বিশ্বের সবচেয়ে দামি খাবার ক্যাভিয়ার, গুনতে হবে লাখ টাকা

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:১০ | প্রকাশিত : ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১০:৩৩

পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য অপরিহার্য। সুষ্ঠুভাবে শারীরিক বিকাশের জন্য বিভিন্ন ধরনের খাদ্য উপাদান বিভিন্ন মাত্রায় প্রয়োজন। ভোজনরসিকদের জন্য খাবারকে বিভিন্নভাবে করে তোলা হয় আকর্ষণীয়। কিন্তু লবণ মেশানো মাছের ডিম বিশ্বের সবচেয়ে দামি খাবারের উপাধিতে ভূষিত হয়ে আছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও ক্যাভিয়ার, যাকে সহজ বাংলায় মাছের ডিম বলা যায়, হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি খাবার, যা খেতে হলে আপনাকে হাজারখানেক নয়, গুনতে হবে লাখ টাকা।

ক্যাভিয়ারকে 'ধনীদের খাবার' বলা হয়। এটি কেবল দেখতে আকর্ষণীয় নয়, এর মসৃণ টেক্সচার, মুক্তোর চকচকে এবং মাছের স্বাদ আনন্দ দেয়। যদিও ক্যাভিয়ার সবসময় ধনীদের খাবার ছিল না। একসময় রাশিয়া থেকে আসা জেলেরা এটি তাদের প্রতিদিনের ডায়েটে খেতেন। রান্না করা আলু দিয়ে এটি নিয়মিত ডায়েটে খেতেন। ক্যাভিয়ারকে 'রো' নামেও ডাকা হত, যা রাশিয়ান জেলেদের নামে নামকরণ করা হয়েছিল।

ক্যাভিয়ারকে 'আনফার্টিলাইজড লবণ ডিম' হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। ক্যাভিয়ার মূলত মাছের ডিম, যা কেবলমাত্র এক প্রজাতির মাছ থেকে পাওয়া যায়। এগুলো সাধারণত কালো, জলপাই সবুজ, ধূসর এবং কমলা বর্ণের হয়।

ক্যাভিয়ার স্টার্জন প্রজাতির মাছ থেকে প্রাপ্ত। স্যাটারনিয়ান মাছ প্রায় ২৬ ধরণের হয়। মহিলা স্টার্জন মাছগুলি কেবলমাত্র ক্যাভিয়ার পাওয়ার জন্য রাখা হয়। আপনি কি জানেন যে স্টার্জন মাছের বয়স ১০০ বছরেরও বেশি হতে পারে।

প্রকৃত ক্যাভিয়ার স্টার্জেন মাছের ডিমকেই বলা হয়, তবে আরও কিছু মাছের ডিমকেও বলা হয় ক্যাভিয়ার। ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় অন্য এক শ্রেণীর স্টার্জেন ক্যাভিয়ার পাওয়া যায়। এছাড়াও কালো অথবা লাল বর্ণের লাম্পসাকার ক্যাভিয়ার আছে যা ইউরোপের দেশগুলোতে ছোট ছোট কাচের জারে বিক্রি করা হয়।

অ্যাসিপেনসারিডি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত মাছের ডিমকে মূলত বলা হয় ক্যাভিয়ার। অত্যন্ত সুখাদ্য বলে বিবেচিত হওয়া এ খাদ্যটি বিশ্বের সবচেয়ে দামী খাবার । সাধারণত কাস্পিয়ান সাগর এবং কৃষ্ণ সাগরে প্রাপ্ত স্টার্জেন মাছের (বেলুজা, অসেট্রা, সেভ্রুজা) ডিমকে ক্যাভিয়ার বলা হয়। দেশভেদে আরও কিছু মাছ যেমনঃ স্যামন, স্টিলহেড, ট্রাউট, লাম্পফিশ, হোয়াইটফিশ ইত্যাদির ডিমকেও বলা হয় ক্যাভিয়ার।

প্রধান ক্যাভিয়ারগুলো হল বেলুজা, স্টারলেট, ক্যালুজা হাইব্রিড, আমেরিকান অসেট্রা, অসেট্রা, সাইবেরিয়ান স্টার্জেন ইত্যাদি। সবচেয়ে দুর্লভ এবং দামী ক্যাভিয়ার পাওয়া যায় বেলুজা স্টার্জেন থেকে। ইরান, কাজাখস্তান, রাশিয়া, তুর্কমেনিস্তান ও আজারবাইজান দিয়ে পরিবেষ্টিত কাস্পিয়ান সাগরে এ মাছ পাওয়া যায়। বেলুজা ক্যাভিয়ার মূলত এর নরম এবং অত্যন্ত বড় (মটর দানার মত) আকারের ডিমের জন্য এত দামী হয়। এর বর্ণ হালকা ধূসর-রূপালী থেকে কালো হয়।

এর পরেই আছে সোনালী বর্ণের স্টারলেট ক্যাভিয়ার। দুষ্প্রাপ্য এ ক্যাভিয়ার একসময় শুধুমাত্র রাশিয়া, ইরান এবং অস্ট্রিয়ার রাজ পরিবারের জন্য বরাদ্দ ছিল। তৃতীয় অবস্থানে আছে অসেট্রা ক্যাভিয়ার যাকে রাশিয়ান ক্যাভিয়ারও বলা হয়। মাঝারি আকারের এই ডিমগুলো হালকা বাদামী থেকে গাঢ় বাদামী বর্ণের হয়ে থাকে। অন্যান্য ক্যাভিয়ারের মধ্যে ধূসর সেভ্রুজা ক্যাভিয়ার, চাইনিজ ক্যালুজা ক্যাভিয়ার ও আমেরিকান অসেট্রা অন্যতম।

সুইডেন ও ফিনল্যান্ডে অন্যান্য মাছের ডিমকেও বলা হয় ক্যাভিয়ার। এছাড়াও ভেগান নামক এক প্রকার ক্যাভিয়ার আছে যা মূলত এক প্রকার সামুদ্রিক শৈবাল। এটি দেখতে প্রায় বেলুজা ক্যাভিয়ারের মত। টেলিভিশন এবং সিনেমায় বেশিরভাগ সময় এই ভেগান ক্যাভিয়ারই ব্যবহার করা হয়।

ক্যাভিয়ার প্রস্তুত প্রণালীতে তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি। কয়েক শতক আগের প্রণালী মতেই এটি প্রস্তুত করা হয়। প্রথমে স্ত্রী স্টার্জেন থেকে ডিম্বাশয়টি পৃথক করে নেয়া হয়। এরপর একে একটি চালনীতে চালনা করা হয় যাতে ডিম্বাশয়ের ঝিল্লি না থাকে। এরপর ডিমের দলাকে ভালোমত ধুয়ে নেয়া হয় যাতে কোন অণুজীব না থাকে। ডিমগুলোকে পরিমাণ মত লবণ মিশিয়ে টিনের কৌটায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়।

ক্যাভিয়ার সাধারণত ক্র্যাকার কিংবা বাটার টোস্টের উপর পরিবেশন করা হয়। এছাড়াও রুটির সাথে খাওয়া হয়৷ পরিবেশনের সময় এক টেবিল চামচেরও কম ক্যাভিয়ার পরিবেশন করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মত ৩০ গ্রাম ক্যাভিয়ারের একটি কৌটা দুইজনের জন্য পরিবেশন করা উচিত। রাশিয়ায় এক ধরনের প্যানকেকের সাথে ক্রিম দিয়ে ক্যাভিয়ার পরিবেশন করা হয়। এছাড়া পূর্ব ইউরোপিয়ান কিছু দেশে সিদ্ধ ছোট আলুর সাথেও পরিবেশন করা হয়।

এক চামচ ক্যাভিয়ার ভিটামিন বি১২ এর চাহিদা মেটাতে পারে। এতে লবণ এবং কোলেস্টেরলও পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়। এক টেবিল চামচ ক্যাভিয়ারে পাওয়া যায়- এনার্জি: ৪২ ক্যালরি, ফ্যাট; ২.৪৬ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেটস: ০.৬৪ গ্রাম, প্রোটিন: ৩.৯৪ গ্রাম, সোডিয়াম: ২৪০ মিলিগ্রাম, কোলেস্টেরল: ৯৪ মিলিগ্রাম, জিংক: ১২.১৮ মিলিগ্রাম।

ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড - ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ ক্যাভিয়ার শরীরে রক্ত ​​জমাট বাঁধতে বাধা দেয়। ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি কার্ডিওভাসকুলার এবং মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের জন্য খুব ভাল বলে বিবেচিত হয়।

ক্যাভিয়ারে সেলেনিয়াম নামে একটি অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টও রয়েছে, যা ভিটামিন-ই এর সঙ্গে মুক্ত র‌্যাডিক্যাল ক্ষতির ঝুঁকি হ্রাস করে এবং কোষকে সুরক্ষিত করে। এই সেলেনিয়াম ছাড়াও আমাদের ইমিউন সিস্টেম এবং স্বাস্থ্যকর থাইরয়েড ফাংশন জন্য ভাল।

ভিটামিন এবং খনিজ - ক্যাভিয়ারে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় এবং অসাধারণ পুষ্টি থাকে। এতে প্রচুর ভিটামিন-সি, ভিটামিন-এ এবং ভিটামিন-ই রয়েছে যা আপনার প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে কাজ করে। এটি ছাড়াও এতে জিঙ্ক, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং আয়রন খুব বেশি পরিমাণে রয়েছে।

ভিটামিন-বি ১২ - ক্যাভিয়ার ভিটামিন-বি ১২ এর খুব ভাল উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়। ভিটামিন-বি ১২ শরীরে কেবল লাল কোষ তৈরি করে না, এটি ঠিকমতো কাজ করা অ্যাটি অ্যাসিডেরও যত্ন নেয়। ভিটামিন-বি ১২ এর অভাব ক্লান্তি, হতাশা, রক্তাল্পতা এবং মস্তিষ্কের ক্রিয়া সম্পর্কিত সমস্যাগুলি বাড়িয়ে তোলে।

২০১২ সালে কাস্পিয়ান থেকে প্রাপ্ত এক কিলোগ্রাম বেলুজা স্টার্জেন ক্যাভিয়ারের মূল্য ছিল ১৬,০০০ ডলার। ২০১৪ সালে প্রতি আউন্স (২৮ গ্রাম) সাধারণ স্টার্জেন ক্যাভিয়ারের মূল্য ছিল ১০৫ ডলার এবং অ্যালবিনো স্টার্জেন ক্যাভিয়ারের দাম ছিল সর্বোচ্চ ৮০০ ডলার পর্যন্ত। মূল্য কমবেশি হওয়া নির্ভর করে ডিমের গুণগত মানের উপর ।

ডিম কতটা তাজা, সঠিক মাত্রায় ক্রিম আছে কিনা কিংবা মাখনের স্বাদ কতটুকু পাওয়া যাচ্ছে ইত্যাদি মানের উপর নির্ভর করে ক্যাভিয়ারের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এছাড়াও মাছ থেকে ডিম বের করার প্রক্রিয়ার কারণেও মূল্যের তারতম্য হয়ে থাকে। যে মাছ না মেরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় এর থেকে ডিম নিয়ে নেয়া হয় সে মাছের ক্যাভিয়ারের দামও তুলনামূলকভাবে বেশি হয়।

সর্বোচ্চ দামে ক্যাভিয়ার বিক্রির রেকর্ডটি ইরানের আলমাস প্রোডাক্ট এর। তারা ২০,০০০ ইউরোতে এক কিলোগ্রাম বিক্রি করে যা ছিল কাস্পিয়ান সাগরের দুষ্প্রাপ্য অ্যালবিনো স্টার্জেন মাছের ডিম।

ক্যাভিয়ারের আকাশছোঁয়া মূল্যের পেছনে প্রধানত দায়ী স্টার্জেন মাছের অপর্যাপ্ততা। পৃথিবীর ভোজনরসিক ধনীদের কাছে একটি শৌখিনতা হলো ক্যাভিয়ার। সেক্ষেত্রে নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশে এটি সহজলভ্য হবেনা সেটিই স্বাভাবিক। তবে ক্যাভিয়ারের যোগান দিতে দিতে কিছু প্রজাতির স্টার্জেন মাছের অস্তিত্ব হুমকির মুখেও আছে। বিলুপ্তির সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে কয়েক প্রজাতির স্টার্জেনের। পরিবেশের ভারসাম্যের কথা বিবেচনা করে পরিমিত পরিমাণে বাজারজাত করা উচিত ক্যাভিয়ার।

(ঢাকাটাইমস/১৫ জানুয়ারি/আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :