পল্লীবন্ধু এরশাদ চিরকাল মানুষের হৃদয়ে কণক প্রদীপ হয়ে জ্বলবেন

কাজী মামুনুর রশিদ
  প্রকাশিত : ১৪ জুলাই ২০২৫, ০১:১৫
অ- অ+

দেখতে-দেখতে পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মহাপ্রয়াণের ছয় বছর কেটে গেল। বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছেই হয়তো মহান এই রাষ্ট্রনায়কের অনন্য অবদানের অনেক কিছুই অজানা। যদিও আমরা সবাই জানি, আজকের আধুনিক বাংলাদেশের গোড়াপত্তন হয়েছিলো এরশাদের নয় বছরের শাসনামলে। ওই সময়টায় তিনি দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেন উন্নয়নের ছোঁয়া, ঢাকাকে পরিণত করেন মেগা শহরে।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, তাঁর শাসনকালে পল্লীবন্ধু এরশাদ বিশেষ গুরুত্ব দেন ৬৮ হাজার গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা পাল্টে দিতে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাত্র ১০ বছরের মাথায় এরশাদ যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন খোদ ঢাকা শহরের অবস্থা অনেকটাই যেকোনো অনুন্নত মফস্বল শহরের মতো। গ্রামাঞ্চলে মানুষের নানামাত্রিক দুর্ভোগ। পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থার এক করুণ দশা। ঢাকা শহর থেকে লাগোয়া কেরানীগঞ্জ যেতেও বুড়িগঙ্গা নদী পার হতে হতো নৌকায়। উত্তরবঙ্গের সাথে ঢাকা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিলো বেশ কষ্টকর। যানবাহনকে নদী পার হতে ফেরিতে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা যাত্রীদের অপেক্ষা করতে হতো চরম দুর্ভোগ সহ্য করে।

একইভাবে ঢাকার সাথে চট্টগ্রাম কিংবা ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ গোটা পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিলো অসম্ভব অনগ্রসর। ফেরি ছাড়া নদী পার হওয়ার আর কোনো অন্য পথ ছিলো না।

মোদ্দাকথা, গোটা বাংলাদেশটাই যেন ছিল এক অনগ্রসর "পল্লী"। এসব বাস্তবতার মাঝেই বাংলাদেশকে নিয়ে দূরদর্শী এক স্বপ্ন দেখেন পল্লীবন্ধু প্রেসিডেন্ট এরশাদ।

রাজনৈতিক ঈর্ষাপরায়ণতা বশত কারো সাফল্যকে স্বীকৃতি না দেয়া, সত্যকে স্বীকার না করা কিংবা ইতিহাসকে বিকৃত করা বা মুছে ফেলার প্রবণতা আমাদের দেশে প্রবল। ফলে রাজনীতি বা গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশ শুধু ব্যাহতই হচ্ছে না বরং বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ক্রমাগত। এখান থেকে উত্তরণের পথ-নির্দেশনা যিনি দিয়েছিলেন তিনিই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

কী সেই দিক নির্দেশনা, তার বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন এখানে নেই। তার মুখে উচ্চারিত একটি মাত্র সহজ-সরল বাক্যের মধ্যেই নিহিত আছে বিস্তর ভাবার্থ। তিনি বহুবার বহুভাবে বলেছিলেন, "আসুন, আমরা সবাই মিলে প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিত্যাগ করে সুষ্ঠু রাজনীতির মাধ্যমে শান্তির দেশ গড়ে তুলি। তিনি বলেছিলেন, ৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে।

সত্যিই তো, বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল শর্ত নিহিত আটষট্টি হাজার গ্রামের মধ্যেই। কারণ, আমাদের জনগোষ্ঠীর অর্ধেকেরও বেশি গ্রামে বাস করেন। এদের বাদ দিয়ে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি সম্ভব নয় কোনোভাবেই।

একজন রাজনৈতিক নেতাকে অমরত্ব দিতে পারে তার যেকোনো একটি মাত্র কৃতিত্ব। কিন্তু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রয়েছে বহুমুখী সাফল্য। তার কর্মজীবনের তিনটি স্তর যেমন- রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রসংস্কারক। সব স্তরেই তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন উপযোগী কৃতিত্ব অর্জন করেছেন।

রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে পল্লীবন্ধু এরশাদ দিয়েছেন উন্নয়ন-সমৃদ্ধি। গড়েছেন স্বনির্ভরতার সোপান, সৃষ্টি করেছেন অর্থনৈতিক মুক্তির পথ। এখানে তার উদাহরণ উল্লেখ প্রয়োজন। কারণ এরশাদ আমলের স্বর্ণোজ্বল অধ্যায়ের কথা সাধারণ মানুষের মুখে মুখে এখনও উচ্চারিত হয়। এযাবৎ কালের সব সরকারের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্বের পেন্ডুলাম পল্লীবন্ধু এরশাদের জাতীয় পার্টির দিকে।

তারপর রাজনীতিবিদ হিসেবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হলেন সেই নেতা, যিনি হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, সংঘাত-সন্ত্রাসের রাজনীতির বিপরীতে শান্তি, সমৃদ্ধি, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সভ্যতা, ভদ্রতা, মনুষ্যত্ব, মানবিকতা বিকাশের রাজনীতি প্রচলনের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।

পল্লীবন্ধু এরশাদ শুধু এদেশের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসেই নয়, তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন তার কর্মে, কৃতিত্বে, ন্যায়-নীতি ও আদর্শে। এদেশে যত দিন উপজেলা ব্যবস্থা থাকবে, তত দিন এরশাদের নাম উচ্চারিত হবে প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে। তিনি ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করেছেন। শুক্রবারকে তিনি সাপ্তাহিক ছুটির দিন ঘোষণা করেছেন। অসংখ্য মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করে ইসলামের সেবা করেছেন। অন্যান্য ধর্মের জন্য ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করে দিয়েছেন। জন্মাষ্টমীর দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছেন। তার শাসনামলে কোনো বৈষম্য ছিল না।

পল্লীবন্ধু এরশাদ ছিলেন উন্নয়ন সমৃদ্ধির বরপুত্র। কে মুছে দিতে পারবে তার এই অমর কীর্তি! তিনি যমুনা সেতু, বুড়িগঙ্গা, মেঘনা, কামারখালী সেতুসহ ৫০৮টি ছোট-বড় সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করেছেন। দশ হাজার মাইল পাকা রাস্তা নির্মাণ করে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছেন।

দেশের রাজধানীসহ সকল জেলা শহরের সড়কে তিনি সোডিয়াম বাতির ব্যবস্থা করেছেন। রাজধানী ঢাকাকে তিলোত্তমা নগরীতে পরিণত করেছেন। ঢাকা প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে রাজধানীকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করেছেন। দেশের গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন দেশে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতো। যখন ক্ষমতা ছেড়েছেন তখন ২৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়েছে।

পল্লীবন্ধু এরশাদের ঔষধ নীতি ও ভূমি সংস্কার নীতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে এবং দেশ ও জাতি উপকৃত হয়েছে। সর্বোপরি প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে মানুষের দোরগোড়ায় বিচার ব্যবস্থা পৌঁছে দিয়েছেন এবং অনুন্নত গ্রামবাংলাকে উন্নয়নের আওতায় নিয়ে এসেছেন।

তিনি মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে সৈন্য পাঠিয়ে শান্তি মিশনে বাংলাদেশের সৈন্য প্রেরণের পথ উন্মুক্ত করেছেন। বাংলাদেশে এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে পল্লীবন্ধু এরশাদের উন্নয়ন সমৃদ্ধির ছোঁয়া লাগেনি।

৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে- এই কালজয়ী স্লোগান নিয়েই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল। ক্ষমতা গ্রহণ করে ১৮ দফা কর্মসূচি নিয়ে এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নই শুধু নয়, তা বাস্তবায়নের জন্য তিনি অবিশ্রাম কাজ করেছেন। নয় বছরের শাসনামলে তিনি তার পরিকল্পনা সফল করে দেশকে অনেক এগিয়ে গেছেন।

যদিও রাজনৈতিক পরিবেশ তার অনুকূলে ছিলো না, কিন্তু দক্ষতা, যোগ্যতা ও দেশ পরিচালনার মতো অভিজ্ঞতা থাকলে যেকোনো প্রতিকূল পরিবে, মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে যে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, তা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রমাণ করে গেছেন। তিনি যদি আরো সময় পেতেন তাহলে এই দেশকে তিনি সিঙ্গাপুর কিংবা মালয়েশিয়ার পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারতেন।

এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে পৌনঃপুনিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক কাঠামো, হত্যা, ষড়যন্ত্র, প্রতিহিংসা এবং সহিংসতার দুর্দণ্ড দাপট গণতন্ত্রকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিমূলে দাঁড় করাতে সার্বিক ব্যর্থতা- এমন একটা পরিস্থিতিতে সামরিক শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা যথাযথ অনুশীলন এবং আর্থ-সামাজিক প্রশাসনিক অর্থাৎ জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক আমলের ঘুণে ধরা ব্যবস্থা ও ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন ঘটিয়ে স্বাধীন দেশের উপযোগী মৌলিক অবকাঠামো গড়ে তোলার গুরু দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে শুরু হয়েছিল জাতীয় পার্টির অভিযাত্রা।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পার্টি গঠনের পর থেকে জাতীয় পার্টির ঘোষিত লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থেকে জাতিকে একটি সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। আমরা তারই উত্তরসূরি হিসেবে আজও তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যেতে অঙ্গীকারবদ্ধ।

১৪ জুলাই, ২০১৯ সাল। আমাদের জাতীয় জীবনের একটি শোকাবহ দিন। এই দিনেই দেশের এই কিংবদন্তি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মহান রাষ্ট্রনায়ক, উন্নয়ন-সমৃদ্ধি ও সংস্কারের বরপুত্র পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মহাপ্রয়াণ ঘটে।

তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন প্রিয় রংপুরে তার আপন নিবাস পল্লী নিবাসের ছায়া সুশীতল লিচুবাগানের মাটির ঘরে। কিন্তু সারা বাংলাদেশ জুড়ে এখনো রয়ে গেছে তার সুনিপুণ উন্নয়ন সমৃদ্ধির হাতের ছোঁয়া।

আধুনিক বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্নদ্রষ্টা প্রাণপুরুষ আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু প্রতিনিয়ত তিনি বেঁচে আছেন এদেশের কোটি মানুষের চিন্তায়, চেতনায় ও প্রেরণায়।

পল্লীবন্ধু এরশাদ এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন এক ব্যক্তিত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন, যিনি শুধু একজন ব্যক্তিই নন, তিনি এক মহান প্রতিষ্ঠান। শুধু প্রতিষ্ঠানই নয়, পল্লীবন্ধু এরশাদ এখনো এক জীবন্ত ইতিহাস, তিনি এখনো জীবন্ত কিংবদন্তি। চিরকাল তিনি মানুষের হৃদয়ে কণক প্রদীপ হয়ে জ্বলবেন।

লেখক: জাতীয় পার্টির নেতা।

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
সিরাজগঞ্জে সরকারি অফিস ‘দখল করে’ জামায়াতের কার্যালয়ে
গণবিরোধিতার কারণে বিশেষ গোষ্ঠীকে দেশের মানুষ অনেক আগেই হলুদ কার্ড দেখিয়েছে: সেলিম উদ্দিন 
চিলড্রেন্স পার্টি কথাবার্তা শুনে আমাদের বিভ্রান্ত হওয়ার কারণ নেই: মির্জা আব্বাস 
খুলনায় ট্রেন-ট্রাক সংঘর্ষ, রেল যোগাযোগ বন্ধ
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা