ধারাবাহিক তাফসির, পর্ব-১৯
লুত আ. এর স্ত্রীকে যে কারণে আল্লাহ পাথরে পরিণত করেন
প্রিয় পাঠক,
ঢাকা টাইমসের আয়োজনে আজ আমরা কোরআনুল কারীমের ১৯তম পাড়া থেকে ধারাবাহিক তাফসিরের আয়োজনে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। ১৯ তম পারা শুরু হয়েছে সূরা ফোরকান এবং শেষ হয়েছে সূরা নামলের কিছু অংশে । সূরা ফুরকানের বিশেষ চমকপ্রদংশ হল রহমানের বান্দাদের গুণাবলি...
আগের পর্ব: আল্লাহ যে কারণে নারীদের সূরা নূর শেখাতে বলেছেন
সূরা ফুরকান
এটি মাক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৭৭। রুকু সংখ্যা: ৬
কোরআন ও সাহিবুল কোরআনের সত্যতা
এ সূরার প্রথম দুই রুকু আঠারোতম পারার শেষাংশে স্থান পেয়েছে। কোরআনের মহত্ত্বের আলোচনার মাধ্যমে এর সূচনা হয়েছে। কোরআনের ব্যাপারে মুশরিকরা বিভিন্ন আপত্তি উত্থাপন করত। এর আয়াতসমূহ মিথ্যা প্রতিপন্ন করত। কিছুলোক একে পূর্ববর্তীদের কিসসা-কাহিনি আখ্যা দিতো। অপর কিছুলোক আল্লাহর কালামকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বানানো কিতাব বলত। তারা বলত, এক্ষেত্রে আহলে কিতাবরা তাকে সাহায্য করেছে। তৃতীয় দল বলত, এটা সুস্পষ্ট জাদু।
কোরআনের আলোচনার পর সাহিবুল কোরআন তথা রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। হঠকারী লোকেরা তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করত। তাদের ধারণা ছিল, মানুষ কখনো নবী হতে পারে না। নবী হতে পারে কেবল ফেরেশতারাই। আর মানুষকে কখনো নবী বানানো হলেও কোনো দরিদ্র এতিমকে নবী বানানো হতো না; বরং ধনাঢ্য ও নেতৃস্থানীয় লোকেরাই নবী হতে পারেন। (৭-৯)
আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে তাদের ভ্রান্ত আপত্তি খণ্ডন করেছেন। উনিশতম পারার শুরুতেও মুশরিকদের দাবি এবং বিভিন্ন আপত্তি খণ্ডন করা হয়েছে। উদাহরণত তারা বলেছিল, আমাদের উপর কেন ফেরেশতা অবতীর্ণ করা হয় না? আমরা কেন আমাদের প্রতিপালককে দেখতে পারি না? (২১)
এর উত্তরে বলা হয়েছে, ফেরেশতা যখন রুহ কবজ করার জন্য আসবে তখনই কেবল তাদেরকে দেখতে পাবে। আর যখন তাদেরকে দেখতে পাবে তখন এটা কোনো সুসংবাদ বয়ে আনবে না। যেহেতু আমল কবুল হওয়ার মৌলিক শর্ত ঈমানই তাদের নেই। এ কারণে কেয়ামতের দিন তাদের কোনো আমলই তাদের কাজে আসবে না। সব ছাই হয়ে যাবে। সেদিনটি তাদের জন্য অত্যন্ত পেরেশানির দিন হবে। আক্ষেপবশত তারা হাত কামড়াতে থাকবে। আর বলতে থাকবে, হায়, যদি আমরা নবীদের রাস্তা অনুসরণ করতাম! সেদিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে অভিযোগ করবেন, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমার সম্প্রদায় এ কোরআন পরিত্যাগ করেছিল।’
ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, কোরআন পরিত্যাগের বিষয়টি কয়েকভাবে হতে পারে। এক. কোরআন না শোনা এবং তার ওপর ঈমান না আনা। দুই. কোরআন তেলাওয়াত করা, তার উপর ঈমান আনা। কিন্তু তার ওপর আমল না করা। তিন. বিবাদ-বিসংবাদে কোরআনকে ফয়সালাকারী না মানা। চার. কোরআনের অর্থ নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা না করা। পাঁচ. কোরআন দিয়ে অন্তরের রোগ দূর না করা।
একটু থামুন, একটু ভাবুন
প্রিয় পাঠক, এখানে একটু থামুন। একটু চিন্তা করুন। নিজের ব্যাপারে এবং গোটা জাতির ব্যাপারে একটু ভাবুন। আমরা কীভাবে কোরআন পরিত্যাগ করে বসে আছি! আজ আমরা বহু আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক ব্যাধিতে আক্রান্ত; অথচ আমরা তার সুনিশ্চিত প্রতিষেধক ঐশী ওষুধ গ্রহণ করি না। ফলে প্রতিনিয়ত আমাদের রোগ-ব্যধি বেড়েই চলেছে। ক্রমেই আমরা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছি।
মুশরিকরা এই আপত্তিও করত যে, তাওরাত-ইনজিল যেভাবে একত্রে অবতীর্ণ হয়েছে কোরআন কেন সেভাবে একসঙ্গে অবতীর্ণ করা হলো না? বলাবাহুল্য, অল্প অল্প করে কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার বহু হেকমত রয়েছে। উদাহরণত, তা মুখস্থ করা, তার অর্থ বোঝা, বিধান আয়ত্ত করা, সহজে আমল করা প্রভৃতি।
কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এখানে শুধু একটি হেকমতের কথা উল্লেখ করেছেন। তা হচ্ছে অল্প অল্প করে অবতীর্ণ করার ফলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তর প্রতিনিয়ত কোরআনের নূর দ্বারা আলোকিত হয়ে থাকে। কোরআনের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে তার রুহ-অন্তর শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আমরা অনেকেই জানি যে, হঠাৎ প্রবল বর্ষণ হলে খেত-খামার ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু ধীরে ধীরে উপযোগী সময়ে বৃষ্টি হলে এতে অনেক উপকার হয়।
এসব আপত্তির পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শান্তনা দেওয়ার জন্য হজরত মুসা, হারুন, নুহ, হুদ ও হজরত সালেহ আলাইহিমুস সালামের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতা ও একত্ববাদের দলিল উল্লেখ করা হয়েছে। (৪৫-৪৯)
রহমানের বান্দাদের গুণাবলি
এই সুরার শেষে ইবাদুর রহমান তথা রহমানের বান্দাদের গুণাবলি বর্ণনা করা হয়েছে।
এক. বিনয় (ভূমিতে নম্রভাবে চলাফেরা করা)। দুই. মুর্খদের সঙ্গে তর্কে না জড়ানো। তিন. রাতে নামাজ ও ইবাদত করা। চার. জাহান্নামের শাস্তির ভয় (আল্লাহর কাছে তা থেকে মুক্তির দোয়া করে। পাঁচ. খরচের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন। অর্থাৎ অপচয় না করা আবার কার্পণ্যও না করা। ছয়. শিরক থেকে পুরোপুরি বেঁচে থাকা। সাত. অন্যায়ভাবে হত্যা না করা। নয়. ব্যভিচার ও অপকর্ম থেকে বেঁচে থাকা। দশ. মিথ্যা সাক্ষ্য না দেওয়া। একারো. গান-বাজনা ও গুনাহের মজলিসে না যাওয়া। বারো. আল্লাহর কিতাব দ্বারা প্রভাবিত হওয়া। তার দ্বারা উপকৃত হওয়া। তের. আল্লাহর কাছে চক্ষু শীতল করে এমন উত্তম স্ত্রী-সন্তানের জন্য দোয়া করা। এই দোয়া করা যে, হে আল্লাহ, আপনি আমাদেরকে মুত্তাকিদের ইমাম বানিয়ে দিন (৬৩-৭৪)
প্রিয় পাঠক, আসুন আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি, দয়াময় আল্লাহ তায়ালা যেন স্বীয় অনুগ্রহে উল্লিখিত গুণগুলো আমাদেরকে দান করেন। আমরাও যাতে ইবাদুর রহমানের কাতারে শামিল হতে পারি। আমিন, ছুম্মা আমিন।
সূরা শুআরা
এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ২২৭। রুকু সংখ্যা: ১১
সবচেয়ে বড় নেয়ামত কোরআন
সূরাটি হরফে মুকাত্তায়াত-ত্ব-সীন-মীম দ্বারা শুরু হয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রের ন্যায় এখানেও হরফে মুকাত্তায়াতের পর সবচেয়ে বড় নেয়ামত কোরআনের আলোচনা করা হয়েছে। কোরআনের বিধান উম্মতের নিকট পৌঁছানোর জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত উদগ্রীব ছিলেন। এমনকি তিনি এজন্য জীবনধ্বংসের ঝুঁকিও নিয়ে নিয়েছিলেন। (২-৩) পক্ষান্তরে বিরোধীদের নিকট যখনই কোনো নসিহত ও হেদায়েত আসতো, তারা তা প্রত্যাখ্যান করত। আর এ প্রত্যাখ্যান করাকে তারা আবশ্যক দায়িত্ব মনে করত। (৫-৬)
বিভিন্ন নবীর ঘটনা
এ সূরায় বিভিন্ন নবীর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে।
এক.
প্রথমে মুসা আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তাকে নবুওয়াত প্রদান করে ফেরাউনের নিকট যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ পালনার্থে প্রভুত্বের দাবিদার ফেরাউনের নিকট যান। তখন তার ও ফেরাউনের মাঝে যে আলোচনা সংঘটিত হয় এ সূরায় তার কিয়দংশ তুলে ধরা হয়েছে।
ফেরাউন সর্বপ্রথম মুসা আলাইহিস সালামের উপর কৃত অনুগ্রহের কিছু কথা উল্লেখ করে।
ফেরাউন: আমি তোমাকে প্রতিপালন করেছি।
মুসা: তুমি আমার সম্প্রদায়কে গোলাম বানানো সত্ত্বেও কীভাবে এ অনুগ্রহের
কথা বলছো? ফেরাউন মুসা আলাইহিস সালামের হাতে অনিচ্ছাকৃতভাবে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি তুলে আনে।
মুসা: আমি তাকে স্বেচ্ছায় হত্যা করিনি; বরং ভুলক্রমে এটা সংঘটিত হয়ে গেছিল। (অর্থাৎ এক আঘাতে সে মারা যাবে এটা আমার জানা ছিল না।)
ফেরাউন: রাব্বুল আলামিন আবার কী?
মুসা: রাব্বুল আলামিন সেই সত্তা, যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। এই দুয়ের মাঝে তারই নির্দেশ পরিচালিত হয়। তিনিই তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। তোমার পিতৃপুরুষদেরও তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি পূর্ব দিক থেকে সূর্য উদিত করেন আর পশ্চিম দিকে তা অস্তমিত করেন।
ফেরাউন প্রথমে উলটাপালটা কথা বলেছে। কিন্তু মুসা আলাইহিস সালাম রাব্বুল আলামিনের পরিচয় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন। এরপর সে কঠোর হয়ে যায়। মুসা আলাইহিস সালামের নিকট মুজিজা দেখতে চায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি মাটিতে লাঠি ফেলেন। তা এক বিশাল সাপে রূপান্তরিত হয়ে যায়। কাপড় থেকে হাত বের করেন, আর তা সূর্যের মতো চমকাতে থাকে।
এর ফলে ফেরাউন ও তার দরবারিদের চোখে ধাঁধা লেগে যায়। এই মুজিজাকে তারা জাদু বলে উড়িয়ে দেয়। সভাসদের পরামর্শে মুসা আ.কে অপমানিত করার জন্য মিসরের নামিদামি জাদুকরদের একত্র করে ফেরাউন। মিসরবাসীদের বার্ষিক আনন্দ ও ঈদের দিন এক বিশাল মাঠে লক্ষ জনতার সামনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। জাদুকরদের ফেলানো রশি ও লাঠিগুলো সাপের মতো দেখাচ্ছিল। আর মুসা আলাইহিস সালাম যখন তার লাঠি নিক্ষেপ করেন তখন তা সব জাদুর সাপ গিলে ফেলে। গোটা ময়দান পরিষ্কার হয়ে যায়।
জাদুকররা বাস্তবতা বুঝে ফেলে। তৎক্ষণাৎ তারা রাব্বুল আলামিনের দরবারে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। ফেরাউনের হুমকি-ধমকি সত্ত্বেও তারা ঈমানের ওপর অটল থাকে। মুসা আলাইহিস সালাম বনি ইসরাইলকে নিয়ে রাতের আঁধারে মিসর থেকে বেরিয়ে যান। সকাল হলে ফেরাউন লক্ষ সৈন্যের বাহিনী নিয়ে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে। পরিশেষে সে নদীর তীরে তাদের দেখতে পায়। বনি ইসরাইলের জন্য নদীর মাঝে রাস্তা হয়ে যায়। বনি ইসরাইল তা দিয়ে পার হয়ে যায়। ফেরাউন সে রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করতে গেলে লোকবলসহ ডুবে যায়। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা পাওয়া যায় যে, পরিশেষে সত্যের জয় হয় আর সবসময় জালেমদের ধ্বংস হয়। (১০-৬৮)
দুই.
এরপর ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ঘটনা-বৃত্তান্ত বর্ণনা করা হয়েছে। তার পিতা আজর ও তার সম্প্রদায় প্রতিমা পূজা করত। তিনি তাকে অত্যন্ত হেকমতের সাথে ঈমান ও তাওহিদের দাওয়াত দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি পাঁচটি দলিল এবং আল্লাহর পাঁচটি গুণের কথা উল্লেখ করেন।
১. তিনি আমার স্রষ্টা, পথপ্রদর্শনকারী।
২. তিনি আমাকে রিজিক দান করেন।
৩. তিনি অসুস্থতা থেকে আরোগ্য দান করেন।
৪. তিনি মৃত্যু দেন, তিনি জীবিত করেন।
৫. দুনিয়া ও আখেরাতে তিনি গুনাহ ক্ষমাকারী।
এ পাঁচটি গুণ উল্লেখ করার পাশাপাশি তিনি পাঁচটি দোয়া করেন, যা তার ঈমানের পূর্ণতার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে।
১. হে আল্লাহ, আমাকে হেকমত ও প্রজ্ঞা দান করুন এবং নেককারদের অন্তর্ভুক্ত করুন।
২. পরবর্তী লোকদের মধ্যে আমার সুনাম ছড়িয়ে দিন।
৩. জান্নাতে আমার জন্য একটি ঠিকানা দান করুন।
৪. আমার পিতাকে ক্ষমা করে দিন (যখন তার পিতা কুফরের উপর থাকার বিষয়টি তার নিকট স্পষ্ট ছিল না তখন তিনি এই দোয়া করেছিলেন)।
৫. দয়া করে আমাকে আখেরাতে আমাকে অপদস্থ ও লাঞ্ছিত করবেন না।
ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ঘটনার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারলাম, মানুষকে সর্বদা আল্লাহর প্রতি নিবিষ্ট হওয়া উচিত। (৬৯-১০৪)
তিন.
এরপর নুহ আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে, যিনি স্বীয় সম্প্রদায়কে সাড়ে নয়শত বছর ঈমানের দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু তারা দাওয়াত কবুল করেনি। এই কারণে তাদের সবাইকে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি আল্লাহ যাকে চান সে-ই কেবল হেদায়েত পেতে পারে। (১০৫-১২)
চার.
এরপর চতুর্থ পর্যায়ে হযরত হুদ আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে, যিনি আদ সম্প্রদায়ের নিকট নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন। শারীরিক শক্তি, সুদীর্ঘ বয়সকাল ও জীবনযাপনের দিক থেকে তারা পৃথিবীর এক অনন্য জাতি ছিল। প্রয়োজন ছাড়াই-বা বাহাদুরি দেখানোর উদ্দেশ্যে তারা বড় বড় অট্টালিকা নির্মাণ করে রেখেছিল। তারাও ঈমানের দাওয়াত কবুল করেনি। তাই একসময় তাদের ওপর আল্লাহর আজাব নেমে আসে। তাদের ঘটনা থেকে শিক্ষা পাওয়া যায় যে, অপচয়, ভোগ-বিলাস, প্রয়োজন ব্যতীত অট্টালিকা নির্মাণ এবং অহংকারের পরিণতি কখনো শুভ হয় না। (১২৩-১৪০)
পাঁচ.
পঞ্চম পর্যায়ে হযরত সালেহ আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। তার সম্প্রদায় প্রাচুর্যময় রিজিক, শান্তি-নিরাপত্তা ও বস্তুগত বহু উপকরণের অধিকারী ছিল। তাদের সবুজ-শ্যামল বাগবাগিচা ছিল। কিন্তু তারা আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা আদায় করেনি। তাই এক প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের মাধ্যমে তাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। অকৃতজ্ঞ জাতির পরিণাম এমনই হয়ে থাকে। (১৪১-১৫৯)
ছয়.
ষষ্ঠ পর্যায়ে হযরত লুত আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তারা পাপাচার, অনাচার, প্রবৃত্তিপূজা ও অপকর্মের ক্ষেত্রে সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তারা এমন অপকর্মে লিপ্ত হতো ইতিপূর্বে, যা কেউ-ই করেনি। এমনকি চতুষ্পদ জন্তু-জানোয়ারও একে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে থাকে। আকাশ থেকে তাদের ওপর পাথরের বৃষ্টি বর্ষিত হয়। পৃথিবী থেকে তাদের নাম-গন্ধ মুছে ফেলা হয়। অন্যান্য ঘটনার ন্যায় আল্লাহ তায়ালা এই ঘটনারও শেষে বলেছেন, নিঃসন্দেহে এতে নিদর্শন রয়েছে। তাদের অধিকাংশই ঈমান আনয়নকারী ছিল না।
এ থেকে শিক্ষা পাওয়া যায় যে, প্রবৃত্তিপূজক ও সীমালঙ্ঘনকারীদের পরিণাম কখনোই ভালো হয় না। (১৬০-১৭৫)
সাত.
সপ্তম পর্যায়ে শোয়াইব আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। তার সম্প্রদায়কে আল্লাহ তায়ালা অনেক নেয়ামত দিয়েছিলেন। তাদের ঘন উদ্যান ছিল। ফল-ফলাদিতে পূর্ণ বাগান ছিল। মিঠা পানির ঝরণা ছিলো। কিন্তু তারা আল্লাহ তায়ালার অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছিল।
তাদের প্রধান পাপাচার এটা ছিলো যে, তারা বান্দার হক আদায়ে টালবাহানা করত। বোঝানোর পরেও যখন তারা বোঝেনি এবং বিরত থাকেনি তখন আল্লাহ তাদের ব্যাপারে আজাবের ফয়সালা করেন। কয়েকদিন প্রচণ্ড গরম পড়ে। এরপর তাদের আকাশ মেঘে ছেয়ে যায়। তারা ঠান্ডা অনুভব করার জন্য মেঘের নিচে একত্র হয়। কিন্তু মেঘ থেকে আগুন বর্ষিত হয়। জমিনে ভূকম্পন শুরু হয়। মুহূর্তেই তারা কয়লা হয়ে যায়। (১৭৬-১৯১)
শোয়াইব আ. এর ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা পাই যে, বান্দার হক আত্মসাৎ করার ফলে তাদের ওপর আল্লাহর আজাব-গজব নেমে আসে। যেভাবে কোরআনের আলোচনার মাধ্যমে এ সূরাটি শুরু হয়েছে তেমনিভাবে কোরআনুল কারিমের মাধ্যমে তাদের ভ্রান্ত আপত্তি খণ্ডন করে এ সুরার সমাপ্তি টানা হয়েছে। (২২১-২২৭)
সূরা নামল
এটি মক্কি সুরা। আয়াত সংখ্যা: ৯৩। রুকু সংখ্যা: ৭
নামকরণ
এটিও হরফে মুকাত্তায়াত ত্ব-সীন দ্বারা শুরু হয়েছে। নামল অর্থ পিপীলিকা। এ সূরায় পিপীলিকার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে বিধায় একে সূরা নামল বলা হয়।
বিশেষ তিনটি সূরা
এই সূরার একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এটি সেই তিন সূরার একটি, যা যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছে সে ধারাবাহিকতায়ই কোরআনে স্থান পেয়েছে। তা হচ্ছে শুআরা, নামল ও কাসাস। হরফে মুকাত্তায়াতযুক্ত অন্যান্য সূরার ন্যায় এটিও কোরআনুল কারিমের শ্রেষ্ঠত্ব ও পরিচয়ের মাধ্যমে শুরু হয়েছে। বলা হয়েছে, এ কিতাব মুমিনদের জন্য হেদায়েত। (১-৩)
কয়েকজন নবীর ঘটনা
এরপর সংক্ষেপে হযরত মুসা, হযরত সালেহ, হযরত লুত আলাইহিমুস সালামের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। আর হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম এবং তার পুত্র হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের ঘটনা কিছুটা বিস্তারিত এবং বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মানবজাতি, জিনজাতি এবং পক্ষীকুলরে হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের অধীন করে দিয়েছিলেন। তিনি পাখিদের ভাষা বুঝতেন। তার যেসব অবস্থা আল্লাহ তায়ালা কোরআনে আলোচনা করেছেন, নিম্নে তার কিছু তুলে ধরা হল:
হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম একদিন পিপীলিকার উপত্যকা দিয়ে লোক-লশকর নিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি শুনতে পেলেন, এক পিপীলিকা অন্যান্য পিপীলিকাকে বলছে, তোমরা দ্রুত গর্তে ঢুকে পড়ো, যেন সুলাইমান আলাইহিস সালাম এবং তার বাহিনী অজান্তে তোমাদেরকে পিষে না ফেলে। তিনি পিপীলিকার কথা শুনে মুচকি হাসেন। তিনি আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন যে, আপনি আমাকে অনেক নেয়ামত দিয়েছেন। (পাখি ও প্রাণীদের ভাষা বোঝার ক্ষমতা দিয়েছেন।) (১৮-১৯)
হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের দরবারে সবসময় হুদহুদ পাখি থাকত। সে একবার তাকে ‘সাবা’ রাজ্য এবং তার অধিবাসীদের ব্যাপারে সংবাদ দেয়। সে জানায় যে, তারা সূর্যপূজা করে। তিনি চিঠি লিখে সাবার রানিকে তার নিকট আসতে বলেন। সাবার রানি স্বীয় বস্তুগত উপকরণ নিয়ে অনেক গর্ব করতেন। কিন্তু যখন তিনি সুলাইমান আলাইহিস সালামের নিত্যনতুন উপকরণ ও তার মহল দেখতে পেলেন তখন তিনি নিজের শক্তি-সামর্থ্যের দুর্বলতা অনুভব করতে পারলেন। ফলে তিনি ইসলাম কবুল করে নেন। (২০-৪৪)
সুলাইমান আলাইহিস সালামের পর সংক্ষেপে সালেহ আলাইহিস সালাম ও লুত আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। সালেহ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়কে ঈমানের দাওয়াত দিলে তারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে যায়; মুমিন ও কাফের। কাফেরদের মধ্যে নেতা পর্যায়ের নয় ব্যক্তি ছিলো। তারা পরস্পর শপথ করেছিল, রাতে আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে নবীকে হত্যা করে ফেলবে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হওয়ার পূর্বেই আল্লাহ তাদেরকে পাকড়াও করেন। আল্লাহ বলেন, ‘আজ তাদের স্মরণ করার মতো কেউ-ই নেই।’ (৪৫-৫৩)
হযরত লুত আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের দৃষ্টিশক্তি এতটাই ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল যে তাদের অন্তর এতটাই গোমরাহিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল যে, তারা পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট কর্মকে ভালো মনে করতে শুরু করেছে। তাদের দৃষ্টিতে সেই ব্যক্তি সবচেয়ে বড় অপরাধী ছিলো— যে এ কাজ খারাপ মনে করত। আর যে-ব্যক্তি মাথা থেকে পা পর্যন্ত এ গুনাহে লিপ্ত থাকত, তাকে তারা বুদ্ধিমান মনে করত। তাদের এ রীতি বর্তমানেও পাওয়া যায়। যারা হকের ওপর চলে, তাদেরকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা হয়। আর যারা মন্দ পথে চলে, তাদেরকে আধুনিক ও উন্নত চিন্তার অধিকারী মনে করা হয়।
দুনিয়াবী উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হওয়ার কারণে তারা সীমা লঙ্ঘনকারী জাতিতে পরিণত হয়েছিল। একই সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে শিরক ও কুফরীতে লিপ্ত হয় তারা। পূর্বেকার ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলির ন্যায় তারা চূড়ান্ত বিলাস-ব্যসনে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল। অন্যায়-অনাচার ও নানাবিধ দুষ্কর্ম তাদের মজ্জাগত অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। এক পর্যায়ে সমকামিতার মতো নোংরামিতে সয়লাব হয়ে যায় গোটা জাতি, পূর্বের কোনো জাতির মধ্যে যা কখনো পরিলক্ষিত হয়নি।
ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করো লুতের কথা, তিনি তার কওমকে বলেছিলেন, তোমরা কেন অশ্লীল কাজ করছ? অথচ-এর পরিণতির কথা তোমরা অবগত আছ! তোমরা কি কামতৃপ্তির জন্য নারীদেরকে ছেড়ে পুরুষে উপগত হবে? তোমরা তো এক বর্বর সম্প্রদায়। উত্তরে তার কওম শুধু এ কথাটিই বলল, লুত পরিবারকে জনপদ থেকে বের করে দাও। এরা তো এমন লোক যারা শুধু পাকপবিত্র সাজতে চায়। অতঃপর তাকে ও তার পরিবারবর্গকে উদ্ধার করলাম তার স্ত্রী ছাড়া (লুত আ. এর স্ত্রী ওয়াহিলা তার কওমকে সমকামিতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করত)। কেননা, তার (ওয়াহিলা) জন্য ধ্বংসপ্রাপ্তদের ভাগ্যই নির্ধারিত করেছিলাম। আর তাদের (কওম) ওপর বর্ষণ করেছিলাম মুষলধারে বৃষ্টি। সেই সতর্ককৃতদের ওপর কতই না মারাত্মক ছিলো সে বৃষ্টি।’(আয়াত ৫৪-৫৮)।
এ পর্যায়ে তাদের জনপদকে উলটে দেওয়া হয়। তাদের উপর পাথরের বৃষ্টি বর্ষণ করা হয়। বর্তমানে তারা গোটা বিশ্বের জন্য শিক্ষার উপকরণ হয়ে রয়েছে। (৫৪-৫৯) এ ঘটনায় কওমে লুত পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। গোটা জাতির বসবাসের এলাকাকে আল্লাহ তাআলা উল্টে দেন এবং নবী লুত আ. এর অবাধ্য স্ত্রীকে পাথরে পরিণত করে দেন।। যা এখনো পৃথিবীরবাসীর জন্য নিদর্শন হয়ে আছে। অভিশপ্ত সেই এলাকাটিই এখনকার ডেড সি বা মৃত সাগর। যা ফিলিস্তিন ও জর্ডানের মধ্যবর্তী এলাকায় রয়েছে। এমনকি লুত আলাইহিমুস সালামের স্ত্রী ওয়াহিলার পাথরের মূর্তি এখনো মৃত সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে অভিশাপের স্মৃতিচিহ্ন হয়ে।
চলবে ইনশাআল্লাহ....
লেখক: আলেম ও ওয়ায়েজ; খতিব, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মিরপুর-০১।
(ঢাকাটাইমস/২৯মার্চ/এসআইএস/)