পানিবন্দি ২০ লাখ মানুষ
নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি

নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। জেলার আট উপজেলার সব কটিই প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি প্রায় ২০ লাখ মানুষ বিপাকে পড়েছে। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট। বন্যার সঙ্গে চলছে বর্ষণ। গতকাল ভোর ছয়টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত জেলায় ৭৩ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।
ফেনী মুহুরী নদীর পানি প্রবেশ করায় জেলার সেনবাগ, কোম্পানীগঞ্জ ও কবিরহাট উপজেলার আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত জেলায় ৭৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। সারাদিন থেমে থেমে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হচ্ছে, কখনও সেটি ঝড়ো বাতাসসহ ভারী বর্ষণে পরিণত হয়।
বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জেলা সদর, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ, সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী, চাটখিল ও সুবর্ণচর উপজেলার প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ পানিবন্দি। বাড়িঘর ৩ থেকে ৫ ফুট পানিতে তলিয়ে আছে। নিচু এলাকায় ঘরের চালা পর্যন্ত পানি।
বসতঘরে পানি প্রবেশ করায় বুধবার রাত পর্যন্ত অনেকে খাটের ওপর অবস্থান করেন। তবে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তারা কাছের আশ্রয়ণ কেন্দ্র, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছেন।
বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর টিউবওয়েল পানিতে ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। খাবার সংকটে রয়েছে বেশির ভাগ মানুষ।
পানি ঢুকে পড়েছে জেলা শহর মাইজদীর বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে। নষ্ট হয়ে গেছে প্রয়োজনীয় অনেক কাগজপত্র। জেলার প্রধান সড়কসহ প্রায় ৮০ ভাগ সড়ক কয়েক ফুট পানিতে নিমজ্জিত। বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় বেশির ভাগ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। সড়কগুলোতে যান চলাচল অনেকটাই কম।
কবিরহাট উপজেলার নরোত্তমপুর ইউনিয়নের নূর নবী জানান, গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে প্রথমে বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু বুধবার দুপুরে ফেনী মুহুরি নদীর বাঁধ ভেঙে ফেনী ছোট নদী হয়ে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ ও কবিরহাট উপজেলা হয়ে নোয়াখালী খালে পানি ঢুকে পড়ে। ফলে জেলার বিভিন্ন উপজেলা বন্যা দেখা দেয়।
একই উপজেলার সাইফুল ইসলাম নামের একজন জানান, বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা পর্যন্ত কবিরহাটে কোনো বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু ফেনীর মুহুরি নদীর পানি বেড়েছে অন্তত দুই ফুটের বেশি। বর্তমানে বৃষ্টির পানির চেয়ে ফেনী থেকে আসা বন্যার পানি নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকাগুলো ডুবিয়ে দিচ্ছে বলে জানান তিনি।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুসাপুর ইউনিয়নের নূর উদ্দিন জানান, বন্যার পানিতে গত মঙ্গলবার তার একটি মুরগির খামারে প্রায় ১০ লাখ টাকার মুরগি মারা গেছে। এছাড়া বাংলাবাজারসহ আশপাশের অনেক খামারির মুরগি বন্যার পানিতে ভেসে গেছে।
এদিকে সরকারি সহায়তার পাশাপাশি বন্যায় কবলিত মানুষের পাশে দাড়িঁয়েছেন সেচ্ছাসেবী সংগঠন এসএইচবিও, সাইবার ওয়ারিয়র্স, স্বপ্নসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন। তারা বুধবার রাত থেকে বিভিন্ন আশ্রয়ণ কেন্দ্রে গিয়ে বন্যার্থ মানুষর মাঝে মুড়ি, বিস্কুট, চিড়া ও বিশুদ্ধ খাবার বিতরণ করছেন।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সী আমির ফয়সাল জানান, মুহুরি নদীর পানি প্রবেশের কারণে ছোট ফেনী নদীতে জোয়ার স্বাভাবিকের তুলনায় পাঁচ-ছয় ফুট উচ্চতায় বইছে। ফলে বন্যার পানি নদীতে নামতে পারছে না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মীরা রানী দাস জানান, এবারের বন্যায় চলতি আমন ও আউশ মৌসুমে জেলায় ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে ৪ হাজার ৬৮৬ হেক্টর আমনের বীজতলা, আবাদকৃত আমনের ক্ষতি হয়েছে ২৬ হাজার ৯০০ হেক্টর। এ ছাড়া আবাদকৃত আউশের ক্ষেত নিমজ্জিত হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৩৭৭ হেক্টর জমি। বন্যায় আমন ও আউশের পাশাপাশি সবজিরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ চলছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে জেলা প্রশাসক জানান, মুহুরি নদীর পানির কারণে জেলার বেশির ভাগ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। ইতোমধ্যে ইউনিয়ন ও পৌরসভা মিলে ৮৭টি এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি প্রায় ১৯ লাখ ৮০ হাজার মানুষ। বন্যার্তদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ৩৮৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে, যেখানে ইতোমধ্যে প্রায় ৩৮ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।
জেলা প্রশাসক আরও জানান, বন্যায় চলামান পরিস্থিতি মোকাবেলায় ১৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকা ও ১ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিকটন চাল ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাঝে হস্তান্তর করা হয়েছে।
(ঢাকাটাইমস/২২আগস্ট/মোআ)

মন্তব্য করুন