প্রথম প্রেমের স্পর্শ: পর্ব ৪- জীবন আঁধারে তাঁকেই খুঁজি

গত কয়েক মাস ধরে মায়ের শরীরও তেমন একটা ভালো যাচ্ছে না। বাবার মৃত্যুর সময় আমার বয়স ছিল মাত্র নয় বছর। সেই সময় মা ছিলেন ঠিক যেন এক যুবতী নারী—গড়নে ছিপছিপে, মুখে অপার্থিব জ্যোতি। বাবাকে হারিয়ে মায়ের ভেতর যেন সবকিছু চিরতরে ঝরে পড়ে। শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। তবু মা আমাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছেন, সেই প্রাগৈতিহাসিক ভালোবাসার টানে।
দাদীর মুখে শোনা, মা-ই নাকি প্রথম বাবাকে পছন্দ করেছিলেন। একবার নিজেদের বাড়ীর সামনে বাবাকে একা পেয়ে সামনে থাকা লোকজনের মাঝেই জড়িয়ে ধরেছিলেন—যেটা ছিল নির্বাক ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। আর আমার বাবা? লজ্জায় কেবল চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এমনটাই ছিল তার স্বভাব—নম্র, শান্ত, মাটির মতো।
বাবা হিমেল চৌধুরী। তিনি ছিলেন খুবই রুচিশীল ও সুদর্শন। তাঁর গড়ন ছিল ঠিক নায়কের মতো। দাদা বিপুল অর্থ-সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন, কিন্তু বাবা কখনও তা ভোগে আত্মমগ্ন হননি। চাকুরী ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ ছিল দেশ-বিদেশে, কিন্তু সব ছেড়ে দিয়ে দাদার রেখে যাওয়া বিপুল সম্পত্তি দেখাশোনায় মনোযোগী হয়েছিলেন। মা’র পরিবারও ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত—এ যেন দুই সম্ভ্রান্ত হৃদয়ের মহামিলন।
মা জুলেখা বানু। তিনি ছিলেন এলাকার সম্পদশালী রাফায়েল মৃধার একমাত্র মেয়ে। মা তখন দেখতে ছিলেন অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও উজ্জ্বল বর্নের। বাবার অতি আদরে বেড়ে ওঠাতে এলাকার সবার কাছেই পরিচিত মুখ ছিলেন মা। এলাকার যুবক ছেলেরা মাকে খুব ভয় পেতো। একবার এক যুবক মাকে চিঠি লিখে প্রেম নিবেদন করায় মা এমনভাবে তাকে শাসান তা শুনে অন্য যুবকরা আর সামনে পা বাড়াতো না। আর নানাও কিছুটা বদমেজাজী ছিলেন। মা কখনও সাজগোজে আগ্রহী ছিলেন না। সেই চিরকালীন সৌন্দর্য আর সরলতার মিশ্রণে মা ছিলেন বাবার প্রেমের একমাত্র গন্তব্য।
কিন্তু ঐ একটি ঘটনায় সবকিছু বদলে যায়—যখন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে, জুলেখা বানু একদিন কামাল চৌধুরীর ছেলে হিমেল চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরেছেন। তখন আর রক্ষা নেই! নানা রাফায়েল মৃধা তৎক্ষণাৎ বাবা’কে জামাই হিসেবে বেছে নেন এবং আমার দাদীকে খবর পাঠান। এলাকার মধ্যে সুপরিচিত পরিবারের মেয়ে হওয়ায় দাদীও মাকে আগে থেকেই খুব পছন্দ করতেন। শেষমেশ বেশ ধুমধাম করেই বাবা-মায়ের বিয়ে হয়। বিয়েতে আমার নানা পাঁচটি গরু জবাই করে ও প্রায় এক হাজারেরও বেশি বরযাত্রীকে পেটপুরে আপ্যায়ন করেন। বিয়ের পর বাবা হিমেল চৌধুরীর জীবনে তখন যেন এক নতুন স্বপ্নের সূচনা।
লাল টুকটুকে জুলেখা বানুকে বউ হিসেবে পেয়ে হিমেল চৌধুরীর ভেতরে বিরাট পরিবর্তন আসে। সেই লাজুক মানুষটি একলাফে মায়ের প্রেমে অন্ধ হয়ে যান। লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে নতুন বউকে নিয়ে এক প্লেটে ভাত খাওয়া, বউয়ের চুল বেঁধে দেওয়া আরো কতো কি। আর ঘুম থেকেতো উঠতেই চাইতেন না। মাঝে মাঝে নাকি দাদী হেসে বলতেন—“ও হিমেল, ঘুম থেকে ওঠ বাবা, সামনে আরও রাত আসবে।” বাবা যেন সমস্ত সংসার-জীবন ভুলে মায়ের নির্মল সৌন্দর্য ও নয়া প্রেমে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন।
দাদী চাইতেন, বিয়ের পরপরই নতুন অতিথি আসুক ঘরে। তিন মাস পর থেকেই মায়ের জন্য আনতেন পানিপড়া-তেলপড়া। মা চেয়েছিলেন অন্তত দুই বছর পর সন্তান নিতে। কিন্তু দাদীর চাপে এক বছরেই মা অন্তঃসত্ত্বা হন। যেদিন সুখবরটি আসে, সেদিন দাদী পুরো বাড়ি মাথায় করে নাকি আনন্দে চোখের পানি ফেলেছিলেন। মাকে সামান্য পানিও নিজে হাতে ঢেলে দিতেন।
আমার জন্ম যেন নতুন আলো নিয়ে আসে বাবা-মায়ের জীবনে। বাবা আমাকে কাঁধে করে ঘুরতেন, মা আমাকে বুকের মাঝে নিয়ে গল্প বলতেন। আমি মায়ের পাশে ঘুমিয়ে পড়তাম, কিন্তু মাঝরাতে খেয়াল করতাম—বাবা-মা ধীরে ধীরে হাত ধরে অন্য বিছানায় চলে যাচ্ছেন, দুজনে মনে করতেন আমি ঘুমিয়ে পড়েছি।
আজ মায়ের চোখের যখন ক্লান্তি দেখি, তখন ওইসব মুহূর্ত চোখে ভেসে ওঠে। তারা শুধু স্বামী-স্ত্রী ছিলেন না—ছিলেন একে অপরের আত্মার আত্মা।
স্মৃতির ঝাঁপিতে আজও তাজা হয়ে আছে সেইসব মুহূর্ত—যখন বাবা মায়ের কপালে চুমু খেতেন, যখন ঘুমন্ত ভেবে মাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরতেন। সেইসব শব্দ, খুনসুটি, সেইসব কোমলতা আজও আমার ভেতরে বেঁচে আছে। মনে হয়, মা এখনো প্রতিরাতেই সেই আদরের আশায় ঘুমের ভান করেন।
মাঝেমধ্যে খুব মন চায়—বাবা আবার এসে মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরুন, মায়ের চোখে সেই আলোটা আবার ফিরুক, আর আমি ঘুমের ভান করে সব দেখে যাই—নীরবে।
জীবন এখন শুধু দিন গোনা নয়, বরং এক স্মৃতিময় ভ্রমণ, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে ফিরে আসে পুরোনো দৃশ্যাবলি।
এমন এক আবেশময় মুহূর্তে মনে পড়ে গেল নীলার কথা। তার স্মৃতি সবসময় হৃদয়ের এক কোণে জ্বলন্ত প্রদীপ হয়ে জ্বলছে।
দিন যাচ্ছে আর নীলার স্মৃতি আমার কাছে আরো গভীর হচ্ছে। সেই আরেকটি বিকেল এখনো আমার মনে আছে—একটা চিরস্থায়ী স্থিরচিত্রের মতো হৃদয়ে খোদাই হয়ে আছে।
মনে আছে সেই বিকেল, ছুটির দিন ছিল। নীলার ছোট্ট ফ্ল্যাটে জানালার সাদা পর্দা বাতাসে দুলছিল। আমরা দু’জন বসে আছি কফির কাপ হাতে, কিন্তু চুমুক পড়ছে না। চারপাশে গভীর নীরবতা। নিঃশব্দে হৃদয় কথা বলছিল।
নীলার চোখে সেই দীপ্তি ছিল না, যা আগে ছিল। বদলে ছিল বিষণ্ণতা। সে বলল—
“আমরা কি সত্যি কোনো ভবিষ্যৎ ভাবি?”
আমি বললাম—
“তুমি পাশে থাকলে আমি কিছুতেই ভয় পাই না।”
সে আমার দিকে তাকাল—চোখে জমে থাকা এক নদী না বলা কথা।
“তমাল,” সে বলল, “আমি এখন এক যুদ্ধে লড়ছি—পরিবার, সমাজ, ক্যারিয়ার… তুমি আমাকে চাও, কিন্তু পেতে হলে অনেক কিছু হারাতে হবে।”
আমি ওর হাত ধরলাম, ও আমার বুকে মুখ লুকাল। অনুভব করলাম, তার চোখ ভিজে যাচ্ছে।
আমি কানে কানে বললাম—
“তোমাকে হারানো মানে নিজেকে হারানো।”
এরপর থেকেই ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগল সবকিছু। নীলা এক অজানা স্রোতে যেন ভেসে যাচ্ছিল। ফোন ধরত না, মেসেজ দিত না, কণ্ঠস্বর হয়ে পড়েছিল শীতল।
এক সন্ধ্যায় ধানমণ্ডি লেকের পাশে সে বলল—
“তমাল, যদি একে অপরকে ভুলে যেতে পারতাম?”
আমি হতভম্ব—“তুমি কি চলে যেতে চাও?”
সে বলল—
“তোমার ভালো থাকার জন্য আমি নিজেই চলে যাচ্ছি।”
তার চোখে তখন এক নিঃশব্দ বিদায়ের আভাস ছিল।
নীলার সাথে ঘটে যাওয়া টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো আমাকে অসীম ভাবনার জগতে নিয়ে যায় ।
এরই মধ্যে কিছুদিন পর খবর পেলাম—নীলার বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। সেই শোকের মাঝেই তার পরিবার তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দিয়ে দেয় বহুদিনের পছন্দের কর্পোরেট চাকুরিজীবীর সঙ্গে। নীলা কিছু বলেনি, প্রতিবাদ করেনি। সে শুধু চুপ করে মেনে নিয়েছে।
কে যেন বলেছিল—“ও পাথর হয়ে গেছে।”
এই কথা শুনে আমি ভেতর থেকে ধসে পড়েছিলাম।
কয়েক মাস পর এক বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারি—নীলা গর্ভবতী। কিন্তু সে কারো সঙ্গে এ নিয়ে কোনো কথা বলেনি। এমনকি স্বামীও প্রশ্ন তোলেননি।
আমি জানি—সেই রাতের একমাত্র মিলনই ছিল আমাদের শেষ ছোঁয়া।
এই গোপন সত্য জানে শুধু আমি, আর জানে নীলা।
আজ এক বছর হয়ে গেছে। আমি লিখছি—গল্প, কবিতা, উপন্যাস। কিন্তু প্রতিটি লাইনের ভিতরে থেকে যায় সেই অসমাপ্ত গল্প।
একবার বইমেলায় এক পাঠক জিজ্ঞেস করলেন—
“আপনার গল্পগুলো এত কষ্টের কেন?”
আমি হেসে বলেছিলাম—
“কারণ আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর গল্পটার শেষ এখনও হয়নি।”
আজও মাঝেমধ্যে ঘুম ভেঙে দেখি জানালার পাশে জোনাকি উড়ছে। নিঃশব্দ হাওয়ায় অনুভব করি—সে আছে, আমার পাশে, কিন্তু ছুঁতে পারি না।
আমি জানি, সে বেঁচে আছে—এক জীবনের ছায়ায়, এক ভালোবাসার অতল চাহনিতে।
আমি তাকে ভালোবাসি। কোনো দাবি নেই, কোনো অধিকার নেই—তবু ভালোবাসি। কারণ, যাকে একবার হৃদয়ের গভীরে জায়গা দেওয়া হয়, তাকে কখনও হারানো যায় না। সে রয়ে যায়—প্রতিটি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি না-বলা কথায়।
(চলবে)

মন্তব্য করুন