উপন্যাস

প্রথম প্রেমের স্পর্শ: পর্ব ১-নীল জোনাকির আলো

এম এম মাহবুব হাসান
  প্রকাশিত : ২২ জুন ২০২৫, ১১:৪৫
অ- অ+

বর্ষার এক বিকেল। বাতাসে কদমফুলের ঘ্রাণ আর ভেজা মাটির গন্ধে কলেজের মাঠ যেন মো-মো করছে। আকাশে হালকা মেঘের আনাগোনা। বৃষ্টির ফোঁটা ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে কিশোর হৃদয়ের লুকোনো ব্যাকুলতায়। সেই মাঠের ঠিক এক কোণে, একটি মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছেলে। দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন কোনো প্রেমকাব্যের শুরুর দৃশ্য।

মেয়েটির নাম—নীলা।

নীলা মানে শুধুই একটি নাম নয়, সে যেন প্রকৃতির কোনো অপরূপ রূপের ব্যাখ্যা। তার চুলগুলো ছিল কালি মাখা সন্ধ্যার মতো—ঘন, উষ্ণ, আর এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতায় ভরপুর। বাতাসে তার চুলগুলো দুলে উঠলে আমার মনের ভেতরের সব চিন্তা এক লহমায় নিঃশেষ হয়ে যেত। তার চোখ? ঠিক যেন দুটি নীল জোনাকি—মনে হয় জলের নিচে আলো জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে কোনো অজানা তৃষ্ণায়। এমনভাবে তাকাত যে হৃদয় ছাপিয়ে চোখ দিয়েই ছুঁয়ে দিচ্ছে আমাকে।

আমি তমাল। কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কবিতা লেখা ও আবৃত্তি করা আমার নেশা। পড়ালেখার পাশাপাশি যতটুকু সময় পাই, তার বেশিরভাগই কাটে কবিতা লিখে, কখনোবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে।

কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ‘ভালোবাসা’ শব্দটির গভীরতা বুঝতে শুরু করেছি। নিজের ভেতরের ঘুমন্ত সত্তার ক্রমশ জাগরণ টের পাচ্ছি। মাঝে মাঝে নিজের একাকিত্বকেও নতুনভাবে অনুভব করতে শিখেছি। আমার কাছে মাঝে মাঝে মনে হয়, এই বয়সে ভালোবাসা মানে শুধুই হাত ধরা নয়; ভালোবাসা মানে কারও নিঃশ্বাসের শব্দেও নিজের বুকের গতি খুঁজে পাওয়া।

নীলাকে এক পলক দেখার জন্য আমি তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতাম। প্রতিদিন সেই করিডোরে তার পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম, যেখানে দিয়ে নীলা শান্ত পায়ে হেঁটে যায়। তার গায়ের মিষ্টি সুবাস যেন আমাকে বিমোহিত করত, আর তার শারীরিক গড়ন দেখে প্রতিনিয়ত আমার শিরা-উপশিরায় এক রকম উত্তেজনার বিদ্যুৎ খেলে যেত।

তাকে বলার জন্য কত কথা যে মনে মনে সাজিয়ে রাখি, কিন্তু মুখ ফুটে বলার সাহস হয় না। ওকে নিয়ে কত শব্দ বুকের ভেতরে দোলা দেয়, কিন্তু সেগুলো অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে যায়।

হঠাৎ একদিন কলেজের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তির সুযোগ পেলাম। আমি সেই পুরোনো কবিতাটায় নীলাকে মিশিয়ে দিলাম—প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি বিরতিতে ওর মুখচ্ছবি এঁকে ফেললাম নিজের অজান্তেই। কবিতা আবৃত্তি নয়—সে যেন নীলা বন্দনা।

আবৃত্তি শেষে যখন মঞ্চ থেকে নামছিলাম, পেছন থেকে নীলা বলল,

— “তমাল, তোমার কবিতাটা শুনে আমার শরীর আর মন দুটোই ভালো হয়ে গেছে… আবৃত্তিটা সত্যিই অনেক সুন্দর ছিল।”

তার কণ্ঠে ছিল এক ধরনের নরম সুর, অথচ কাঁপন জাগানো স্পর্শ। আমি চোখ তুলে তাকালাম ওর চোখে—সেখানে একটা উষ্ণতা, একটা চাপা ইশারা আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তখনই বুঝলাম, ভালোবাসা শুধু কবিতায় নয়, দৃষ্টির ভেতরেও লেখা থাকে।

নীলার কথা মনে করে সেদিন রাতে আর ঘুমাতে পারিনি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু ভাবছিলাম—কলার মোচার মতো সাজানো তার হাতের নরম আঙুলগুলো যদি একবার ছুঁতে পারতাম! যদি তাকে দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারতাম! যদি তার উরুর ওপর মাথা রাখার সাহস পেতাম! ঠোঁটের কোনে জমে থাকা জলকণাটাকে যদি নিজের ঠোঁট দিয়ে তুলে নিতে পারতাম… ভাবনাগুলো শরীরে এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগিয়ে তুলল।

পরের সপ্তাহে ওর জন্মদিন। অনেক ভেবে আমি একটা চিঠি লিখলাম—ছোট্ট একটি ভালোবাসার কবিতা, ঠিক যেমন করে বৃষ্টি কদমফুলকে ছুঁয়ে দেয়—

“তোমাকে অনেক ভালো লাগে, নীলা।

ঠিক যেমন করে কদমফুলে বৃষ্টি ভালোবাসে।

আমি—তোমার চোখে চোখ রেখে হারিয়ে যেতে চাই,

নীল জোনাকির আলোর মতো।”

দুপুরে ক্লাস শেষে নীলার ব্যাগে সেই চিঠিটা রেখে দিলাম। দুই দিন পর, করিডোরে দেখা হলো। ও থামল, তাকিয়ে বলল,

— “তমাল, তুমি খুব আলাদা। কিন্তু আমি এখনো বুঝে উঠতে পারি না, ভালোবাসা আসলে কীভাবে কাজ করে। আসলে… আমি এখনো কাউকে ছুঁতে শিখিনি…”

আমি ওর দিকে তাকিয়ে কিছু বলিনি। শুধু মনে মনে বলেছিলাম, ‘তোমার স্পর্শের জন্য নয়, তোমার স্পর্শচিহ্নহীন ভালোবাসার জন্যই তো আমি পাগল, নীলা।’

এরপর থেকে ও ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল। আমি প্রতিদিন তাকে দেখতাম, কিন্তু আর কিছু বলতাম না। আমি যেন একা হয়ে যেতে লাগলাম। সময় যেন হঠাৎ করেই থমকে গিয়েছিল, এক অদ্ভুত শূন্যতায়।

তিন বছর পর। ঢাকায় এক বইমেলায় হঠাৎ করেই ওর সঙ্গে দেখা হলো। ওর মুখে সেই আগের আলো নেই, চোখে ক্লান্তির ছায়া, শুকনো ঠোঁটে বিষাদের চিহ্ন।

আমাকে দেখে একটু চমকালো, তারপর মৃদু হাসল—

— “তমাল! তুমি কি এখনো কবিতা লেখো?”

আমি অনিচ্ছায় হেসে বললাম,

— “লিখি না। কারণ তুমি আর পড়ো না।”

ও একটু থেমে আমার চোখে তাকিয়ে বলল,

— “তুমি এখনো আগের মতোই আছো।”

নীলা যেন ঠিক নীল জোনাকির মতো—আলোকিত কিন্তু নিঃশব্দ, গভীর কিন্তু স্পর্শহীন!

ওর ঠোঁটের সেই শব্দগুলো আমার শরীর জুড়ে ঢেউ তুলল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো—ওর হাতটা ধরে বলি, “ফিরে এসো…”

কিন্তু কিছু বলিনি। ও চলে গেল—বহু ভিড়ের ভেতরে হারিয়ে গেল আবার।

আমি চেয়ে চেয়ে দেখেও আর খুঁজতে যাইনি। আমি জানি, ভালোবাসা কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না যদি সেটা নিজে ধরা না দেয়।

প্রথম প্রেম কখনো শেষ হয় না।

সেটা শরীরে থাকে, নিঃশ্বাসে থাকে, এমনকি নির্জন রাত্রির বালিশের ভেতরেও তার ছোঁয়া থেকে যায়।

সময় হয়তো তার দাগ মুছে দেয়, কিন্তু সেই প্রথম স্পর্শ, সেই প্রথম শিহরণ—চিরকাল বেঁচে থাকে প্রেমিকের অন্তরে।

নীলা ছিল আমার প্রথম প্রেমের সেই নীল জোনাকি—

যার আলো শুধু দেখার জন্য, ধরার নয়।

(চলবে)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
শেষ টেস্ট খেলতে কলোম্বো পৌঁছেছে টাইগাররা
গেন্ডারিয়া থানার অভিযানে ৭ দিনে ১৮ মাদকসেবী গ্রেপ্তার, ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা
কুষ্টিয়ায় ২ কোটি টাকার অবৈধ জাল জব্দ
গাজীপুরের পূবাইলে রাস্তার দাবিতে মানববন্ধন
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা