ধারাবাহিক তাফসির, পর্ব-২০

ইসরাফিল (আ.)-এর প্রথম ফুৎকারে সৃষ্টিজগত প্রকম্পিত হয়ে উঠবে

মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবিবী
  প্রকাশিত : ৩০ মার্চ ২০২৪, ১৯:২২| আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২৪, ১৫:৪২
অ- অ+

প্রিয় পাঠক,

জনপ্রিয় নিউজপোর্টাল ঢাকা টাইমসের আয়োজনে আজ আমরা পবিত্র কোরআনুল কারীমের ২০তম পারা থেকে ধারাবাহিক তাফসির করছি।

আগের পর্ব: লুত আ. এর স্ত্রীকে যে কারণে আল্লাহ পাথরে পরিণত করেন

২০তম পারার শুরুতে প্রশ্নাকারে আল্লাহ তায়ালার একত্ব ও কুদরতের পাঁচটি দলিল উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রথম দলিল: যে সত্তা আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, আকাশ থেকে যিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন, যে বৃষ্টির ফলে সবুজ-শ্যামল তরতাজা বাগান গড়ে ওঠে, সে সত্তা উত্তম নাকি তোমরা তার সঙ্গে যাদেরকে অংশীদার সাব্যস্ত করে থাকো, তারা উত্তম? (৬০)

দ্বিতীয় দলিল: যেই প্রকৃত দয়ালু সত্তা মানুষের জন্য পৃথিবী স্থির করে দিয়েছেন, তাতে নদী-নালা প্রবাহিত করেছেন, বড় বড় পাহাড়-পর্বত স্থাপন করেছেন, মিঠা ও লোনা পানি মিশ্রিত হওয়া থেকে রক্ষার জন্য তার মাঝে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করেছেন; এমন দয়াময় ক্ষমতাবান সত্তাকে মূর্তির সঙ্গে তুলনা করা কি কোনো ন্যায়বান মানুষের কাজ হতে পারে? (৬১)

তৃতীয় দলিল: অপারগতা, অক্ষমতা, অসুস্থতা এবং কষ্ট-মুসিবতের সময় কাকে ডাকা হয়; রাব্বুল আলামিনকে নাকি প্রাণহীন মূর্তিকে?' (৬২)

চতুর্থ দলিল: স্থল ও সমুদ্রের অন্ধকারে কে তোমাদের পথ দেখায়? বৃষ্টির পূর্বে কে ঠান্ডা বাতাসের ব্যবস্থা করে; দয়াময় আল্লাহ নাকি হাতে গড়া মূর্তি? (৬৩)

পঞ্চম দলিল: কে তিনি, যিনি প্রথমবার মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আবার তাদেরকে সৃষ্টি করবেন? এক্ষেত্রে রাব্বুল আলামিন ছাড়া তোমরা কার নাম উচ্চারণ করতে পারবে? (৬৪)

এটাই কোরআনের রীতি। আল্লাহ তায়ালার উলুহিয়্যাত এবং তার একত্বের ওপর কোরআন বিশ্বজগৎ এবং মানুষের চোখের সামনে ছড়িয়ে থাকা বাস্তবতার মাধ্যমে দলিল পেশ করে থাকে। এভাবেই কোরআন বিশ্বজগৎকে আলোচনা- পর্যালোচনার বস্তুতে পরিণত করেছে। এর ফলে বিরোধীরা পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ এসব কাজ করতে পারে না। (৬০-৬৪)

দ্বিতীয় মৌলিক বিষয় পুনরুত্থান

একত্ববাদের আলোচনার পর দ্বিতীয় মৌলিক বিষয় পুনরুত্থান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, মুশরিকদের যা বোধগম্য হতো না। তারা বলত, এটা কীভাবে সম্ভব হতে পারে যে, আমরা এবং আমাদের পূর্বপুরুষেরা মাটি হয়ে যাওয়ার পরও আমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করা হবে? (৬৭)

এই আপত্তির উত্তরে আল্লাহ তায়ালা তার নবীকে সান্ত্বনা দিয়ে মুশরিকদের শাস্তির হুমকি দিয়েছেন। বলা হয়েছে, অন্যান্য অপরাধীর সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তোমাদের সঙ্গেও তেমন করা হতে পারে। পৃথিবী ঘুরে দেখে নাও যে, তাদের সঙ্গে কীরূপ আচরণ করা হয়েছিল? এরপর কেয়ামতের দৃশ্যের আলোচনা করা হয়েছে। (৮৩)

বলা হয়েছে, ইসরাফিল আলাইহিস সালামের শিঙ্গায় ফুৎকার না দেওয়া পর্যন্ত এ পৃথিবী বহাল থাকবে। ইসরাফিল যখন প্রথমবার শিঙ্গায় ফুৎকার দেবেন তখন আকাশ ও পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টি জীব প্রকম্পিত হয়ে উঠবে। এরপর দ্বিতীয় ফুৎকার দেওয়া হবে। তখন বিশ্বজগতের সকল জীব মারা যাবে। এরপর যখন তৃতীয় ফুৎকার দেওয়া হবে তখন সকলেই কবর থেকে জীবিত হয়ে উঠে দাঁড়াবে।

কোরআনের আলোচনার মাধ্যমে যেভাবে সুরাটির সূচনা হয়েছিল সেভাবেই সুরার সমাপ্তিতে বলা হয়েছে, এই পবিত্র কিতাবের শিক্ষা মানুষ শক্তভাবে আঁকড়ে ধরলে সফলতা পাবে।

সুরা কাসাস'

এটি মক্কি সুরা। আয়াতসংখ্যা: ৮৮। রুকুসংখ্যা: ১৯

হজরত মুসা ও ফেরাউনের ঘটনা

এ সুরার অধিকাংশ স্থানে ফেরাউনের সঙ্গে মুসা আলাইহিস সালামের যে ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল, তার আলোচনা করা হয়েছে। হরফে মুকাত্তায়াত-ত-সীন-মীম দ্বারা সুরাটি শুরু হয়েছে। এরপরই কোরআনের সত্যতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এরপর মুসা আলাইহিস সালামের ঘটনা শুরু হয়েছে।

সুরা কাসাসের মাধ্যমে জানা যায়, মিসরের ফেরাউন অত্যন্ত দুরাচার ছিল। অহংকার, জুলুম ও নিষ্ঠুরতার ক্ষেত্রে সে সীমালঙ্ঘন করেছিল। জনগণ যাতে তার ক্ষমতার জন্য কাল হয়ে না দাঁড়ায় এজন্য সে বর্তমানকালের সাম্রাজ্যবাদী নীতিতে মিসরবাসীকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত করে রেখেছিল।

মিসরের সংখ্যালঘু বনি ইসরাইলকে সে জুলুম-নির্যাতনের বিশেষ টার্গেট বানিয়ে রেখেছিল। একসময় আল্লাহ তায়ালা দুর্বলদের দাঁড় করানোর এবং শক্তিশালী দলকে লাঞ্ছিত করার ইচ্ছা করেন। তখন মুসা আলাইহিস সালামের জন্ম হয়। তার মা অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি জানতেন ফেরাউনের বাহিনী যদি এ নবজাতক শিশুর সন্ধান পেয়ে যায় তা হলে তাকে বাঁচিয়ে রাখবে না। তখন আল্লাহ তায়ালা তার অন্তরে ইলহাম করেন। সেই অনুযায়ী তিনি একটি সিন্দুক তৈরি করেন। প্রিয় কলিজার টুকরা সন্তানকে সিন্দুকে রেখে তা নীলনদে ভাসিয়ে দেন। পানির ঢেউয়ে দুলতে দুলতে সিন্দুকটি ফেরাউনের সেবিকাদের হাতে পড়ে। সেবিকারা সন্তানটি হজরত আসিয়ার (ফেরাউনের স্ত্রী) কোলে এনে দেয়।

ফেরাউন নিষ্পাপ শিশুটিকে হত্যা করতে উদ্যত হয়; কিন্তু আল্লাহর ফয়সালা ছিল ভিন্ন রকম। তিনি যে ফয়সালা করেন তা-ই বাস্তবায়িত হয়। মানুষের চেষ্টা- প্রচেষ্টা, তাদের প্লান-পরিকল্পনা সব ব্যর্থ হয়ে যায়। আসিয়া ফেরাউনকে কিছু কথা বলে। যার ফলে ফেরাউনের পাষাণ দিল নরম হয়ে যায়।

ঐদিকে সন্তান-শোকে মুসা আলাইহিস সালামের মা অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি একদম শান্তি পাচ্ছিলেন না। তার মনে হচ্ছিল সিন্দুকটি ফেরাউনের বাহিনীর হাতে পড়েছে আর তারা তাকে হত্যা করে ফেলেছে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তার বিচলিত অন্তরে স্থিরতা ও প্রশান্তি দান করেন। তাকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, সন্তানকে অবশ্যই তোমার কোলে ফিরিয়ে দেব। এই মুজিজা কীভাবে বাস্তবায়িত হবে? এ অসম্ভব বিষয় কীভাবে সম্ভব হবে? এটা চিন্তাভাবনা করা তোমার কাজ নয়, এটা আমার কাজ।

ক্ষুধার্ত শিশুকে কয়েকজন ধাত্রী দুধ পান করানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি কারো দুধ গ্রহণেই রাজি হচ্ছিলেন না। এ-দিকে মুসা আলাইহিস সালামের বোন দূর থেকে এসব দৃশ্য দেখছিল। তারা তার পরিচয় জানত না। তিনি (বোন) একটি পরামর্শ দেন। তার পরামর্শের ভিত্তিতে এক মহিলাকে (সন্তানের মাকে) ডেকে আনা হয়। একজন ধাত্রী হিসেবেই তার কোলে বাচ্চা সোপর্দ করা হয়।

ফেরাউনের সিদ্ধান্ত ছিল কোনো ইসরাইলি নবজাত সন্তান যেন তার মায়ের দুধ পান না করতে পারে। তার পূর্বেই যেন তাকে হত্যা করা হয়। কিন্তু আল্লাহর সিদ্ধান্ত ছিল তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে বড় জালেমের জন্য যে শিশু বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে, সে তারই নিকট লালিত-পালিত হবে। সেখানেই বড় হবে। তেমনটাই হয়েছিল। মিথ্যা প্রভুত্বের দাবিদার ফেরাউনের পরিকল্পনা পণ্ড হয়ে গিয়েছিল।

মুসা আলাইহিস সালাম যখন যৌবনে পদার্পণ করেন তখন তার হাতে এক কিবতি' নিহত হয়। এক বিশ্বস্ত লোকের পরামর্শে তিনি মিসর থেকে বেরিয়ে মাদায়ানের পথ ধরেন। তিনি পথঘাট কিছুই চিনতেন না। সঙ্গে থাকা-খাওয়ার কিছুই ছিল না। আল্লাহর নিকট তিনি দোয়া করেন, 'হে আল্লাহ, আমি আপনার দয়ার মুখাপেক্ষী।'

*একজন মানুষের যেসব জিনিসের প্রয়োজন হয়ে থাকে তখন তার সেসব

জিনিসের ব্যবস্থা হয়ে যায়। মানুষ যেমন রোদ্র-তাপের মুখাপেক্ষী তেমনিভাবে সে ভাষায়ও মুখাপেক্ষী। তার যেমন জাগ্রত থাকা প্রয়োজন তেমনি ঘুমেরও প্রয়োজন। তিনি একটি গাছের ছায়ায় বসে ছিলেন। তখন দুজন লজ্জাবতী পর্দানশিন মেয়ে বকরি হাঁকিয়ে নিয়ে আসে। তিনি অনুগ্রহ করে কূপ থেকে পানি উঠিয়ে তাদের বকরিকে পান করান।

মেয়েরা বেশ বুদ্ধিমতী ছিল। তারা তাদের পিতা হজরত শোয়াইব আলাইহিস সালামের নিকট অপরিচিত মুসাফিরের শক্তি-সামর্থ্য, আমানতদারি ও তার খোদাভীরুতার প্রশংসা করে। তখন তিনি এক মেয়ের মাধ্যমে তাকে ডেকে পাঠান। এর ফলে শুধু তার শান্তি-সুখের আবাসেরই ব্যবস্থা হয়নি; বরং কিছু শর্তসাপেক্ষে তার সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ারও ব্যবস্থা হয়ে যায়।

বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে তিনি মিসর যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে জঙ্গলে তিনি আগুন জ্বলতে দেখলেন। আগুন আনার জন্য গেলে তাকে নবুওয়াত দেওয়া হয়। নবুওয়াত প্রদানকারী আল্লাহ তায়ালা তাকে লাঠি ও উজ্জ্বল হাত মুজিজা হিসেবে প্রদান করেন। তিনি তাকে নির্দেশ দেন, যে জালেম মানুষের জীবন সংকীর্ণ করে দিয়েছে, যে নিজেকে ছাড়া কাউকে বড় বলে জানে না, তার সামনে হকের কালিমা উচ্চারণ করবে। ফেরাউন মানার মতো ব্যক্তি ছিল না। সে মুসা আলাইহিস সালামের দাওয়াত গ্রহণ করেনি। আল্লাহ তায়ালা তাকে লোক-লশকরসহ নীলনদের ঢেউয়ের হাওয়ালা করে দেন।

এই ঘটনায় উল্লেখযোগ্য তিন ব্যক্তি রয়েছেন। হজরত মুসা আলাইহিস সালাম, বনি ইসরাইল ও ফেরাউন। আলোচ্য সুরায় ঘটনার কিয়দংশ উল্লেখ হয়েছে। পুরো ঘটনাটি গোটা কোরআনের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ রয়েছে। ঘটনা থেকে যেসব শিক্ষা ও উপদেশ হাসিল হয় তা মাওলানা হিফজুর রহমান সিওহারবি রহ. কাসাসুল কোরআনে উল্লেখ করেছেন। সর্বসাধারণের ফায়দার জন্য এখানে তার সারসংক্ষেপ উল্লেখ করা হলো:

১. বিপদে-আপদে ধৈর্য ধারণ করলে দুনিয়া ও আখেরাতে তার উত্তম প্রতিদান পাওয়া যায়।

২. যে-ব্যক্তি সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর উপর ভরসা রাখে, আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তার বিপদ দূর করে দেন।

৩. আল্লাহর সঙ্গে যার প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে, বাতিল যতই শক্তিশালী হোক না কেন, তার কাছে তা অতি তুচ্ছ মনে হয়।

৪. যদি কোনো ব্যক্তি হকের পয়গাম নিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে দাঁড়ায় তা হলে শত্রুদের মধ্য থেকেই তার সহযোগী তৈরি করে দেওয়া হয়।

৫. যার অন্তরে ঈমান গভীরভাবে স্থান লাভ করে, সে ঈমানের জন্য টাকা-পয়সা, অর্থকড়ি সব বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়।

৬. গোলামির সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর দিক হচ্ছে, এতে মানুষের দৃঢ় সংকল্প ও ইচ্ছাশক্তি হারিয়ে যায় (এ কারণে বনি ইসরাইল পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল)।

৭. পৃথিবীতে ক্ষমতার উত্তরাধিকার তাদের জন্যই, যারা লড়াই ও সংগ্রামের ময়দানে দৃঢ়পদ থাকে।

৮. বাতিল যতই শক্তিশালী হোক, পরিশেষে সে ব্যর্থতার মুখই দেখতে পায়।

৯. আল্লাহর রীতি হচ্ছে, যাদেরকে মানুষ হীন মনে করে একদিন আল্লাহ 'তাদেরকে জমিনে কর্তৃত্বশালী বানান।

১০. যে-ব্যক্তি বা দল ইচ্ছাকৃতভাবে হক গ্রহণে অবাধ্যতা করবে, আল্লাহ তার থেকে সত্য গ্রহণের মানসিকতা ছিনিয়ে নেন। ফেরাউন ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের বেলায় এমনটিই ঘটেছিল।

১১. হকের অনুসরণ করলে পার্থিবভাবেও সফলতা অর্জিত হবে। সফলতা অর্জিত না হলে তার অনুসরণ করা যাবে না-এরূপ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। বনি ইসরাইল এমনটাই করেছিল।

১২. একটা বড় গোমরাহি হচ্ছে মানুষ হক অনুসরণ করার পরিবর্তে হককেই নিজের প্রবৃত্তির গোলাম বানিয়ে ফেলে। শনিবার দিন তাদেরকে মাছ শিকার করতে নিষেধ করা সত্ত্বেও বনি ইসরাইল হিলা-বাহানা করেছিল।

১৩. কেউ সত্য কবুল করুক বা না করুক দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যাওয়া আবশ্যক। কিছু হকপন্থি শনিবার দিনের অসম্মান করা থেকে লোকদের নিষেধ করতেন।

১৪. মানুষের খারাপ কাজের শাস্তিস্বরূপ তাদের উপর জালেম শাসককে চাপিয়ে দেওয়া হয়।

১৫. নিজ সম্প্রদায়কে গোলামির জীবন থেকে মুক্তি দেওয়া নবীদের সুন্নাত।

হজরত মুসা ও ফেরাউনের পরিণতির কথা উল্লেখ করার পর বিভিন্ন আয়াতে মক্কাবাসীদের সতর্ক করা হয়। (৪৭) আহলে কিতাবের মধ্য থেকে যারা ঈমান এনেছে, তাদের প্রশংসা করা হয়েছে। (৫২-৫৫) মুশরিকদের মূর্খতা ও বোকামির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। (৫৭) ধ্বংসশীল দুনিয়ার অর্থ-সম্পদের প্রতারণা থেকে বাঁচার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। (৬০-৬১) কেয়ামতের কিছু দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। (৬২-৬৬) আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি-কুশলতা এবং তার ইচ্ছাশক্তির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। (৬৮)

কারুনের ঘটনা

এসব বিষয়ে আলোচনার পর ফেরাউনের মতো আরেক অহংকারী ও অবাধ্য লোকের আলোচনা করা হয়েছে। তার নাম হচ্ছে কারুন। বংশের দিক থেকে সে মুসা আলাইহিস সালামের আত্মীয় ছিল। অধিকাংশ আলেম তাকে মুসা আলাইহিস সালামের চাচতো ভাই বলে উল্লেখ করেছেন।' সে-সময়ের; বরং বর্তমান বিশ্বের বড় বড় পুঁজিপতির তুলনায় তার সম্পদের পরিমাণ অনেক বেশি ছিল। তার ধনভাণ্ডার নয়; বরং তার চাবি উত্তোলনের জন্যই শক্তিশালী যুবক দলের প্রয়োজন হতো।

সম্পদের প্রাচুর্য তাকে অহংকারী বানিয়ে দিয়েছিল। মুসা আলাইহিস সালাম তাকে বুঝিয়েছেন যে, ধনসম্পদ নিয়ে অহংকার কোরো না। আল্লাহ অহংকারীদের পছন্দ করেন না। আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন, তা দ্বারা পরকালের গৃহ অনুসন্ধান করো। ইহকাল থেকে তোমার অংশ ভুলে যেয়ো না। তুমি মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করো, আল্লাহ তোমার প্রতি যেমন অনুগ্রহ করেছেন। পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। অবৈধ খাতে অর্থ ব্যয় কোরো না।

এসব সদুপদেশ তার মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। আহাম্মক নির্বোধ লোকেরা যেমন উত্তর দেয়, সে তেমনি উত্তর দিয়েছে। সে বলেছে, আমার জ্ঞানের মাধ্যমে আমি এ সম্পদ উপার্জন করেছি। (৭৮)

দুনিয়াদাররা যখন কারুনের ধনসম্পদ দেখত তখন তারা লোভে পড়ে যেত। তারা তার মতো সম্পদ লাভের প্রত্যাশা করত। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা একসময় তাকে তার ধনসম্পদসহ ভূগর্ভে ধসিয়ে দেন। আল্লাহর আজাবের ফলে সেইসব দুনিয়াদারের চক্ষু খুলে যায়। তারা স্বীকার করে, যদি আল্লাহ অনুগ্রহ না করতেন তা হলে আমাদেরকেও তিনি ভূগর্ভে বিলীন করে দিতেন।

কিছু উপদেশ

কারুনের ঘটনার পর কোরআন কিছু উপদেশ প্রদান করেছে, প্রত্যেক মুসলমানের যা অনুসরণ করা উচিত। বলা হয়েছে, 'দুনিয়াতে যারা অহংকার ও অনর্থ সৃষ্টি করতে চায় না, তাদের জন্য আমি পরকাল প্রস্তুত রেখেছি। শুভ পরিণাম মুত্তাকিদের জন্য।'

আজ শুধু সাধারণ মানুষই নয়; বরং দীনদার ব্যক্তিদের মধ্যেও অহংকার ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। যারা এ রোগে আক্রান্ত তাদের জন্য সর্বদা এ আয়াতটি সামনে রাখা উচিত।

সুরার শেষ আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ ছাড়া সবকিছু ধ্বংসশীল। বিধান তারই। তার নিকটই তোমরা ফিরে যাবে।

ফেরাউনের মতো বাদশাহ এবং কারুনের মতো সম্পদশালীদের ভয়ঙ্কর পরিণতি একথার দলিল যে, আল্লাহ ছাড়া সবকিছু ধ্বংসশীল।

সুরা আনকাবুত

এটি মক্কি সুরা।' আয়াতসংখ্যা: ৬৯। রুকুসংখ্যা : ৭

সুন্নাতুল ইবতিলা তথা মানব-জীবনে বিপদ আসবেই

* সবার বিষয় অন্যান্য মকি সুবার মতো। এর আলোচ্য বিষয় হচ্ছে সুন্নাতুল ইবতিলা অর্থাৎ মানব-জীবনে কষ্ট-মুসিবত, বিপদ-আপদ অবশ্যই আসা।

মক্কি জীবনে মুসলমানদের বিভিন্ন ধরনের কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। বিপদ- আপদ যখন একের পর এক লেগেই ছিল, তা আর থামছিল না, তখন কিছু সাহাবি ঘাবড়ে যান। তাদেরকে বোঝানোর জন্য বলা হয়েছে, মুমিনদের পরীক্ষা করা আল্লাহ তায়ালার রীতি। এর মাধ্যমে সত্য ও মিথ্যা এবং প্রকৃত মুমিন ও মুনাফিকের মাঝে পার্থক্য হয়ে যায়। মুমিনকে বড় বড় বিপদের সামনেও অবিচল থাকতে দেখা যায়। আর মুখে মুখে ঈমানের দাবিদারদের পা তখন পিছলে যায়। তাদের অনেকে দুনিয়াবি কষ্ট-মুসিবত থেকে বাঁচার জন্য মুরতাদ পর্যন্ত হয়ে যায়।

বলা হয়েছে, কিছু লোক এমন রয়েছে, যারা বলে আমরা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি। আর আল্লাহর রাস্তায় যখন তারা বিপদের সম্মুখীন হয়, তখন মানুষের দেওয়া কষ্টকে তারা আল্লাহর আজাব মনে করে। যদি তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য এসে পৌঁছায় তখন তারা বলে আমরা তো তোমাদের সঙ্গেই ছিলাম। মানুষের অন্তরে কী আছে আল্লাহ কি তা জানেন না! (১০)

মুমিনদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপদ নবীদের ওপর এসেছে। এ কারণে এ সুরায় হজরত নুহ, হজরত ইবরাহিম, হজরত মুসা, হজরত হারুন আলাইহিমুস সালামের ঘটনা সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। যেন মুমিনরা বুঝতে পারে হকপন্থিদের উপর বিপদ এসেই থাকে। তবে তা স্থায়ী হয় না। পরিশেষে তাদেরই বিজয় হয়। তাদের বিরোধিতাকারীরা নিপাত যায়।

মুশরিকদের মূর্তিগুলোকে মাকড়সার সঙ্গে তুলনা দেওয়া হয়েছে। যেমনভাবে মাকড়সার জাল অত্যন্ত দুর্বল হয়ে থাকে, এ জাল মাকড়সাকেই শীত-গরম ও প্রচণ্ড বাতাসে কোনোকিছু থেকে রক্ষা করতে পারে না, তেমনিভাবে মুশরিকদের মূর্তিগুলো তাদেরকে কোনো ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারে না। কোনো ধরনের উপকারও করতে পারে না।

চলবে ইনশাআল্লাহ...

লেখক: আলেম ও ওয়ায়েজ; খতিব, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মিরপুর-০১।

(ঢাকাটাইমস/৩০মার্চ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
শেফালির শেষ বিদায়ে হাতজোড় করে যা বললেন তার স্বামী
মাদরাসার ১০ বছরের ছাত্রকে পিটিয়ে বস্তায় ভরে ছাদে ফেলে রাখলেন শিক্ষক
আজ থেকে দেশে স্বর্ণ বিক্রি হবে নতুন দামে
উত্তরায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ওপর উঠে গেল ট্রাক, নিহত ৩
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা