এই দিনে পৃথিবীতে এসেছিলেন প্রয়াত কিংবদন্তি সুবীর নন্দী
বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী ছিলেন সুবীর নন্দী। যিনি বহু অ্যালবাম ও চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়ে দেশজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আজকের এই দিনে (মঙ্গলবার) পৃথিবীতে এসেছিলেন প্রয়াত সেই কিংবদন্তি। আজ গায়কের জন্মদিন। বেঁচে থাকলে তার বয়স হতো ৭১ বছর।
সুবীর নন্দীর ডাক নাম ছিল বাচ্চু। তিনি ১৯৫৩ সালের ১৯ নভেম্বর হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানায় নন্দী পাড়ায় এক কায়স্থ সম্ভ্রান্ত সংগীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার মামার বাড়ি শ্রীমঙ্গল উপজেলার বাদেআলিশা গ্রামে। তার বাবা সুধাংশু নন্দী ছিলেন একজন চিকিৎসক ও সংগীতপ্রেমী। মা পুতুল রানীও গান গাইতেন।
ছোটবেলা থেকেই সুবীর নন্দী ভাইবোনদের সঙ্গে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নিতে শুরু করেন ওস্তাদ বাবর আলী খানের কাছে। তবে সংগীতে তার হাতেখড়ি মায়ের কাছেই। বাবার চাকরি সূত্রে তার শৈশবকাল চা বাগানেই কেটেছে। পাঁচ-ছয় বছর বয়স পর্যন্ত বাগানেই ছিলেন।
চা বাগানে খ্রিস্টান মিশনারিদের একটি বিদ্যালয় ছিল। সেখানেই পড়াশোনা করেন সুবীর নন্দী। তবে পড়াশোনার অধিকাংশ সময়ই কেটেছে হবিগঞ্জ শহরে। সেখানে তাদের একটি বাড়ি ছিল, সেখানে ছিলেন। পড়েছেন হবিগঞ্জ হাইস্কুলে। তারপর হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সুবীর নন্দী দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন।
কর্মজীবন
১৯৬৩ সালে তৃতীয় শ্রেণী থেকেই গান করতেন সুবীর নন্দী। এরপর ১৯৬৭ সালে তিনি সিলেট বেতারে গান করেন। সুবীর নন্দী পেশাদার ভাবে গানের জগতে আসেন ১৯৭০ সালে ঢাকা রেডিওতে প্রথম রেকর্ডিংয়ের মধ্য দিয়ে। প্রথম গান ‘যদি কেউ ধূপ জ্বেলে দেয়’ -এর গীত রচনা করেন মোহাম্মদ মুজাক্কের এবং সুরারোপ করেন ওস্তাদ মীর কাসেম।
চার দশকের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে সুবীর নন্দী গেয়েছেন আড়াই হাজারেরও বেশি গান। বেতার থেকে টেলিভিশন, তারপর চলচ্চিত্রে গেয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান। চলচ্চিত্রে প্রথম গান করেন ১৯৭৬ সালে আব্দুস সামাদ পরিচালিত ‘সূর্যগ্রহণ’ সিনেমায়।
১৯৭৮ সালে আজিজুর রহমান পরিচালিত ‘অশিক্ষিত’ সিনেমায় রাজ্জাকের ঠোঁটে তার গাওয়া ‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৮১ সালে তার একক অ্যালবাম সুবীর নন্দীর গান ডিসকো রেকর্ডিংয়ের ব্যানারে বাজারে আসে।
এছাড়া তার ‘প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘ভালোবাসা কখনো মরে না’, ‘সুরের ভুবনে’, ‘গানের সুরে আমায় পাবে’ (২০১৫) প্রকাশিত হয় এবং ‘প্রণামাঞ্জলী’ নামে একটি ভক্তিমূলক গানের অ্যালবামও প্রকাশিত হয়।
চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করে পাঁচবার ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ অর্জন করেছেন বাংলা সংগীতের প্রয়াত এই মহাতারকা। এছাড়া সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সরকার সুবীর নন্দীকে দেয় দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক।
সুবীর নন্দী গানের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ব্যাংকে চাকরি করেছেন। জনতা ব্যাংকে চাকরি করার মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করেন। চল্লিশ বছর ব্যাংকিং সেবা দিয়ে ২০১৩ সালে জনতা ব্যাংক থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশের সংগীত জগতের এই মহাতারকা না ফেরার দেশে চলে যান ২০১৯ সালের ৭ মে। কিডনি ও হার্টের অসুখে ভুগে এদিন তিনি মারা যান।
২০১৯ সালের ১৪ এপ্রিল রাতে সিলেট থেকে ট্রেনে করে ঢাকায় ফিরছিলেন সুবীর নন্দী ও তার পরিবার। হঠাৎই তিনি ট্রেনের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এদিন রাত ১১টার দিকে তাকে নেওয়া হয় রাজধানীর সিএমএইচে। হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে হার্ট অ্যাটাক করেন এই নন্দিত শিল্পী। এরপর তাকে দ্রুত লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়।
এই অবস্থায় সিএমএইচে ১৮ দিন থাকার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয় বরেণ্য সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দীকে। সে দিনই সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে তার চিকিৎসা শুরু হয়।
কিন্তু ক্রমেই সুবীর নন্দীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন তার একাধিকবার হার্ট অ্যাটাক হয়।
শেষ পর্যন্ত ওই বছরের ৭ মে চলে যান না ফেরার দেশে। এদিন ভোর সাড়ে চারটার দিকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকরা বাংলাদেশি এই কিংবদন্তিকে মৃত ঘোষণা করেন। সুবীর নন্দী নেই, তবে তার অসংখ্য কালজয়ী গানের জন্য তিনি আজীবন থেকে যাবেন সংগীতপ্রেমীদের মনে।
(ঢাকা টাইমস/১৯নভেম্বর/এজে)
মন্তব্য করুন