তিন কারণে গ্যাসের সংকট 

হাসান মেহেদী, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ০৮:১৪
অ- অ+

দেশজুড়ে গ্যাসের চরম সংকট হঠাৎ করে কেন সৃষ্টি হলো তা নিয়ে আলোচনা চলছে সরকারের উচ্চপর্যায়েও। এ সংকট সামাল দিতে নানা পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। গত এক সপ্তাহ ধরে গ্যাস সংকট চরম আকার ধারণ করেছে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে।

তবে কেন এই সংকট? এর পেছনে কি? এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রধানত তিনটি কারণকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে সরকারের অবহেলাকেও দুষছেন তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান গ্যাস সংকটে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে পুরোনো পাইপলাইন। একদিকে আমদানিকৃত এলএনজি ঘাটতি অপরদিকে শীত মৌসুমে গ্যাসের কম্প্রেশারের চাপ কম থাকায় গ্যাস উত্তোলন করতে ধীর গতি। গ্যাসের জরাজীর্ণ পাইপলাইন, অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ সংযোগের কারণে প্রায় ঘটছে গ্যাস দুর্ঘটনা। অনেক বাসাবাড়িতে গ্যাসের চুলায় পাইপলাইন দিয়ে পানি আসতেও দেখা যায়। শীতের দিনে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। জনসাধারণের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে দেশের বিভিন্ন অপরিকল্পিত রাস্তায় গ্যাসের পাইপলাইন স্থাপন করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। বছরজুড়েই এসব সড়কের মেরামত চলতেই থাকে। লেগে থাকে জলাবদ্ধতা, এছাড়াও স্থানীয় পর্যায়ের অলিগলিগুলো মেরামতের নামে মাটি ভরাট করে উঁচু করতে থাকে সংশ্লিষ্টরা। এসব রাস্তায় প্রায় ২৫-৩০ বছর পূর্বে জ্বালানি চাহিদা মেটাতে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি যে পাইপলাইন স্থাপন করেছিল, লৌহনির্মিত সেই পাইপলাইনগুলো প্রায় ১৫-২০ ফুট মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। অধিকাংশ পাইপলাইন পুরোনো হওয়ায় গ্যাস সরবরাহে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

তথ্য বলছে, দেশের ৭০ শতাংশ গ্যাস বিতরণ লাইনই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। স্থাপিত লাইনের অর্ধেকের মেয়াদ পেরিয়েছে বহু বছর আগে। এছাড়াও এসব গ্যাসের পাইপলাইনগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ হয় না।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) উপ-মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তারিকুল ইসলাম খান ঢাকা টাইমসকে বলেন, আমাদের দেশে শীতকালীন সময়ে গ্যাস সংকট বেশি দেখা যায়। মূলত শীতকালীন সময়ে চাহিদার তুলনায় গ্যাস উত্তোলন কম হয়। এসময়ে তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় পাইপলাইনে তরল পদার্থ জমে গ্যাস প্রবাহের চাপ কমে যায়।

গ্যাস উত্তোলনের যে কম্প্রেশার থাকে, তাতে শীতের সময়ে গ্যাস উত্তোলনে ব্যাঘাত ঘটে। এই মুহূর্তে দেশে ৩টি কম্প্রেশার দিয়ে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে অধিকাংশ গ্যাসলাইনের পাইপগুলো অনেক পুরোনো, এটাও গ্যাস কম থাকার কারণ। গ্যাসের পাইপগুলো পরিবর্তন করা হলে গ্যাসের লাইনে কম্প্রেশার দিয়ে গ্যাস উত্তোলন করতে অনেকটা সুবিধা হবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে অনেক স্থানেই পাইপ পরিবর্তন করা হয়েছে। এছাড়াও কিছু কিছু জায়গায় পাইপ পরিবর্তনের কাজ চলমান রয়েছে। অতি শিগগিরই গ্যাস সংকটের বিষয়টি সমাধান হবে।

গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) এর তথ্য বলছে, দেশে দৈনিক গ্যাস উত্তোলনের পরিমাণ এবং আমদানি করা এলএনজি প্রায় ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। তবে এর বিপরীতে দৈনিক চাহিদা রয়েছে ৩ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এদিকে ২,১৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দৈনিক উত্তোলন (উৎপাদন) করা হচ্ছে। এছাড়াও মহেশখালী-আনোয়ারা, আনোয়ারা- ফৌজদারহাট এবং চট্টগ্রাম-ফেনী-বাখরাবাদ পাইপলাইনগুলোর মাধ্যমে দৈনিক আরও ৮৫০ থেকে ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট আমদানি করা এলএনজি জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে বলে তথ্য রয়েছে।

গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) এর উপ-মহাব্যবস্থাপক (ল অ্যান্ড শেয়ার) মো. সিদ্দিকুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, বর্তমানে গ্যাস সংকটের প্রধান কারণ হচ্ছে গ্যাসের লাইন ডাউন, পাইপ সমস্যা এবং আমদানি সংকট। আমাদের যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে সেই তুলনায় আমদানিকৃত লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাসের (এলএনজি) পরিমাণ কম রয়েছে। ইতোমধ্যে আমদানিকৃত এলএনজির জাহাজ দেশে চলে এসেছে। এছাড়াও দেশে গ্যাসের কূপ সংকট রয়েছে। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক গ্যাসের কয়েকটি কূপ খননের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ৩ মাসের মধ্যে আরও ২০-২৫টি কূপ খননের কাজ সম্পন্ন হবে। এতে করে গ্যাস সংকটের সমস্যা শিগগিরই কেটে যাবে। আমদানির পাশাপাশি আমাদের গ্যাস উত্তোলনের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। সেই ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ১০০টি কূপ খননের পরিকল্পনা করেছে সরকার। উৎপাদন বাড়াতে ৪৬টি কূপ খননের কাজ শুরু করেছে পেট্রোবাংলা।

তথ্য বলছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি গ্যাস ব্যবহার হয়। শুধুমাত্র বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতেই ৪০ শতাংশের মতো গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদা হচ্ছে ২২৪০ এমএমসিএফডি। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা হচ্ছে সাড়ে সাতশ-আটশ এমএমসিএফডি গ্যাস।

পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন ও মাইনস) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খান ঢাকা টাইমসকে বলেন, দেশে উৎপাদন যেমন বাড়ছে, চাহিদাও বাড়ছে। গ্যাস সংকট কমাতে হলে খরচ বাড়াতে হবে। সমস্যা কোন সেক্টরে নেই, যেমন খরচ তেমন গ্যাস। সব সেক্টরেই সমস্যা আছে। শুধু পাইপলাইনই নয়, গ্যাস সংকট সমস্যা সমাধানে সব সেক্টরের সমস্যা সমাধান করতে হবে। খরচ বা ব্যয় যত বেশি হবে গ্যাস আমদানি ও উত্তোলনও তত বেশি।

পেট্রোবাংলার এই কর্মকর্তা আরও বলেন, দেশের সব সেক্টরেই অনেক উন্নয়ন হচ্ছে, গ্যাস সেক্টরেও প্রচুর উন্নয়ন দরকার। এই খাতে বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে, খরচ বাড়ালে গ্যাসের সমস্যা থাকবে না। সব দেশই গ্যাস মজুদ করে, এরপর গ্যাস আমদানি করে। আমাদেরও গ্যাস আমদানি বাড়াতে হবে। মানুষের যেমন চাহিদা বাড়ছে, গ্যাসের খরচও তেমন বাড়ছে। বিভিন্ন সেক্টরে এখন গ্যাসের ব্যবহার হচ্ছে। শুধু বিদ্যুৎ খাতেই ৪০ শতাংশের বেশি গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে।

জানা গেছে, উৎপাদন কমায়, এলএনজি সরবরাহ বাড়াতে ১৪০ কোটি ডলার ব্যয়ে পাইপলাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে সরকার। ইতোমধ্যে প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদনের পর বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর কাছে ঋণ প্রস্তাব পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. শামসুল আলম ঢাকা টাইমসকে বলেন, দেশে গ্যাস সংকটের প্রধান কারণ হচ্ছে গ্যাস-সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অবহেলা। দায়িত্বরত ব্যক্তিরা মনেই করছেন না দেশে গ্যাস সংকট আছে বা হচ্ছে। আর তাদের দায়িত্ব অবহেলায় দেশের গ্যাস সংকটে অর্থনীতির ওপর চরম প্রভাব পড়ছে। দপ্তরগুলোতে কোনো জবাবদিহিতা না থাকায় কর্তাব্যক্তিরা খামখেয়ালিপনা করে আসছেন। যখনি গ্যাস সংকট দেখা দেয়, তখনি তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েন আমদানি বাড়াতে, তারা সংকটের আগে কি করেন। কেন তারা আগাম ব্যবস্থা নেয়নি। এসব কর্তাব্যক্তি চেতনাধারী হতে পারে না। এদের জন্যই সরকার বেকায়দায় পড়েন।

তিনি বলেন, প্রতি বছরই গ্যাস সংকট দেখা দিচ্ছে। গ্যাস-সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব অবহেলা ও খামখেয়ালিপনায় আগাম কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। নিয়মিত এই সংকট থাকলেও কেউ এর দায়ও নিচ্ছেন না। এই সমস্যা সমাধানে দপ্তরগুলোতে যোগ্য লোক আনতে হবে। অযোগ্য লোক দিয়ে এই সমস্যা সমাধান হবে না। পাশাপাশি যাদের দায়িত্ব অবহেলায় গ্যাস সংকট হচ্ছে তাদের সুষ্ঠু জবাবদিহিতা ও শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

(ঢাকাটাইমস/২২জানুয়ারি)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
প্রথম প্রেমের স্পর্শ: পর্ব ৪- জীবন আঁধারে তাঁকেই খুঁজি
ফিলিপাইনে ৬.১ মাত্রার ভূমিকম্প
চিকিৎসায় অবহেলা: ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের সনদ ৫ বছরের জন্য স্থগিত
ঢাকায় এক্সিকিউটিভ স্টাডি আব্রোড আয়োজিত অস্ট্রেলিয়ান এডুকেশন এক্সপো
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা