ধারাবাহিক তাফসির, পর্ব-১৮

আল্লাহ যে কারণে নারীদের সূরা নূর শেখাতে বলেছেন

মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবিবী
| আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৯:৫৬ | প্রকাশিত : ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৯:৫৪

প্রিয় পাঠক,

আজ আমরা পবিত্র কোরআনুল কারীমের ১৮তম পারার সূরা মু’মিনুন থেকে মুমিন জীবনের সফলতা লাভের কর্মসূচি দিয়ে শুরু করবো এবং শেষ করবো সূরা নূরের কতগুলো বিধান ও আদব দিয়ে ইনশাআল্লাহ।

আগের পর্ব: কোরআনের মোজেজা, কেয়ামত ও পুনরুত্থান

সূরা মু’মিনুন

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ১১৮। রুকু সংখ্যা: ৬

মুমিনের মৌলিক গুণাবলি

সূরা মুমিনুনের মাধ্যমে আঠারোতম পারা শুরু হয়েছে এবার দীনের মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সূরার শুরুর ৯ আয়াতে মুমিনদের সাতটি স্তরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যার মাধ্যমে তারা জান্নাতুল ফেরদাউসপ্রাপ্ত হতে পারে।

গুণগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হল-

১. লৌকিকতা ও কপটতামুক্ত সঠিক ঈমান।

২. নামাজে খুশু-খুজু তথা বিনয় ও নম্রতার সঙ্গে আল্লাহর সামনে দাঁড়ানো।

৩. অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা।

৪. সঠিকভাবে জাকাত আদায় করা। অর্থাৎ আল্লাহর হক আদায়ের সাথে সাথে বান্দার হক আদায়েও যত্নবান হওয়া।

৫. ব্যভিচার ও অশ্লীলতা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা।

৬. আমানতের হেফাজত করা এবং ওয়াদা পূরণ করা।

৭. নামাজের প্রতি যত্নবান হওয়া। সময়, রোকন ও আদবের প্রতি লক্ষ রেখে তা পালন করা।

কতটা সত্য এ কোরআন!

মুমিনদের গুণাবলি উল্লেখ করার পর মানব-জীবন এবং মানুষের সৃষ্টির বিভিন্ন ধাপে ঈমানের যেসব দলিল রয়েছে, তা উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআন হাজার বছর পূর্বেই মাতৃগর্ভে মানব-শিশুর বিভিন্ন ধাপ অতিবাহিত করার কথা উল্লেখ করেছে। অথচ তৎকালীন আরব-অনারব কারোরই এ ব্যাপারে কোনো জ্ঞান ছিলো না। আজকের আধুনিক বিজ্ঞান ও মেডিকেল সাইন্সের গবেষণা মানব-সৃষ্টির ধাপগুলো নিয়ে যা বলছে, হাজার বছর আগেই কোরআন তা মানুষকে জানিয়ে দিয়েছে।

সৃষ্টিজগৎ কার অস্তিত্ব ঘোষণা করে?

মানুষের অস্তিত্বের মাধ্যমে ঈমানের দলিল উল্লেখ করার পর তিন ধরনের তাকবিনি দলিলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

১. সাত আকাশে ও তাতে যেসব আশ্চর্য মাখলুক রয়েছে তাদের সৃষ্টি।

২. বৃষ্টিবর্ষণ এবং তার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ফল-ফলাদি উৎপন্ন হওয়া।

৩. চতুষ্পদ জন্তু এবং তার মাধ্যমে দুধ, মাংস ও বোঝাবহনের উপকারিতা অর্জন।

কয়েকজন নবীর ঘটনা

আল্লাহ তায়ালার কুদরত এবং তার একত্ববাদের দলিল উল্লেখ করার পর নবীদের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে হযরত নুহ, হযরত হুদ, হযরত সালেহ, হযরত মুসা, হযরত হারুন, হযরত ঈসা বিন মারিয়াম আলাইহিমুস সালামের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। (৩৩-৫০)

অন্যায় বিভক্তি

এ সকল নবীর দাওয়াত এক ও অভিন্ন ছিল। তাদের উদ্দেশ্য একটাই ছিলো। মনে হয় তারা সকলে একই যুগে একই শহরে প্রেরিত হয়েছিলেন; কিন্তু এসব নবী দাওয়াতি কাজ শুরু করার পর তাদের সম্প্রদায় বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রত্যেক দলই স্বীয় মত নিয়ে তুষ্ট থাকে।

আজ মুসলমানদের অবস্থা একই রকম। কোরআন, নবী ও কেবলা এক থাকা সত্ত্বেও মুসলমানরা আজ শতধা বিভক্ত।

মতানৈক্য দূর করার একমাত্র পথ হচ্ছে দল-মত নির্বিশেষ সকলেরই কোরআন-সুন্নাহর সামনে মাথা নত করে দেওয়া। এক্ষেত্রে মৌলিকভাবে দুটি দল রয়েছে। এক দল পরস্পর দলাদলি হানাহানিতে লিপ্ত। তারা গাফলতি ও অজ্ঞতায় ডুবে আছে। অপর দল আল্লাহর নেক বান্দা। তাদের পরস্পরের মধ্যে মহব্বত ও ভালোবাসা রয়েছে। তাদের অন্তর হেদায়েতের নুরে আলোকিত। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চারটি গুণ পাওয়া যায়।

১. তারা আল্লাহর আজাবকে ভয় করে।

২. তারা তাকবিনি ও তাশরিয়ি বিষয়ের প্রতি ঈমান রাখে।

৩. তারা লৌকিকতা থেকে বেঁচে থাকে। তারা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমল করে। ৪. তাদের মধ্যে ইহসান রয়েছে। অর্থাৎ নেক আমল করা সত্ত্বেও তারা সব সময় ভয়ের মধ্যে থাকে যে, এই আমল কবুল হলো কি না। এসব সত্যিকারের মুমিনের বিপরীতে কিছু কিছু হতভাগা কোরআন ও নবীকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে।

কোরআনে তাদের অবাধ্যতার তিনটি বড় কারণ উল্লেখ করা হয়েছে:

১. তারা বিবেক খাটায় না। বরং কোরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করার পরিবর্তে তারা তা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে।

২. তারা আল্লাহর রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। তারা তো বলে রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিত্ব, বংশ, তার সত্যবাদিতা ও আমানতদারি সবকিছু সম্পর্কেই সম্যক অবগত। তারা জানে তিনি যা বলছেন তা মিথ্যা নয়।

৩. এটি প্রশ্নের ভঙ্গিতে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে কি তোমরা (নাউজুবিল্লাহ) পাগলামি দেখতে পেয়েছো? নিঃসন্দেহে তাদের কেউ কেউ তাকে পাগল আখ্যা দিতো। কিন্তু (নাউজুবিল্লাহ) তাকে পাগল মনে করাটা তাদের ঈমান না আনার কারণ নয়; বরং প্রকৃত কারণ হচ্ছে, তারা হক অস্বীকার করে। হককে নিজেদের প্রবৃত্তির গোলাম বানাতে চায়। অথচ হক তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করলে বিশ্বজগতের ব্যবস্থাপনা ধ্বংস হয়ে যেত।

কেয়ামতের দিন মানুষ দু-দলে বিভক্ত হবে

তাওহিদের প্রমাণ উল্লেখ ও শিরক প্রত্যাখ্যানের পর সূরার শেষে বলা হয়েছে, কেয়ামতের দিন মানুষ দু-দলে বিভক্ত হয়ে যাবে; সফল ও হতভাগা। সফলদের আমলনামা অত্যন্ত ভারী হবে। দুর্ভাগাদের আমলনামা হবে হালকা। সেখানে কোনো পরিচয়-পরিচিতি কাজে আসবে না। কাফেররা দুনিয়ায় ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করবে। কিন্তু তাদের আশা পূরণ হবে না। তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে যে, দুনিয়াতে তারা মুমিনদের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছে। আজ

তাদের জন্য অপদস্থতা ছাড়া কিছুই নেই।

এরপর তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে দুনিয়াতে তোমরা কত বছর ছিলে? তারা বলবে আমরা মাত্র একদিন বা একদিনেরও কম সময় অবস্থান করেছিলাম। এরপর আল্লাহ বলবেন, তোমরা সেখানে খুব সামান্য সময় অবস্থান করেছো। হায়, যদি তোমরা জানতে! অর্থাৎ যদি তোমাদের জ্ঞানবুদ্ধি থাকত তা হলে তোমরা বুঝতে পারতে যে, দুনিয়ার জীবন নিতান্তই তুচ্ছ ও সামান্য। প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাদেরকে অনুশোচনায় ফেলা। সেদিন তাদেরও দুনিয়ার জীবনের তুচ্ছতা ও সীমাবদ্ধতার অনুভূতি জাগ্রত হবে।

তাফসিরে ইবনে কাসিরে রয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা যখন জান্নাতিদের জান্নাতে আর জাহান্নামিদের জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন তখন জিজ্ঞেস করবেন, হে জান্নাতবাসীরা, তোমরা পৃথিবীতে কত বছর ছিলে? তারা বলবে একদিন বা একদিনের কিছু অংশ। আল্লাহ বলবেন, ‘তোমরা এই এক দিন বা তারও সামান্য সময় ব্যবসা করে আমার রহমত, সন্তষ্টি ও জান্নাত ক্রয় করেছ। এখন তোমরা সর্বদা এখানে থাকবে। এরপর আল্লাহ তায়ালা জাহান্নামিদের জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা দুনিয়াতে কত বছর ছিলে? তারাও জান্নাতিদের অনুরূপ উত্তর দেবে। আল্লাহ বলবেন, তোমরা দুনিয়াতে সামান্য সময়ই অবস্থান করেছিলে। তোমরা সে-সময়ে বড় বড় ব্যবসা করেছ, যার মাধ্যমে আমার ক্রোধ, অসন্তোষ ও জাহান্নাম ক্রয় করেছ। এখন তোমরা এখানেই পড়ে থাকো।’

শেষআয়াতে আল্লাহ তায়ালা নবীর মাধ্যমে যেন গোটা মানবজাতিকে শিক্ষা দিলেন যে, আমার নিকট এই প্রার্থনা করবে, হে আমার প্রতিপালক, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমার উপর অনুগ্রহ করুন। নিশ্চয় আপনি সবচেয়ে বড় অনুগ্রহকারী।

সূরা নুর

এটি মাদানি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৬৪। রুকু সংখ্যা: ৯

নামকরণ

নূর শব্দ ব্যবহৃত হওয়ায় একে সূরা নূর বলা হয়। এছাড়াও এ সূরায় এমন আদব- শিষ্টাচার ও বিধি-বিধান বর্ণনা করা হয়েছে, যা সমাজ-জীবনকে নূরানি ও আলোকিত করে দেয়।

এর অধিকাংশ বিধান চারিত্রিক পবিত্রতা ও নিষ্কলুষতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ কারণে এ সুরাটি নারীদের শেখানোর প্রতি বিশেষভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হযরত মুজাহিদ রহ. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা পুরুষদের সূরা মায়েদা আর নারীদের সূরা নূর শেখাও। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা সূরাটি নারীদের শেখানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন।

এ সূরায় আল্লাহ তায়ালা চারিত্রিক পবিত্রতা ও নিষ্কলুষতা এবং পারিবারিক জীবন সংশোধনের যেসব বিধান উল্লেখ করেছেন, নিম্নে তা উল্লেখ করা হল:

বিধান ও আদব

প্রথম ও দ্বিতীয় বিধান ব্যভিচারের শাস্তি সম্পর্কে। ব্যভিচারী নারী-পুরুষ যাদি অবিবাহিত হয় তা হলে তাদের একশ বেত্রাঘাত করা হবে। এটি কোরআন দ্বারা প্রমাণিত। আর যদি তারা বিবাহিত হয় তা হলে তাদেরকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হবে। এটি সুন্নাতে মুতাওয়াতিরা ও সাহাবিদের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত।

আয়াতে ব্যভিচারীদের ব্যাপারে এক সাধারণ রীতি উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ব্যভিচারীদের জীবনসঙ্গিনীরূপে গ্রহণ করার জন্য সে ব্যক্তিরাই আসে, যারা নিজেরা ব্যভিচার করতে অভ্যস্ত।

তৃতীয় বিধান

এ বিধানটি অপবাদ সংক্রান্ত। যদি কেউ কোনো বিবেকবান প্রাপ্তবয়স্ক পবিত্র চরিত্রের অধিকারী পুরুষ কিংবা নারীর উপর ব্যভিচারের অপবাদ আরোপ করে তা হলে তাকে বেত্রাঘাত করা হবে। (৪-৫)

চতুর্থ বিধান

চতুর্থ বিধানটি স্বামী-স্ত্রীর জন্য। স্বামী যদি স্ত্রীর ওপর অপবাদ আরোপ করে; এবং তার নিকট যদি চারজন সাক্ষী না থাকে তা হলে একে অপরের উপর লানত করবে। এরপর তাদের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটানো হবে।

পঞ্চম বিধান

এখানে বিধান হিসেবে ইফকের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। ইফক অর্থ মিথ্যা অপবাদ। এ বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পেছনে এক ঘটনা রয়েছে। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার ওপর কিছু মুনাফিক যখন অপবাদ আরোপ করে, তখন এ বিধান অবতীর্ণ হয়। এটা এক জঘন্য অপবাদ ছিলো যে, সবচেয়ে মহান ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র স্ত্রী, মুসলমানদের রুহানি মায়ের ওপর যা আরোপ করা হয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা দশ আয়াতে এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন। এসব আয়াতে মুনাফিকদের নিন্দা করা হয়। মুসলমানদের সতর্ক করা হয় ভবিষ্যতে কখনো যেন তারা এ ধরনের অপবাদে কোনোভাবে অংশগ্রহণ না করে।

এছাড়াও এই আয়াতের মাধ্যমে নবী-পত্নীদের চারিত্রিক পবিত্রতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। মানব-ইতিহাসে ওহীর মাধ্যমে কারো পবিত্রতার ঘোষণা দেওয়ার এটাই প্রথম কোনো বিষয়। একে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বলে মনে করা হয়।

ষষ্ঠ বিধান

ষষ্ঠ বিধানটি ঘরে প্রবেশের অনুমতি ও আদব সংক্রান্ত। বলা হয়েছে, কারো ঘরে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করবে না। প্রবেশের পূর্বে সালাম দেবে।

সপ্তম বিধান

এ বিধানটি মুমিন নারীদের সম্পর্কে। বলা হয়েছে, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি অবনত রাখে। লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। নারীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তারা যেন কারো সামনে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তবে স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভাই, ভাতিজা, ভাগিনা, আপন নারীরা, অধিকারভুক্ত বাঁদি, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ (সাধারণত যারা অন্যের অধীনে থাকে, অথবা ঘরের বয়স্ক খেদমতগার চাকর) ও এমন বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত। (৩১)

অষ্টম বিধান

অষ্টম বিধান দেওয়া হয়েছে, স্বাধীন নারী-পুরুষ ও গোলামদের মধ্যে যারা বৈবাহিক অধিকার আদায়ে সক্ষম তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া। এ ছাড়াও বাঁদিদের বিয়ে দেওয়ার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম কখনোই ব্যভিচারকে সহ্য করে না। আর বিয়েকে সহজ না করা হলে কখনোই ব্যভিচারের দরজা বন্ধ হতে পারে না। তাই ইসলাম বিয়েকে সহজ করেছে। তার প্রতি উৎসাহ যুগিয়েছে। (৩২)

নবম বিধান

নবম বিধান দেওয়া হয়েছে বাঁদি ও গোলামদের ব্যাপারে। ইসলাম আসার পূর্বেই যুদ্ধবন্দিদের গোলাম বানানোর প্রচলন ছিল। গোলাম-বাঁদিদের উপর সীমাহীন জুলুম করা হতো। ইসলাম এ প্রথাতে বহু পরিবর্তন এনেছে। গোলাম-বাঁদিদের ওপর নির্যাতনের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যান্য মানুষের মতো তাদের অধিকার সাব্যস্ত করেছে। তাদের আজাদ করে দেওয়াকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের কারণ বলে উল্লেখ করেছে। বিভিন্ন গুনাহের কাফফারাস্বরূপ তাদেরকে মুক্ত করে দেওয়ার বিধান দেওয়া হয়েছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যেসব গোলাম-বাঁদি টাকা-পয়সা পরিশোধের বিনিময়ে স্বাধীন হতে চায় তাদের সাথে যেন অঙ্গীকার করে নেওয়া হয়। পারিভাষিকভাবে এ অঙ্গীকারকে ‘মুকাতাবাত’ বলা হয়।

দশম বিধান

জাহেলিযুগের উপার্জনের হারাম রাস্তা বন্ধ করার জন্য এ বিধান দেওয়া হয়। কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে কিছু অসাধু, লোভী ব্যক্তি বাঁদিদের টাকার বিনিময়ে ব্যভিচার করতে বাধ্য করত। এটাকে তারা পেশা বানিয়ে নিয়েছিল।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরতের পূর্বে আবদুল্লাহ বিন উবাইকে লোকজন মদিনার সরদার বানানোর পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। এই আবদুল্লাহ বিন উবাইও এ জঘন্য কাজের জন্য নিজের কাছে বাঁদিদের রাখত। আয়াতে এমনটি করতে নিষেধ করে দেওয়া হয়। আয়াতের উদ্দেশ্য এটা নয় যে, বাঁদিরা যদি স্বেচ্ছায় এমনটা করতে আগ্রহী হয় তা হলে তা জায়েজ হয়ে যাবে; বরং স্বেচ্ছা-অনিচ্ছা উভয় ক্ষেত্রেই তা হারাম। আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাঁদি হওয়া সত্ত্বেও সে যখন এই কাজের প্রতি ঘৃণাবোধ করে তা হলে তোমাদের স্বাধীনদের তো আরও আগে ঘৃণা পোষণ করা উচিত ছিল।

যে নূরের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে হেদায়েত দেন

দশটি বিধান ও আদব উল্লেখ করার পর ঈমান-আকিদা এবং হকের নূর সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে, যে নূরের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহ হেদায়েত দিয়ে থাকেন। বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য এখানে তিনটি উদাহরণ উল্লেখ করা হয়েছে। এটা কোরআনের এক বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন বিষয় স্পষ্ট করার জন্য তাতে বস্তুগত দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়। প্রথম উদাহরণ মুমিনদের জন্য। দ্বিতীয় ও তৃতীয় উদাহরণ বাতিলপন্থিদের উদ্দেশ্যে। প্রথম উদাহরণে মুমিনদের অন্তরের নুরকে প্রদীপের সাথে তুলনা করা হয়েছে। যে প্রদীপটি একটি কাঁচপাত্রে স্থাপিত। কাঁচপাত্রটি উজ্জ্বল নক্ষত্রসদৃশ্য। তাতে বরকতপূর্ণ যায়তুন বৃক্ষের তেল প্রজ্বলিত হয়, যা পূর্বমুখীও নয় এবং পশ্চিমমুখীও নয়। আগুন স্পর্শ না করলেও তার তেল যেন আলোকিত হয়। (৩৫) তেমনই অবস্থা মুমিনদের। ইলম আসার পূর্বে তারা তার ওপর আমল করে থাকে। আর যখন ইলম এসে যায় তখন তো নূরুন আলা নূর (সোনায় সোহাগা) হয়ে যায়।

ইয়াহইয়া বিন সালাম রহ. বলেন, হক আসার আগেই মুমিনদের অন্তর তা চিনতে পারে। কেননা শুরু থেকেই তাদের অন্তর হকের অনুকূল থাকে।

বাতিলপন্থিদের দুটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। প্রথম দৃষ্টান্তে তাদের আমলের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, যারা কাফের, তাদের কাজ মরুভূমির মরীচিকার ন্যায়, পিপাসার্ত ব্যক্তি যাকে পানি মনে করে। সে যখন তার কাছে যায় তখন কিছুই পায় না; বরং সেখানে আল্লাহকে পায়। অতঃপর আল্লাহ তার হিসাব চুকিয়ে দেন। আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী। (৩৯)

দ্বিতীয় দৃষ্টান্তে আখেরাতের প্রতি তাদের আকিদা-বিশ্বাসের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, (তাদের কার্যাবলি) প্রমত্ত সাগরের বুকে গভীর অন্ধকারের ন্যায়, তরঙ্গের ওপর তরঙ্গ যাকে উদ্বেলিত করে, যার ওপর ঘন কালো মেঘ রয়েছে। একের উপর এক অন্ধকার। হাত বের করলে তাও দেখতে পাওয়া যায় না। আসলে আল্লাহ যাকে জ্যোতি দেন না তার কোনো জ্যোতিই নেই। (৪০)

সৃষ্টি জগতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ

হক ও বাতিলপন্থিদের উদাহরণ বর্ণনা করার পর বিশ্বজগতে দিনরাতের পরিবর্তন, বৃষ্টিবর্ষণ, আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি, পাখির উড্ডয়ন এবং বিভিন্ন জীবজন্তু সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর একত্ববাদের যে দলিল-প্রমাণ নিহিত রয়েছে, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। (৪১-৪৫)

মুমিন ও মুনাফিকের পার্থক্য

তাওহিদের দলিল উল্লেখ করার পর মুমিন ও মুনাফিকদের সম্পর্কে তুলনামূলক পর্যালোচনা করা হয়েছে। মুনাফিকরা ঈমান ও আনুগত্যের মিথ্যা দাবি করে থাকে। কিন্তু যখন আল্লাহ ও তার রাসূলের কথা মানতে গিয়ে তারা কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হয় তখন তারা বিমুখ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে মুমিনগণ সর্বাবস্থায় আল্লাহর রাসূলের অনুসরণ করে।

প্রকৃত মুমিনদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা ওয়াদা করেছেন যে, পৃথিবীতে তাদেরকে খেলাফত দান করবেন। আল্লাহ তায়ালা স্বীয় ওয়াদা পূর্ণ করেছেন। জাযিরাতুল আরব তথা আরবভূখণ্ডজুড়ে মুসলমানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পূর্ব-পশ্চিমের বিভিন্ন রাষ্ট্র তাদের আয়ত্তে এসেছে। তারা রোম-পারস্যের মতো শক্তিধর সাম্রাজ্য টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। (৪৭-৫৫)

তাওহিদের দলিল-প্রমাণ উল্লেখ, মুনাফিক ও মুমিনদের সম্পর্কে তুলনামূলক পর্যালোচনা এবং খেলাফতের ওয়াদার পর সামাজিক জীবন সম্পর্কে আরও তিনটি বিধান দেওয়া হয়েছে।

আরও তিনটি বিধান

প্রথম বিধান ছোট বাচ্চা এবং গৃহে অবস্থানকারীদের সম্পর্কে। তারা যেন ফজরের পূর্বে, দ্বিপ্রহরের সময় এবং ইশার নামাজের পর শয়নকক্ষে প্রবেশের ক্ষেত্রে অনুমতি নিয়ে নেয়। কেননা এ তিন সময় মানুষ সাধারণত ঘুমের পোশাক পরিধান করে থাকে।

দ্বিতীয় হুকুম সন্তান যখন প্রাপ্তবয়স্ক হবে তখন অন্যান্য প্রাপ্তবয়স্কের ন্যায় ঘরে প্রবেশের ক্ষেত্রে তাকে অনুমতি গ্রহণ করতে হবে। যেভাবে সম্ভব-কাশি বা পায়ের আওয়াজ প্রভৃতির মাধ্যমে অনুমতি গ্রহণ করা যেতে পারে।

তৃতীয় বিধান বৃদ্ধ নারী-যাদের বিয়ের বয়স অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, তারা যদি পর্দার ক্ষেত্রে বাহ্যিক কাপড় খুলে রাখে তা হলে এতে কোনো সমস্যা নেই। পূর্বের দশটি বিধানের সঙ্গে এ তিনটি বিধান মিলালে মোট ১৩টি বিধান ও আদবের কথা জানা যায়।

চোদ্দতম আদব ঘরে প্রবেশের সময় তোমরা সালাম দেবে।

পনেরোতম আদব যখন তোমরা পরামর্শ প্রভৃতির জন্য কোনো মজলিসে বসবে তখন অনুমতি ব্যতীত মজলিস থেকে উঠবে না।

ষোলতম আদব তোমরা যেভাবে পরস্পরকে ডেকে থাকো, আল্লাহর রাসূলকে সেভাবে ডেকো না।

সূরার শেষে বলা হয়েছে, বিশ্বজগৎ আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতা এবং তার জ্ঞানের অধীন। আল্লাহ সবার অবস্থা ও আমল সম্পর্কে অবগত। কেয়ামতের দিন সবাইকে তাদের আমলের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করবেন।

চলবে ইনশাআল্লাহ.....

লেখক: আলেম ও ওয়ায়েজ; খতিব, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মিরপুর-০১।

(ঢাকাটাইমস/২৮মার্চ/এসআইএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ইসলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :