‘দরবেশ বাবা’ পরিচয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ, দুজন গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২২:৪৫| আপডেট : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২২:৪৭
অ- অ+

কথিত ‘দরবেশ বাবার’ পরিচয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে দুই প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একটি দল। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন মো. তানজিল আহমেদ ওরফে তানজিদ হাসান ও মোহাম্মদ হাসেম। গ্রেপ্তারকৃত হাসেম এই চক্রের মূলহোতা। তিনি আরবি ভাষায় কথা বলতেন পারেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন মানুষের কণ্ঠেও কথা বলতে পারেন। রবিবার বিকালে সিআইডির সদর দপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

সিআইডির বক্তব্য, আনোয়ারা বেগম একজন অবসর প্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। তার তিন ছেলে-মেয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত। তারা দেশের বাইরে থাকেন। তার স্বামী দেশের একজন নামকরা চিকিৎসক। চাকরি থেকে অবসরের পর আনোয়ারা দিনের বেশিরভাগ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যয় করেন। কিছুটা পারিবারিক সমস্যায়ও ভুগছিলেন। তিনি এ থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে থাকেন।

এমন অবস্থায় হঠাৎ একদিন ফেসবুক স্ক্রল করার সময় তার সামনে একটি বিজ্ঞাপন আসে। বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, একজন সুন্দর সৌম্য চেহারার দরবেশ বেশধারী ব্যক্তি নিজেকে সৌদি আরবের মসজিদে নববীর ইমাম পরিচয় দিয়ে বলছেন, তিনি কোরান হাদিসের আলোকে মানুষের সমস্যা সমাধানে কাজ করেন। স্বামী-স্ত্রীর অমিল, বিয়ে না হওয়া, বাচ্চা না হওয়া, লটারি জেতানোসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেন। বিজ্ঞাপনে দুজন মেয়ের সাক্ষাৎকার দেখায় যেখানে মেয়ে দুটিকে বলতে শোনা যায়, তারা এই দরবেশ বাবার কাছ থেকে তাদের সমস্যার সমাধান পেয়েছেন।

ফেসবুকের এই বিজ্ঞাপন দেখে আনোয়ারা বেগম তার বাসার কাজের মেয়ের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করেন। কাজের মেয়ে তখন তাকে জানায়, জ্বীন-পরীর মাধ্যমে দরবেশ বাবারা এসব সমস্যার সমাধান করে। তার গ্রামের কয়েকজনের এভাবে সমস্যার সমাধান হয়েছে। এটা শুনে আনোয়ারা বেগম উৎসাহিত হন। আর বিজ্ঞাপনে দেওয়া মোবাইল নম্বরে ফোন করেন। ফোন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞাপন দেওয়া দরবেশ বাবা বেশধারী ব্যক্তি তার সঙ্গে খুব সুন্দর করে কথা বলে তার পারিবারিক সমস্যা শুনতে চায়। তিনি তখন তার পারিবারিক কিছু সমস্যার কথা ওই দরবেশ বাবার সঙ্গে আলোচনা করেন।

দরবেশ বাবা তার সমস্যার কথা শুনে তাকে বলেন, ‘‘মা তোমার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। বাবার উপর আস্থা রাখো। আমি তোমাকে মা বলে ডাকলাম। আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে। তবে কিছু খরচ লাগবে মা। খরচের কথা কাউকে জানানো যাবে না। যদি জানাও তবে তোমার সমস্যা সমাধান হবে না। বিপরীতে তোমার সমস্যা আরো বাড়বে এবং তোমার ছেলে-মেয়ে ও স্বামীর ক্ষতি হবে।’’

এমন সুন্দর ব্যবহার ও কথা বলে দরবেশ বাবা তার বিকাশ নম্বরে একটা বড় অংকের টাকা বিকাশ করতে বলে। আনোয়ারা বেগম দরবেশ বাবার সুন্দর ব্যবহার ও কথায় তার ভক্ত হয়ে যায়। তখন ওই নম্বরে দরবেশ বাবার কথা মতো বিকাশে টাকা পাঠান। এইভাবে বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে দরবেশ বাবা আনোয়ারা বেগমকে ফোন করে বিভিন্ন অজুহাতে ও ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় সাত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে একসময় আনোয়ারা বেগম যখন বুঝতে পারেন তিনি প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন, তখন প্রতিকার পাওয়ার জন্য মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন।

এছাড়াও আনোয়ারা বেগম সিআইডির অতিরিক্ত আইজিপির কাছে একটি অভিযোগ করেন। পরবর্তীতে সিআইডির অতিরিক্ত আইজিপির নির্দেশক্রমে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের একটি টিম ভুক্তভোগীর অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে। আর ওই আসামিদের সনাক্ত করে।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সিআইডি সাইবার পুলিশ সেন্টারের একটি দল পরবর্তীতে আসামীদের অবস্থান সনাক্ত করে ঢাকার উত্তরা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে অভিযুক্ত মো. তানজিল আহমেদ ওরফে তানজিদ হাসানকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযুক্ত মো. তানজিল আহমেদ ওরফে তানজিদ হাসানকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ওই চক্রের মূল হোতা মো. হাসেম। হাসেম প্রথমে বিকাশ ও রকেটের মাধ্যমে ছোট ছোট অংকের টাকা নিতো।

এরপর বড় অংকের টাকা নেওয়ার সময় মো. তানজিল আহমেদ ওরফে তানজিদ হাসানকে আনোয়ারা বেগমের কাছে পাঠাতো। আর তানজিদ হাসান একসাথে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা নিয়ে যেত। এভাবে ধাপে ধাপে তারা আনোয়ারা বেগমের কাছ থেকে প্রায় সাত কোটি টাকা নেয়। অভিযুক্ত মো. তানজিল আহমেদ ওরফে তানজিদ হাসান জানায়, চক্রের মূল হোতা মো. হাসেম ভোলার বোরহানুদ্দিনে থাকেন। পরবর্তীতে সিআইডির একটি টিম বোরহানুদ্দিনে অভিযান চালিয়ে চক্রের মূল হোতা মো. হাসেমকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।

সিআইডি জানায়, প্রতারক মো. হাসেমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, তিনি ২০০৫ সাল থেকে এই কাজ করছে। প্রথম দিকে সে বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিতেন। পরে ২০১৬ সাল থেকে পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি সে ইউটিউব ও ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করেন। তিনি প্রতিমাসে ফেসবুকে চার লাখ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিতেন এবং পোস্ট বুস্ট করতো যাতে তার বিজ্ঞাপন সকল মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত স্বল্প শিক্ষিত প্রবাসী বাঙালিদের টার্গেট করে সৌদি আরব, দুবাই, ওমানসহ সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতে দেশ ভিত্তিক বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন।

এছাড়াও কথিত এই দরবেশ ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইতালি ও ফ্রান্সে বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন। এভাবে তিনি পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, ইউটিউব ও ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়ার মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে দরবেশ বাবা পরিচয় দিয়ে কথা বলতেন ও তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ভয়-ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে কৌশলে টাকা হাতিয়ে নিতেন। দরবেশ বাবারুপী প্রতারক মো. হাসেম হিন্দি ও আরবি ভাষায় কথা বলাসহ বিভিন্ন রকম কন্ঠে কথা বলতে পারে। যেমন: জীনপরীর কন্ঠ, ২০০ বছরের হুজুরের কন্ঠ, ১০০ বছরের বাবার কন্ঠ।

সিআইডির ভাষ্যমতে, এই প্রতারক ফ্রান্স প্রবাসী মো. ইমাম হোসেন নামে একজনের কাছ থেকে দরবেশ বাবা পরিচয় দিয়ে তাকে ১২ কোটি টাকার লটারি জিতিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এক কোটি ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। এছাড়া অন্য আরেকজন ইতালী প্রবাসীর কাছ থেকে অনুরুপভাবে লটারি ও জুয়ায় টাকা জিতিয়ে দেওয়ার কথা বলে প্রায় ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সিআইডি টিম খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, ফ্রান্স প্রবাসী মো. ইমাম হোসেনের পরিবার দেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করে। ওই প্রবাসীর স্ত্রী-সন্তান খেয়ে না খেয়ে অত্যন্ত কষ্টে দিনযাপন করছে। অথচ প্রবাসে তার কষ্টে উপার্জন করা টাকায় ভন্ড দরবেশ বাবা বাড়ি গাড়ি করে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। প্রবাসী মো. ইমাম হোসেন একপর্যায়ে তার বড় বোনকেও দরবেশ বাবার ভক্ত বানিয়ে ফেলে। বড় বোন তার ছেলের ইউনির্ভাসিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য জমানো টাকা পর্যন্ত ভাইয়ের কথায় দরবেশ বাবাকে দিয়ে দিয়েছে।

সিআইডির অনুসন্ধানে জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রতারক চক্রের এরকম ২০ থেকে ২৫ জন ক্লায়েন্ট আছে, মালয়েশিয়াতে আছে ১০ থেকে ১২ জন। এর মধ্যে পাঁচ থেকে ছয়জন ফিক্সড ক্লায়েন্ট আছে যারা গত চার থেকে পাঁচ বছর ধরে নিয়মিত এই দরবেশ বাবারূপী প্রতারককে টাকা দিয়ে আসছে।

(ঢাকাটাইমস/১৭সেপ্টেম্বর/এএ/কেএম)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
প্রথম প্রেমের স্পর্শ: পর্ব ৪- জীবন আঁধারে তাঁকেই খুঁজি
ফিলিপাইনে ৬.১ মাত্রার ভূমিকম্প
চিকিৎসায় অবহেলা: ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের সনদ ৫ বছরের জন্য স্থগিত
ঢাকায় এক্সিকিউটিভ স্টাডি আব্রোড আয়োজিত অস্ট্রেলিয়ান এডুকেশন এক্সপো
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা