উপন্যাস

প্রথম প্রেমের স্পর্শ: পর্ব ৫-অজানা শহরে তাঁর দেখা

এম এম মাহবুব হাসান
  প্রকাশিত : ২৯ জুন ২০২৫, ১২:০২
অ- অ+

শীতের শেষ প্রান্তে একটা একাকী সন্ধ্যা। আমি তখন চট্টগ্রামে—এক সাহিত্য সম্মেলনে অতিথি হয়ে গেছি। পুরোনো শহরের ভিতরে নতুন কিছু মুখ, খানিকটা অচেনা কোলাহল, কিছু আলোকচিত্রে বন্দি প্রশংসা—সব মিলিয়ে যেন একটা অপরিচিত চেনা আয়না। সম্মেলনের শেষ দিনে কিছু পুরস্কার, কিছু সংবর্ধনা, কিছু বই সইয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমি ক্লান্ত, বিব্রত এবং বেশ খানিকটা নিঃসঙ্গ হয়ে ফিরছিলাম হোটেলে।

রাস্তায় হঠাৎ করেই চোখে পড়ল—একটা অস্থায়ী বইয়ের স্টল, বাঁশের পাটাতনে সাজানো মেলা। রাতের আধো আলোয় সেখানে হালকা সুর বাজছে, আর বাতাসে শীতের মৃদু কুয়াশার গন্ধ। অনেকটা এড়িয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি, তবুও কেন যেন পা থেমে গেল। কেমন যেন একটা অদৃশ্য টান আমার চলার গতিকে শ্লথ করে দিল।

আমি ধীরে ধীরে ভিতরে ঢুকে গেলাম। বই দেখছিলাম, মানুষ দেখছিলাম, এমন সময় এক আশ্চর্য গন্ধ আমার নাকে এলো। এটি কোনো সুগন্ধি নয়, কোনো পারফিউমের গন্ধও নয়—একটি পরিচিত স্মৃতি। আর সেই স্মৃতির নাম—নীলা।

চোখ আটকে গেল একটা টেবিলের পাশে দাঁড়ানো এক নারীর ওপর। হালকা বাদামি শাল জড়ানো, খোলা চুল, চোখে চশমা, হাতে একটা নোট। মুখের রেখায় সময়ের ছাপ স্পষ্ট, তবু সেই পুরোনো তীক্ষ্ণতা অটুট। আমার বুকের ভিতর হঠাৎ কেঁপে উঠল, যেন কেউ ছায়ার মতো হৃদয়ে এসে দাঁড়িয়েছে।

আমি অবচেতনেই এগিয়ে গেলাম। খুব কাছ থেকে ওকে দেখলাম—একটুও বদলায়নি। শুধু মুখটা কিছুটা অন্যমনস্ক, চোখের তলায় ক্লান্তির ছাপ।

আমাদের চোখে চোখ পড়ল। সময় থমকে গেল। যেন পুরোনো কোনো ফ্রেমে বন্দি হয়ে গেল পুরো দৃশ্যটা।

ও কিছু বলল না। আমিও না। তারপর মৃদু হেসে আস্তে করে বলল,

— “তমাল… এত বছর পরও তুমি হঠাৎ কোথা থেকে এসে দাঁড়াও। ঠিক আগের মতোই।”

আমি হালকা হাসলাম। বললাম,

— “তুমি চলে গেলে, আর আমি থেমে রইলাম। এখন মনে হয়—কেউ পুরোপুরি চলে যেতে পারে না, কেউ পুরোপুরি থেমেও থাকে না।”

ও হেসে ফেলল। সেই পুরোনো হাসি, চোখের কোণে আলতো ভাঁজ পড়ে। বাম চোয়ালে হাসির সেই টোলটা এখনও পড়ে।

— “তুমি এখনও কবিতা লেখো?”

আমি বললাম,

— “তোমার জন্য নয়। কবিতা এখন শুধু আমার অভ্যাস, আমার মনের খোরাক, তোমাকে হারিয়ে টিকে থাকার যুদ্ধ।”

ও চুপ করে রইল। আমাদের চারপাশে লোকজন, হালকা আলো, শব্দ—তবু এক ধরনের নীরবতা আমাদের দু’জনকে ঘিরে ধরেছে। যেন কারও মুখ থেকেই আর কথা ফুটছে না।

আমি আবার বললাম,

— “তুমি এখন কোথায় থাকো?”

ও বলল,

— “ঢাকা থেকে খানিকটা দূরে। একটা আবাসিক স্কুলে পড়াই। বাচ্চাদের নিয়ে থাকি। ওদের সঙ্গে নিজের মতো করে সময় কাটাই। মাঝে মাঝে মনে হয়, মানুষ যদি খুব বেশি ভালোবেসে ফেলে কাউকে, তাহলে জীবনের সহজ পথ হারিয়ে ফেলে। এই আরকি—সব মিলিয়ে টিকে আছি।”

আমি বললাম,

— “ভালোবাসা কখনও হারায় না নীলা, কারণ ভালোবাসা কোনো সহজ বিষয় নয়। ভালোবাসা হয় শরীরের ভাষায় লেখা, নয়তো তা নীরবতায় হারিয়ে যায়।”

ওর চোখে তাকিয়ে বললাম—

— “তুমি জানো, আমি সেই দিনের পরে আর কিছু লিখিনি যা তোমাকে ছুঁয়ে যেতে পারে। সব শব্দ যেন ভোঁতা হয়ে গেছে।”

ও আমার হাত ছুঁয়ে বলল,

— “আমার অনেক ইচ্ছে ছিল—তুমি একদিন জোর করে আমাকে ধরে রাখবে। আমাকে ছাড়তে দেবে না। কিন্তু তুমি খুব ভদ্র ছিলে, তমাল। এত বেশি ভদ্র ছিলে যে, আমি ভেঙে পড়ার আগেই পালিয়ে যেতে পেরেছি।”

ওকে দেখার পর থেকেই আমার চোখ ভিজে উঠছিল, কিন্তু মুখে ছিল এক নীরব হাসি।

ঠিক তখনই ওর পাশে এসে দাঁড়াল একটি ছোট্ট মেয়ে—বয়স সাত-আট। দেখতে কিছুটা নীলার মতোই লাগে। কাঁধে একটা ছোট ব্যাগ, চোখে বেশ কৌতূহল। মেয়েটি নীলার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল।

নীলা মেয়েটির কাঁধে হাত রাখল।

— “ও আমার শিক্ষার্থী। কিন্তু আমাকে মা বলে ডাকে। ওর পরিবারে কেউ নেই…”

আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। মনে হলো, যেন নীলা নতুন করে আবার কাউকে ভালোবাসছে—কিন্তু এবার নিঃশর্তভাবে, বিনিময় ছাড়া।

আমি বললাম,

— “তুমি কি সুখী, নীলা?”

সে এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,

— “সুখ খুব অনিশ্চিত জিনিস, তমাল। আমি সুখ কী তা ভালো বুঝি না, তাই এখন আমি শুধু শান্তির খোঁজে আছি।”

আমরা আরও কিছুক্ষণ কথা বললাম। এমন সব কথা, যেগুলো আগে বলা হয়নি, এমন কিছু প্রশ্ন, যেগুলোর উত্তর জানার দরকার ছিল না।

শেষবার যখন ওর দিকে তাকালাম, তখন মনে হলো—ওর চোখে একটা চাপা আলো, একটা পুরোনো আলো, যেটা একদিন আমাকে পথ দেখিয়েছিল। ওর চোখ চিকচিক করছিল, তবু হাসিটা মুখে ছিল।

আমি বললাম—

— “তুমি এখনও ঠিক আগের মতোই আছো, নীলা… নিঃশব্দ এক আলো… যার দিকে তাকালে চোখ ভিজে যায়।”

ও কিছু বলল না। শুধু একটু মাথা নাড়ল। মেয়েটির হাত ধরে ও ধীরে ধীরে চলে গেল।

আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। বাতাসে ওর শালের গন্ধ মিলিয়ে গেল রাতের কুয়াশায়।

হোটেলে ফিরে এসেও আমি বিছানায় বসে ছিলাম অনেকক্ষণ। জানালার ফাঁক গলে সমুদ্রের নোনতা বাতাস ঢুকছিল। দূরের কুয়াশা ঢাকা পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে মনে হলো—প্রথম প্রেম কখনও ফুরায় না। সে থেকে যায়, ছায়ার মতো, চোখের পেছনে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে।

এই শহরটা হঠাৎ করে আমার খুব চেনা লাগছিল। যেন এখানে কেউ ছিল, কেউ আছে—যার স্পর্শ নেই, তবু উপস্থিতি আছে।

আমার মনে পড়ছিল সেই সব দিন—নীলার হাসি, তার অভিমান, আর এক শীতের সন্ধ্যায় বলা সেই বিদায়ের কথা। মনে হচ্ছিল, সেই দিনের ছায়া আজও টেনে নিয়ে এসেছে আমাকে এখানে, এই স্টলের সামনে, এই সন্ধ্যায়, এই আলোয়।

সন্ধ্যার সেই মুহূর্তের জন্য আমি হয়তো সারাজীবন অপেক্ষা করছিলাম।

অথবা, এটা ছিল আমার একান্ত চাওয়া—যে আমি ওকে আরেকবার দেখতে চাই, ঠিক এমন করেই—একটা অপরিচিত শহরের বইমেলায়, কুয়াশা মেশানো আলোয়, নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়।

ওর চলে যাওয়ার পর হঠাৎ মনে হলো—কিছু গল্প সত্যিই শেষ হয় না। তারা কেবল রূপ বদলায়। প্রথম প্রেম যেমন শেষ হয় না, সে কেবল গভীর হয়, বিষণ্ণ হয়, তেমনি কখনও কখনও—সে হয়ে ওঠে নিঃশব্দ অনুতাপ।

রাত গভীর হচ্ছিল। জানালার বাইরে সমুদ্রের ঢেউ যেন আস্তে আস্তে বলে যাচ্ছিল, “সে এখনও আছে… অন্য কোনো আকারে… অন্য কোনো রূপে…”

আমি জানি, এই গভীর অনুভব আমাকে আবার লিখতে বাধ্য করবে। আবার হয়তো আমি ওকে নিয়ে লিখব—কোনো গল্পে, কোনো কবিতায়, কিংবা এমন এক পর্বে, যেখানে কেবল নীরবতা কথা বলে।

(চলবে)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
মহাসড়কের পাশে পলিথিনে মোড়ানো এসিডদগ্ধ নারী উদ্ধার  
ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত
শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের ৩৯৬তম সভা অনুষ্ঠিত
৮ আগস্ট ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ পালন করা হবে না
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা