রিজার্ভে জোয়ার: স্বস্তির নিশান, না ক্ষণিক ঝলক?

মো. সাইফুল ইসলাম মাসুম
  প্রকাশিত : ২৯ জুন ২০২৫, ০৯:৪৬
অ- অ+

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও পেরিয়েছে ৩০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে এমন অর্জন নিঃসন্দেহে স্বস্তিদায়ক, তবে এই উল্লম্ফনের আড়ালে প্রশ্নও রয়ে গেছে—এটি কি দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার পূর্বাভাস, না কি কিছু ইতিবাচক খবরে সৃষ্ট ক্ষণিক ঢেউ?

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, ২৬ জুন ২০২৫ তারিখে দেশের মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) নির্ধারিত হিসাবপদ্ধতি, অর্থাৎ 'ব্যালান্স অব পেমেন্টস ম্যানুয়াল ৬' (BPM6) অনুসারে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দাঁড়ায় ২৫ দশমিক ৫১ বিলিয়নে। এর মধ্যেও তাৎক্ষণিক বৈদেশিক লেনদেন, দায় পরিশোধ ও আমদানির জন্য ব্যবহারযোগ্য অংশ, অর্থাৎ নিট রিজার্ভ, বর্তমানে ১৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়ে আছে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুর দিকেই প্রবাসী আয় অভূতপূর্ব গতিতে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে, যেখানে গত অর্থবছর শেষে তা ছিল ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের এই প্রবাহ নিঃসন্দেহে রিজার্ভ বৃদ্ধির পেছনে প্রধান চালিকাশক্তি।

এ বৃদ্ধি শুধু অর্থনৈতিক নয়, মনস্তাত্ত্বিকও বটে। রাজনৈতিক অস্থিরতার আবছায়া কেটে যাওয়ায় প্রবাসীদের মধ্যে ফের একপ্রকার আস্থা ফিরেছে বৈধ চ্যানেলে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে। হুন্ডির বিরুদ্ধে প্রশাসনিক কঠোরতা, বৈধ পথে প্রণোদনা অব্যাহত রাখা, এবং ডিজিটাল ব্যাংকিং সহজলভ্যতা—সব মিলিয়ে একটি স্বচ্ছ, গতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

গত ১০ মাস ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেনি। এটি একদিকে যেমন রিজার্ভে চাপ কমিয়েছে, অন্যদিকে বাজারে বিনিময় হারের ভারসাম্য রক্ষায় নতুন কৌশলেরও প্রয়োজন সৃষ্টি করেছে।

রিজার্ভ বৃদ্ধির আরেকটি উৎস হলো বৈদেশিক ঋণ। বিশ্বব্যাংক, এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (AIIB), জাপান, ওপেক ফান্ডসহ একাধিক উন্নয়ন সহযোগী জুন মাসেই প্রায় ৯০ কোটি ডলার ছাড় করেছে। আরও ২৪০ কোটি ডলার আসার সম্ভাবনা রয়েছে, যা সম্মিলিতভাবে রিজার্ভে নতুন শক্তি যোগ করবে।

এই ঋণগুলো স্বল্পসুদে এবং দীর্ঘমেয়াদে গৃহীত, যার ফলে তাৎক্ষণিক চাপ সৃষ্টি করছে না। বাজেট বাস্তবায়ন, ব্যাংকিং খাত সংস্কার, ও রাজস্ব ব্যবস্থার উন্নয়নে এসব অর্থ ব্যয় করার পরিকল্পনা থাকলেও প্রশ্ন থেকে যায়—এই সহায়তা আমাদের সক্ষমতা গঠনের সহায়ক, না ভবিষ্যতের এক জটিল দায়?

২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানিতে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। তৈরি পোশাক, কৃষিপণ্য ও চামড়া খাত কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে, যা মোট রিজার্ভে ভূমিকা রেখেছে। তবে রপ্তানির গড়মান, নির্ভরতা মূলত গার্মেন্টস পণ্যের ওপর, এবং উদ্ভাবনের অভাব—এই সীমাবদ্ধতাগুলো এখনও বিদ্যমান।

এই রিজার্ভ অর্জন যতোই প্রশংসনীয় হোক, বাস্তবতা হলো—দেশের আমদানি ব্যয় আবার বাড়ছে, বৈদেশিক ঋণের কিস্তি শোধের সময় ঘনিয়ে আসছে, এবং বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম অস্থির। এর মাঝে মুদ্রানীতি ও রাজস্ব আহরণ কাঠামোতে সংস্কার ছাড়া এই অর্জন ধরে রাখা কঠিন হবে।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বর্তমান বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হলেও, এটি যেন আত্মতুষ্টির না হয়। বরং এই অর্জন হোক ভবিষ্যতের ভিত্তি গঠনের সূচনা বিন্দু।

কৌশলগত সুপারিশ:

- রপ্তানির বহুমুখীকরণ ও প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদনে বিনিয়োগ।

- প্রবাসী আয়ের ধারা বজায় রাখতে হুন্ডি রোধ ও ব্যাংকিং পদ্ধতির আধুনিকায়ন।

- ঋণ সহায়তার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা।

এই তিনটি ক্ষেত্রে সুসংহত কৌশল নিলে, রিজার্ভ হবে শুধু সংখ্যায় বড় নয়—অর্থনীতির ভিতেও দৃঢ়।

(এই বিশ্লেষণ লেখকের ব্যক্তিগত মতামত)

লেখক: অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিশ্লেষক

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
১৬ জুলাই ‘জুলাই শহীদ দিবস’ ও ৫ আগস্ট ‘গণঅভ্যুত্থান দিবস’পালিত হবে
বগুড়ায় বোট ক্লা‌বের লেক থেকে ঢা‌বির সা‌বেক শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার  
ক্ষমতায় এসে শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে: রিজভী
আশাব্যঞ্জক অগ্রগতির ক্ষেত্রে আমরা খানিকটা পিছিয়ে আছি: আলী রীয়াজ
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা