সিঁড়ি ঝাড়ু দেওয়ার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত লোকের বেতনের অংশও প্রতি ফ্লাট থেকে সমান ভাবে ভাগ করে পরিশোধ করতে হয়। এমন আরো অনেক বিল সব মেনে নিয়েই বাসাটিতে আছি।

কিন্তু বাসার কোনো কিছুর সমস্যা বাসার মালিকের কাছে বললে সোজা কথা ‘নিজের খরচে ঠিক করেন নিবেন। আর না পোষালে বাসা ছেড়ে চলে যান।’

উনি বাসার মালিক হয়েছেন বলে এতো ঘাড় তেড়ামী ! ভাড়াটিয়াদের কী মনে করেন বাসার মালিকগণ ?

বাসার মালিকের কথা হচ্ছে- বাসা যখন ভাড়া নিয়েছিলেন তখন যেমন বাসা নিয়েছিলেন চলে বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় ঠিক একই রকম বাসা রেখে যাবেন। বাসার মালিক তো বাসার উন্নয়নের কাজ মাঝে মাঝে করবেন এটাই তো নিয়ম। তার যুক্তি আগেকার দিনে বাসার মালিকেরা এসব কাজ করে দিতেন। এখনকার নিয়ম হলো ভাড়াটিয়া নিজ খরচে সব ঠিক করবেন।

আচ্ছা এই নিয়ম কী সরকার থেকে আইন করে করা হয়েছে? নাকি নিজের ইচ্ছেমত ভাড়াটিয়া পরিষদ গঠন করে এটা করা হয়েছে। এর জন্য কী কোনো ব্যবস্থা থাকতে পারে না? মগের মুল্লুক নাকি ব্যাপারটা?

আর একটি ঘটনা বলি তাহলে বুঝতে পারবেন। বাসার মালিকের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন। ২০১৫ সালের শুরুর দিকে আমি একটি বাসায় এক রুমে উঠেছিলাম। আমার কর্মস্থল ছিল পুরানা পল্টনে। একটি অনলাইন টেলিভিশনের কাজ করি। সমস্যা হলো রাত ৯টার নিউজ শেষ করে আমাকে অফিস থেকে বের হতে হত। প্রতিরাতেই অফিস শেষে বাসায় পৌঁছাতে রাত সাড়ে দশটা থেকে পৌনে এগারোটা বেজে যেত।

এই বাসায় ওঠার শুরুতেই বাড়ির মালিক আমার সব তথ্য নিয়েই ভাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যা বাধল বাসায় ফেরা নিয়ে। রাত সাড়ে দশটার এক মিনিট দেরি হলেও উনি আর গেট খুলবেন না। গেটের চাবি চাইলেও দিবেন না। একদিন বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। বাসায় এসে পৌঁছাতে ১০টা বেজে ৪০ মিনিট হয়ে গেছে। আমি ভিজে যাচ্ছি। বাড়ির মালিককে বার বার কল দিয়েও তিনি গেট খুলেন না। পরে অনেক অনুরোধ করে বাসায় ঢুকেছি। আর তিনি সেদিনই বলে দিয়েছিলেন আগামী মাসে বাসা ছেড়ে দিবেন।

এরকম আরো ঘটনা আছে। যায় হোক। বাসার মালিক হলে কী মনুষ্যত্ব বাদ চলে যায়? নাকি বাসার মালিক মানে উনি আর সাধারণ মানুষ নন। বাসার মালিকদের তখন তো দুই হাত-পায়ের জায়গায় চার হাত চার পা গজায় না। দেখতে তো আমাদের মতই সাধারণ মানুষের মতই দেখায়। তাহলে দৃষ্টিভঙ্গি এতো নিচু কেন?

অথচ ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১’ এ বাড়িভাড়া-সংক্রান্ত জটিলতা এড়াতে এবং বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়া উভয়ের স্বার্থ সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১’-এ, যা উভয় পক্ষের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। বাড়িভাড়া-সংক্রান্ত জটিলতা এড়াতে কয়েকটি করণীয় হলো-

চুক্তি সম্পাদন: বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে একটি চুক্তিনামা সই হবে, যাতে চুক্তির মেয়াদ, বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়ার নাম, ঠিকানা ও উভয় পক্ষের মোবাইল নম্বর উল্লেখ করতে হবে। ভাড়ার পরিমাণ, মাসে কত তারিখের মধ্যে তা পরিশোধযোগ্য, পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ বিল, অন্যান্য সেবা থাকলে তার চার্জ ইত্যাদিও চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। জামানত থাকলে তা প্রতি মাসে ভাড়ার সঙ্গে সমন্বয় হবে, নাকি বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার সময় এককালীন ফেরতযোগ্য-সে বিষয়টিও স্পষ্ট করতে হবে।

বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে যে চুক্তিই হোক না কেন, তা ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লিখিতভাবে করতে হবে।

মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ: ১৯৯১ সালের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা-৭ মতে, কোনো বাড়ির ভাড়া মানসম্মতের অধিক হলে তা কোনোভাবেই আদায়যোগ্য হবে না। ‘মানসম্মত’ বলতে যৌক্তিক ও উপযুক্ত ভাড়ার কথা বলা হয়েছে। ১৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, ভাড়ার বার্ষিক পরিমাণ সংশ্লিষ্ট বাড়ির বাজারমূল্যের শতকরা ১৫ ভাগের বেশি হবে না।

রসিদে ভাড়ার আদান-প্রদান: সব বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়াকে ভাড়ার বিপরীতে লিখিত রসিদ দিতে বাধ্য। এই রসিদ নির্ধারিত ফরমে সই করে ভাড়াটিয়াকে দিতে হবে। রসিদ সম্পন্ন করার দায়দায়িত্ব বাড়িওয়ালার। রসিদ দিতে ব্যর্থ হলে ভাড়াটিয়ার অভিযোগের ভিত্তিতে বাড়িওয়ালা আদায়কৃত টাকার দ্বিগুণ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এক মাসের বেশি অগ্রিম ভাড়া নয়: কোনো বাড়ি ভাড়া দিতে চাইলে বাড়িওয়ালা এক মাসের ভাড়ার বেশি টাকা অগ্রিম হিসেবে নিতে পারবে না।

প্রয়োজনে বাড়ি মেরামত করবে মালিক: বাড়িওয়ালা বাড়ি মেরামত করতে বাধ্য। শর্তানুসারে বাড়িওয়ালা যদি বাড়ি মেরামত না করে, তাহলে ভাড়াটিয়া ভাড়া নিয়ন্ত্রকের কাছে আবেদন করতে পারবে।

বাড়িওয়ালা চাইলেই উচ্ছেদ নয়: চুক্তি অনুযায়ী ভাড়া পরিশোধ করে থাকলে ভাড়াটিয়াকে হঠাৎ করে উচ্ছেদ করা যায় না। চুক্তিপত্র না থাকলে যদি কোনো ভাড়াটিয়া প্রতি মাসের ভাড়া পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে পরিশোধ করে, তাহলেও ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে না। যুক্তিসংগত কারণে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করতে চাইলে যদি মাসিক ভাড়ায় কেউ থাকে, সে ক্ষেত্রে ১৫ দিন আগে নোটিশ দিতে হবে। ভাড়াটিয়া নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করা অবস্থায় যদি বাড়িওয়ালা তাকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করে, তাহলে আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার ভাড়াটিয়ার রয়েছে।

যেসব কারণে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে: বাড়িওয়ালা বেশ কিছু কারণে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করতে পারে। তা হলো-ভাড়ার সময়সীমা নির্ধারিত থাকলে। বাড়িওয়ালার অনুমতি ছাড়া বাড়ির নকশা পরিবর্তন করলে কিংবা ভাড়াটিয়া স্বত্ব অন্য লোকের কাছে হস্তান্তর করলে অথবা সাবলেট দিলে। ভাড়া বাকি থাকলে। কোনো উৎপাত বা ক্ষতিকর কাজ করলে।

ভাড়া বাড়ানো: বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৬ ধারায় বলা হয়েছে, মানসম্মত ভাড়া কার্যকর হওয়ার তারিখ থেকে দুই বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। দুই বছর পর মানসম্মত ভাড়ার পরিবর্তন করা যাবে।

বাস উপযোগী বাসস্থান: বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২১ নম্বর ধারা অনুযায়ী, বাড়ি মালিক তার বাড়ি বসবাসের উপযোগী করে রাখতে আইনত বাধ্য। বাড়ির মালিক ইচ্ছা করলেই ভাড়াটিয়াকে বসবাসের অনুপযোগী বা অযোগ্য অবস্থায় রাখতে পারে না। ভাড়াটিয়াকে পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ সরবরাহ,পয়োনিষ্কাশন ইত্যাদি সুবিধা প্রদান করতে হবে।

ঢাকাটাইমস/১৮মার্চ/এসএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :