উপন্যাস
প্রথম প্রেমের স্পর্শ: পর্ব ৩- একটি অসমাপ্ত সকাল

সেই রাতে যা ঘটেছিল, তার কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। এখনও যায় না।
না, সেটা কেবল শরীরের খেলা ছিল না। সেটা কোনো প্রচলিত প্রেমিক-প্রেমিকার শারীরিক মেলবন্ধনও ছিল না। সেটা ছিল বহুদিনের জমে থাকা অপেক্ষার নিঃশব্দ বিস্ফোরণ—এক দীর্ঘ ক্লান্তির পর এক ঝলক স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলার মুহূর্ত, যেখানে ভেতরে জমে থাকা অনুভূতিগুলো অবশেষে একে অপরকে ছুঁয়ে বলে উঠেছিল, “আমি আছি, আমি সত্যিই আছি।”
অনেক দিন কেটে গেছে সেই রাতের পর। কিন্তু এখনও মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করলেই মনে পড়ে—সেদিন নীলার ঘরের জানালাটা খোলা ছিল। শহরের হলদেটে আলো এসে পড়ছিল ওর শরীরের ওপর। ওর গালে আমার আঙুলের ছায়া পড়ছিল, আর আমি যেন প্রথমবার ওকে স্পর্শ করছিলাম—শুধু একজন ভালোবাসার মানুষকে নয়, বরং কোনো এক অবিশ্বাস্য স্বপ্নকে।
আমরা দু’জন দীর্ঘ সময় পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম—কোনো শব্দ ছিল না, কেবল নিঃশ্বাসের নিঃসরণ আর হৃদয়ের নিঃশব্দ স্পন্দন। আমি নিজের অজান্তেই ঠোঁট রেখেছিলাম ওর খোলা কাঁধে, বুকের ওপর আমার হাত রেখে ধীরে ধীরে ওর হৃদ্স্পন্দনের ছন্দে নিজের ভেতরের ছন্দ মিলিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। ও আপ্লুত হয়ে তাকে আরো জোরে আলিঙ্গন করার আকুতি করছিল…
রাতের সেই নিঃশব্দ আত্মসমর্পণ যেন ছিল এক গভীর সম্মতির সেতুবন্ধন। সেখানে কোনো দাবি ছিল না, ছিল না কোনো লোভ। ছিল কেবল ভালোবাসার এক অচেনা জোয়ার, দীর্ঘ অপেক্ষার পর পাওয়া এক প্রশান্তি—একটি অসমাপ্ত কবিতা, যেটা বহুদিন ধরে কেবল শুরু হয়েছিল, কিন্তু কোনোদিন শেষ হয়নি।
সেই রাতে আমাদের প্রেমের গহনে যা ঘটেছিল, তার কোনো নির্দিষ্ট নাম নেই—শুধু অনুভূতি আছে, অভিমান-ভাঙা ছোঁয়ার ভাষা আছে। অনেকটা যেন কোনো পুরোনো চিঠি, যেটার শেষাংশ হঠাৎ কোনো ঝড়ে উড়ে গিয়েছিল, আর পরে সেই পাতাটি হঠাৎই খুঁজে পাওয়া গেল।
সেদিন সকালে বিদায় নেওয়ার আগে বেশ কিছু রোমান্টিক মুহূর্ত কেটে যায়, যা আজও হৃদয়কে নাড়া দেয়। কিন্তু পরক্ষণেই ঘটে অন্য এক বিষাদের ঘটনা..
সকালে সূর্য জানালার পর্দা ছুঁয়ে ঘরে আলো ফেলছিল। আমি ধীরে ধীরে উঠে বসি। নীলা তখনও ঘুমিয়ে। ওর মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি—যেমনটা দেখা যায় দীর্ঘশ্বাসে মিশে যাওয়া কোনো স্বপ্নপূরণের ঘুমে। ওর এলোমেলো চুলগুলো থেকে একগোছা চুল বাম কানের কিছুটা আড়াল করেছে—যে কানে গতরাতে আমি ঠোঁট গুঁজে অনেক কিছু বলেছি। ওর বন্ধ মায়াবী চোখজোড়ায় এক নিঃশব্দ হাসি লেগে আছে—যেন স্বপ্নেও আমি ছিলাম। সব মিলিয়ে যেন একটি নিখুঁত কবিতার অবয়ব।
আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে যাই। গ্যাসের চুলোয় কেটলি বসিয়ে দিই, কফির ঘ্রাণে ভরে ওঠে পুরো ঘর। আমি এক কাপ কফি ওর পাশে রেখে আবার এসে বসি। ও ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকিয়ে বলে—
— “তুমি এখনও আছো, তমাল?”
ওর কণ্ঠে ছিল এক নরম উদ্বেগ, ভয়ের ছোঁয়া। আমি বলি—
— “এই সকালে তোমাকে ছেড়ে যেতে মন চায় না, নীলা। কিন্তু যেতে হবে।”
ও আমার হাত ধরে ফিসফিসিয়ে বলে—
— “আমি ভয় পাই, তমাল… আবার ভালোবাসতে, আবার কাউকে বিশ্বাস করতে ভয় পাই। তুমি আমার অনেক গভীরে চলে যাচ্ছো।”
আমি ওর হাত ধরে বলি—
— “ভয় পেলে কি প্রেম থেমে যায়, নীলা? আমি তো নিজের অজান্তেই তোমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। ফিরে যাওয়া এখন আর সম্ভব নয়।”
ও উঠে বসে। চোখের কোণে টলমল জল, কিন্তু ঠোঁটে এক শান্ত হাসি।
— “জানো, আমি এখনও জানি না এই ভালোবাসার শেষ কোথায়। আমি এক অসম্পূর্ণ মানুষ—অতীত, পারিবারিক শৃঙ্খল, সামাজিক চাপ সব মিলিয়ে আমি জড়ানো একটা জীবন। তুমি কি সত্যিই আমাকে মনপ্রাণে.. এই অসম্পূর্ণ আমাকে ভালোবাসো?”
আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলি—
— “ভালোবাসা কখনো নিখুঁত মানুষ খোঁজে না, নীলা। ভালোবাসা খোঁজে সেই ভাঙা হৃদয়, যাকে জোড়া লাগানোর অপেক্ষা করতে ভালো লাগে।”
ও আমার বুকে মাথা রাখে। জানালার বাইরে তখন বাতাসে পাতার মৃদু কাঁপুনি, দূরে কোনো নাম না জানা পাখির ডাক, আর ঘরের ভেতরে আমাদের নিঃশব্দ একতা।
আমি মজা করে বলি—
— “চলো, আজ কোথাও যাই না। এই ঘরটাকেই পৃথিবী বানিয়ে নিই। কথা কম বলব, স্পর্শ বেশি করব।”
ও হালকা করে মাথা নাড়ে। আমি ওর ঠোঁটে হালকা চুমু খাই—খুব সাবধানে, যেন ওর স্বপ্নটা না ভেঙে যায়।
আমরা জানালার পাশে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকি। পৃথিবী তখন চলমান, ব্যস্ত; অথচ আমাদের ভেতর থেমে থাকা এক সকাল।
ও বলল—
— “তমাল, জানো? আমার কখনো জানা ছিল না, শরীর দিয়েও কথা বলা যায়। গত রাত আমার কাছে যেন এক পুনর্জন্ম—আমি আমার শরীরের মধ্যেও তোমাকে খুঁজে পেয়েছিলাম।”
আমি কিছু বলি না। শুধু ওর বাম হাতের আঙুলগুলো নিজের ডান হাতের আঙুলের মধ্যে গেঁথে রাখি। এই আঙুলেই তো একদিন লিখেছিলাম আমাদের প্রথম কবিতা, ছুঁয়েছিলাম প্রথম প্রেম।
কিন্তু প্রতিটি গভীর রাতের শেষে যেমন এক নতুন সকাল আসে, তেমনই সেদিন আমাদের গল্পেও এল এক অসমাপ্ত সকাল।
আমার চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ফোন এল—নীলার কণ্ঠ জড়িয়ে আছে।
— “তমাল, তোমাকে কিছু বলার আছে।”
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম—
— “বলো, কী হয়েছে?”
— “আমার বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। আমাকে এখনই বের হতে হবে।”
আমি বলি—
— “আমি তোমার সঙ্গে যাব, নীলা।”
কিছুক্ষণ চুপ করে ও আঠালো কন্ঠে বলল—
— “না, তমাল। তুমি যেও না। তুমি এখন গেলে সব কিছু জটিল হয়ে যাবে। আমার পরিবার, সমাজ—কেউ প্রস্তুত নয় এখনো।”
আমি কিছুক্ষণ নীরব থাকি। বুকের ভেতর হিমশীতল অনুভব। আমি জানি, নীলা কাউকে সহজে কিছু বলে না—তার চুপ করাটাই সবচেয়ে ভারী ভাষা।
আমি মুহূর্তের মধ্যে ওর বাসার নিচে পৌঁছে যাই। ও ততক্ষণে ব্যাগ গুছিয়ে নিচে নেমে এসেছে। চোখে জল, মুখে অনিশ্চয়তা।
— “তমাল, বাবাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হচ্ছে। আমরা সবাই ওখানেই যাবো।”
কিছুটা থেমে গিয়ে ও সামান্য অস্বস্তি নিয়ে বলতে লাগল—
— “বাবার কপালে যা লেখা আছে তাই হবে। তুমি আমার কথা ভাবো তমাল। আমাকে বলো তো—কাল রাতটা… আজ সকালটা… এগুলো কি শুধুই কিছু মুহূর্ত ছিল? নাকি আমরা সত্যিই কোনো নতুন পথের দিকে হাঁটছি?”
আমি শান্ত গলায় বলি—
— “এটা একটা অসমাপ্ত সকাল, নীলা। হয়তো নতুন শুরুর আগে এক নিঃশব্দ থেমে থাকা, একটি যৌথ যাত্রার প্রস্তুতির সময়।”
ওর কণ্ঠ কাঁপছে, ফোঁটা ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে বুকের উপর পড়ছে- ও হাত দিয়ে চোখ মুছছে..
— “তুমি অপেক্ষা করবে, তমাল?”
আমি কিছু না বলে মাথা নাড়ি। কেবল চোখে চোখ রাখি। সেখানে কোনো অভিনয় নেই, নেই কোনো প্রতিশ্রুতি—শুধু এক ধরনের শান্ত সম্মতি।
নীলা চলে যায়। আমি একা ফিরে আসি নিজ গন্তব্যে।
সন্ধ্যাবেলায় জানালার পাশে বসে থাকি, চোখের সামনে ভাসে সেই সকালের রূপ। জানালা দিয়ে শহরের আলো এসে পড়ছে ঘরের ভেতর। কেবল নেই সেই মুখ, যে মুখে ছিল রাতের অভিমান-ভাঙা চুমু, সকালের ভয় আর ভালোবাসার অপ্রকাশিত ভাষা।
আমার হাতে এখনও ওর স্পর্শের উষ্ণতা লেগে আছে। বুকের ভেতর জমে আছে কিছু না বলা প্রশ্ন, কবিতার কিছু পঙ্ক্তির মতো গভীর অনুভূতি।
ভালোবাসা কখনোই পরিপূর্ণ হয় না।
ভালোবাসা প্রতিটি অসমাপ্ত সকালের ভেতর দিয়ে, একটু একটু করে নিজের পূর্ণতা খুঁজে পায়।
(চলবে)

মন্তব্য করুন