সম্বোধন সমস্যা, আপনি তুমি তুই

মুনিরা পারভীন
  প্রকাশিত : ২০ জুলাই ২০২০, ১৪:২১
অ- অ+

তিরস্কৃত হয়েছি বহুবার, ভর্ৎসনাও জুটেছে কপালে। তিরস্কার এবং ভর্ৎসনা করেছেন আমার অতি আপনজন, আমার প্রিয়জনেরা - যেমন আমার কন্যারা। বিষয়টি তেমন কিছু নয় - এই ‘আপনি’ ‘তুমির’ সম্বন্ধ নিয়ে। গত বছর ঢাকায় আমার কন্যাগৃহে তার পঞ্চদশ-বর্ষীয় যে মেয়েটি গৃহকার্যে সাহায্য করে, তাকে ‘আপনি’ বলায় তো আমার কন্যা যারপর নাই রেগে গিয়েছিল। ‘হয়েছে কি তোমার? ওর বয়স মাত্র পনেরো।’

বুঝেছিলাম তার তিরস্কারের কারণ। বাংলা ভাষায় ‘আপনি’, ‘তুমি’ ও ‘তুই’ এর একটা ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগ আছে। তার একটা দিক বয়ো:সম্পৃক্ত। বয়সে যারা জৈষ্ঠ্য, তাঁদেরকে ‘আপনি’ বলতে হবে; ‘তুমি’ বলা যায় তাঁদেরকেই, যাঁরা সমসাময়িক, বন্ধুস্হানীয়, বয়োকণিষ্ঠ; আর যারা বয়সে খুব ছোট, তাদেরকে ‘তুই’ বলা যেতে পারে।

কিন্তু এ সম্বোধন-বিন্যাসের আরেকটি প্রেক্ষিত আছে। সেটি অবশ্য সম্পৃক্ত শ্রেণি-বিভাজনের সঙ্গে। তাই দরিদ্র ও নিম্নস্হানীয় শ্রমজীবী মানুষদের অবলীলাক্রমে আমরা ‘তুই’ বা ‘তুমি’ বলি - যদিও বয়সে তাঁরা আমাদের চেয়ে অনেক বড় হন। সে জন্য বৃদ্ধ রিক্সাচালককেও তরুন যাত্রী ‘তুমি’ বলে, আবার গৃহস্বামীর কিশোরী কন্যা বয়স্ক গৃহপরিচারিকা কতৃক ‘আপনি’ বলে সম্বোধিত হয়। অন্যদিকে, ক্ষমতাবান আর বিত্তবানদের ‘তুমি’ বলতে আমাদের বাধে, কারন তাঁরা সমাজ কাঠামোয় উচ্চশ্রেণির। তাই তরুণ ক্ষমতাধর বিত্তবান তরুণকেও বর্ষীয়ান ব্যক্তিরা ‘ আপনি’ বলেই সম্বোধন করেন।

আমার ‘আপনি’ ‘তুমি’, ও ‘তুই’ সম্বোধনের তিনটে প্রেক্ষিত আছে। প্রথমত: আমি সম্বোধনের বিভাজন-বিন্যাস নির্ণয় করি সম্পর্কের নৈকট্য ও গভীরতা দিয়ে। তাই সাধারণত: আমি ‘আপনি’ দিয়ে শুরু করি ছোট/ বড় সবাইকে। তারপর জানাশোনা ও নৈকট্য গভীর হলে আমার সম্বোধন ‘আপনি’ থেকে ‘তুমিতে‘ নেমে আসে। আর আমার মুখে ‘তুই’ ডাকটি মুষ্টিমেয় ক’জন অতি প্রিয়জনের জন্যে।

দ্বিতীয়ত: আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি যে একজন পূর্ণবয়ষ্ক মানুষকে ‘আপনি’ বলব না ‘তুমি’ বলব - সেটা তাঁর অনুমোদন সাপেক্ষ। সুতরাং আমি সেই সর্বোচ্চ ‘আপনি’ দিয়েই শুরু করি। তারপর যদি সে সম্বোধিত ব্যক্তিটি আমাকে বলেন, ‘আপনি আমাকে ‘তুমি’ বলে ডাকলেই আমি খুশি হবো’, শুধু তখনই আমি তাঁকে ‘তুমি’ ডাকি। আমার মনে হয় এ অনুমতি ব্যতিরেকে কাউকে সরাসরি ‘তুমি’ বলাটা ঠিক নয়।

তৃতীয়ত: যেহেতু ‘আপনি’ ডাকটি সম্মানবোধক, কোন নিম্নস্হানীয় শ্রমজীবী মানুষকে আমি ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটুকু সম্মান তাঁদের প্রাপ্য - সেখানে আমি আপোষহীন। এটা আমার ‘গর্বের’ বা ‘আত্মতৃপ্তির’ বিষয় নয়, এটা তাঁদের ‘সম্মানের’ বিষয়।

ইদানীং সময়ে আমার এই ‘আপনি-তুমির’ সমস্যা অন্য একটি মাত্রিকতা পেয়েছে। এতেদিন এ ব্যাপারে শুধু অতি প্রিয়জন দ্বারা তিরস্কৃত ও ভর্ৎসিত হয়েছি। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনুযোগ - আমার এক সময়ের শিক্ষার্থী ও তরুণ শুভ্যানুধায়ীদের দ্বারা। প্রাক্তন শিক্ষককে অনেকেই স্মরন করিয়ে দেন, ‘স্যার, আমি আপনার ছাত্র ছিলাম। আমাকে তুমিই বলবেন’।

কোনো কোনো তরুণ শুভানুধ্যায়ী লেখেন, ‘তুমি বললেই প্রীত হই, আপনি আমাদের নমস্য’। কেউ কেউ আবার অনেকটা অবাক এবং বিরক্তি মেশানো স্বরে বলেন, “আপনি আমাকে ‘আপনি’, ‘আপনি’ করছেন কেন?”

এ দু’গোষ্ঠীর সবাইকে প্রতিশ্রুতি দেই যে, তাঁদের আমি এবার থেকে ‘তুমিই’ বলব। কিন্তু তারপর আর মনে থাকে না কাকে কাকে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। যে আমার ভুলো মন আর যা আমার দুর্বল স্মৃতিশক্তি! সুতরাং আবার শুরু হয়ে যায় আমার ‘আপনি-তুমির’ ভজঘট! এবং সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে অনুযোগ।

আমার ইংরেজ বন্ধু পল রবিন্স্ প্রায়ই তাঁর জীবনের নানান সমস্যার কথা বলে - বলেই যায় বলা চলে। বোধহয় আমার মতো এতো অখন্ড মনোযোগী শ্রোতা সে আর জীবনে পায় নি। পলের গল্প শুনতে শুনতে আমার এক ধরনের ঈর্ষাও হয় - মনে হয় বেঁচে গেছে সে। পড়ত ‘আপনি-তুমি-তুইয়ের’ জটাজুটে, বুঝতো তা’হলে ‘কত ধানে, কত চাল’!

লেখক: আবৃত্তি শিল্পী ও সংবাদ পাঠক

ঢাকাটাইমস/২০জুলাই/এসকেএস

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
আজ থেকে দেশে স্বর্ণ বিক্রি হবে নতুন দামে
উত্তরায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ওপর উঠে গেল ট্রাক, নিহত ৩
ফরিদপুরে ১১৪ বোতল ফেন্সিডিলসহ দুই মাদক কারবারি গ্রেপ্তার
বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে রিভিউ আবেদনের আদেশ স্থগিত
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা