মেয়ের আঁকা ছবিতে বেঁচে আছেন ডাক্তার বুলবুল

‘ছেলে-মেয়ে আর বুলবুলকে নিয়ে খুব ভালো ছিলাম আমি। বুলবুল খুব ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ ছিল। বুলবুল তো ফ্রিতেই অনেক মানুষকে চিকিৎসা দিত। ওরা বুলবুলকে মারল কেন! ওরা আমার সন্তানদের বাবাহারা করল কেন! ওরা সারা দিন বাবার অপেক্ষায় থাকে। এখন কী বুঝ দিব আমি সন্তানদের!’ অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে কথা বলছিলেন ডা. বুলবুলের স্ত্রী শাম্মী।
কিছুক্ষণ পরপর ডা. বুলবুল ফোন করে ছেলে-মেয়ের সঙ্গে কথা বলতেন। ভিডিও কলে বাবাকে দেখত ছোট্ট সামী। আর তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে। এখন ফোনে রিং হলেই বাবা বাবা বলে ডেকে ফোন ধরে। কানে ফোন ধরে, কিন্তু সামীর কানে আর বাবার কথা বাজে না। একটু পরে ফোন ফেলে দিয়ে কান্না করে। দেড় বছর বয়সী সামীকে কী বুঝ দেবেন ভাষা নেই মা শাম্মীর ।
মেয়ে আয়ন আনমনা হয়ে বসে থাকে সারা দিন। কারোর সাথে কোনো কথা বলে না, খাওয়া-দাওয়াও করছে না। মেয়ে চোখের পানিতে বাবার ছবি এঁকে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর কাঁদছে আর বাবার ছবি আঁকছে। এটাই তার বাবা! ছয় বছরের মেয়ের কাছে ড্রইংয়ের এই ছবিতেই বেঁচে আছেন ডা. বুলবুল।
বর্তমানে এই হলো ডা. বুলবুলের পরিবারের চিত্র। চিকিৎসক বুলবুল আহমেদ সব ব্যস্ততার মধ্যেও সন্তানদের ভুলতেন না। চেম্বার থেকে একটু পরপর স্ত্রী শাম্মীকে ফোন করে খোঁজ নিতেন বাচ্চাদের। কথা বলতেন তাদের সঙ্গে। আজ তিনি তাদের কাছ থেকে চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছেন।
ডাক্তার বুলবুলের মেয়ে আয়নের আকা একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে বাবা-মা আর তারা দুই ভাই-বোন হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার হাত ধরে আছে আয়ন। আর ছবির ওপরে লেখা- ‘প্রিয় বাবা, তুমি কোথায়?’ ‘আব্বু, তোমাকে ভালোবাসি, আব্বু তোমাকে মিস করি!’
শাম্মী বলেন, ‘বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখানো ও ভালো মানুষ করে গড়ে তুলতে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এসেছিলাম। কিন্তু আজ খালি হাতে গ্রামে চলে আসতে হলো।’
মগবাজারের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দন্ত চিকিৎসা বিষয়ে পড়াশোনা শেষে মগবাজার এলাকাতেই রংপুর ডেন্টাল নামে একটি চেম্বার খুলে মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছিলেন ডা. বুলবুল। দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতেন বলে ‘গরীবের ডাক্তার’হিসেবে তার পরিচিতি তৈরি হয়।
রংপুর শহরের কোতোয়ালি ভগিবালাপাড়া গ্রামের আব্দুস সামাদ ও বুলবুলি সামাদ দম্পতির দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন বুলবুল। ২০০৮ সালে দিনাজপুরের মেয়ে শাম্মীকে বিয়ে করেন তিনি। তাদের কোল জুড়ে আসে মেয়ে আয়ন ও ছেলে সামী। পরিবার নিয়ে পশ্চিম শেওড়াপাড়া আনন্দবাজার এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন ডা. বুলবুল।
ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হওয়ার ১৩ দিন পার হয়েছে ইতিমধ্যে। কান্না আর হাহাকার থামছে না পরিবারে। প্রতি বছর রমজানে পরিবারের সবার খোঁজ-খবর নেওয়া, গ্রামের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো তার রুটিন কাজ ছিল। কিন্তু এবারের রমজানে আর দেখা মিলছে না গরিবের ডাক্তারের। ডাক্তার বুলবুলের স্ত্রী শাম্মী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের মেয়ে আয়ন বাসায় সব সময় ওর বাবার কাছেই থাকত, খাওয়া-দাওয়া গোসল করাত ওর বাবা। প্রতিদিন রাতে বাবার অপেক্ষায় বসে থাকত ছেলে-মেয়ে দুজনই। বুলবুল রাতে বাসায় এলে তার হাতেই খাবার খেত ওরা। পরে তার বুকের ওপর ঘুমাত আয়ন আর সামী।’
বুলবুলের খুন হওয়াটাকে কোনোভাবেই ছিনতাইকারীর কাজ মানতে নারাজ শাম্মী, ‘এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এটা কখনোই ছিনতাইকারী হতে পারে না। আমার ইচ্ছা ছিল ছিনতাইকারীদের সাথে কথা বলার, তারা কেন বুলবুলকে জীবনে মেরে ফেলল জিজ্ঞাসা করতে চাইছিলাম। টাকা, মোবাইল ফোন চাইলেই তো দিয়ে দিত। এ ছাড়া যে ছুরি মারছে বুলবুলকে, সেই আসামিকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।’ শাম্মী বলেন, ‘কার কাছে বিচার চাইব, কে আমার সন্তানদের কাছে তার বাবাকে ফিরিয়ে দিবেন।’
ডা. বুলবুল গত ২৮ মার্চ ভোর সাড়ে পাঁচটায় নোয়াখালী যাওয়ার জন্য শেওড়াপাড়ার বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশা করে যাচ্ছিলেন মিরপুর বাসস্ট্যান্ডে। কিন্তু কাজীপাড়া মেট্রোরেলের সাত নম্বর স্টেশনের নিচে ২৭৮ নম্বর পিলারের কাছে পৌঁছালে তার গতিরোধ করে তিনজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি। তাকে ছুরিকাঘাত করে মোবাইল ফোন নিয়ে চলে যায় তারা। পরে ২৯ মার্চ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ছিনতাইকারীদের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। পরে আদালতের মাধ্যমে তাদের চার দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ড চলাকালে তারা দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিতে চাইলে তাদের হাজির করা হয়। বিচারক তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
(ঢাকাটাইমস/১০এপ্রিল/এএইচ/মোআ)

মন্তব্য করুন