উপন্যাস

প্রথম প্রেমের স্পর্শ: পর্ব ৯- সীমান্তরেখার এপারে একা তমাল

এম এম মাহবুব হাসান
  প্রকাশিত : ০৬ জুলাই ২০২৫, ১২:২৩
অ- অ+

চট্টগ্রামে দেখা হওয়ার পর কেটে গেছে ছয়টি মাস।

যে সকালের আলোয় আমরা বসেছিলাম জানালার পাশে, সেই আলো মনে হয় এখনও উঁকি দেয়—একটি অদৃশ্য হাতে হাত ধরে!

শত চেষ্টা করেও আমরা অতীতকে আর পেছনে ফেলে আসতে পারিনি।

এই ছয় মাসে নীলা আর আমার মধ্যে হয়নি কোনো ফোনালাপ, আসেনি কোনো চিঠি।

সে নেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও।

আমি খুঁজে বের করার চেষ্টাও করিনি।

হয়তো এই নীরবতাই ওর শেষ কথা।

তিন মাস পর, এক সন্ধ্যায়, হঠাৎ এক পুরোনো বন্ধুর মুখে শুনি—

নীলার আবার বিয়ে ঠিক হয়েছে।

পাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষক—শিক্ষিত, ভদ্র, স্থিতিশীল।

কথাগুলো যেন বুকের ভেতর থেকে শ্বাস কেড়ে নিল।

চট্টগ্রাম থেকে ফেরার তিন দিন পর নীলা চিঠি দিয়ে যে সাক্ষাতের জন্য জরুরি তলব করেছিল—

তা কি এসব জানাতেই?

আমি কি আবারো সেই ট্রেন মিস করলাম?

আমি কি সত্যিই নীলাকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলেছি?

প্রশ্নগুলো ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির মতো বুকের গহ্বরে ঝরে পড়ল, ভেঙে দিল জমে থাকা সংবরণ।

সেই রাতে আমি একা হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই ধানমণ্ডি লেকে—

যেখানে একদিন পাশাপাশি বসে নীলা বলেছিল,

“তোমাকে ভালোবাসি না বললেও, ভালো না বেসে থাকতে পারি না।”

আজ, এতগুলো বছর পর আমি বুঝি—ভালোবাসা কখনো পরিণতি নয়, কেবল অনুভব।

আমি একটি বেঞ্চে বসে থাকি।

চারপাশে কিশোর প্রেমিক-প্রেমিকার দল, ব্যস্ত পথচারী, নিঃসঙ্গ মুখ—

তাদের ভিড়ে আমি খুঁজি নীলার ছায়া।

আমি জানি, সে নেই।

তবু মন খোঁজে।

হঠাৎ ফোনে আসে একটি মেসেজ—

অচেনা নম্বর থেকে, মাত্র তিনটি শব্দ:

“আমি বেঁচে আছি।”

আমি বুঝে গেলাম—এটা নীলারই বার্তা।

চেনা সেই ভাষাহীন স্বর।

আমি কোনো উত্তর দিইনি।

কারণ এবার আমি চেয়েছিলাম—সবকিছু শেষ হোক সম্মানজনকভাবে।

রাত গভীর হলে ডেস্ক খুলে, পুরোনো চিঠিগুলোর ভেতর থেকে বের করি একটি ছবি—

সেই দিন, কদমফুল হাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম কলেজ গেটের সামনে।

ছবিটার পেছনে লিখে রাখি—

“তুমি সুখী হও, নীলা।

কিন্তু জানো, আমার জীবনের প্রতিটি কবিতা আজও তোমার নামেই শেষ হয়।”

মা আজকাল আরও বেশি চুপচাপ।

লোকমান চৌধুরী এখন আর নিয়ম করে আসেন না।

বাবা মারা যাওয়ার পর প্রায়ই আসতেন।

মায়ের সঙ্গে সময় কাটাতেন।

একসময় মা লোকমান চৌধুরীর শরীরের স্পর্শে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।

লোকমান চৌধুরী আর মায়ের মধ্যে যা ঘটেছে—সেসবের নীরব সাক্ষী হয়ে থেকেছি আমি।

মায়ের শরীর খারাপ না থাকলে প্রতি শুক্রবার বিকেলে লোকমান চৌধুরী আসতেন।

মাকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করতেন।

মাও তাঁকে জড়িয়ে ধরে হারিয়ে যেতেন স্বপ্নের জগতে।

একবার লোকমান চৌধুরী বলেছিলেন—

“জুলেখা বানু, আমাদের যদি কোনো সন্তান হয়, তাহলে কী হবে?”

মা বলেছিলেন—

“সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমি না চাইলে সন্তান কীভাবে হবে?”

মায়ের এমন সোজাসাপটা জবাবের পর লোকমান চৌধুরী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

সেদিন তিনি মাকে ভোগ করেছিলেন প্রবল ক্ষুধায়—

তবে মায়ের তাতে কোনো আপত্তি ছিল না।

বরং নিজেকে নিঃশর্তভাবে বিলিয়ে দিয়েছিলেন।

সেই রাতে পাশের ঘরে শুয়ে আমি প্রথমবার শুনি মায়ের দীর্ঘশ্বাস।

একটা অদৃশ্য যুদ্ধ চলছিল, যার আওয়াজ কেবল দেওয়ালের ফাঁক গলে আমার কানে এসেছিল।

লোকমান চৌধুরী মাঝে মাঝে মায়ের জন্য ফল নিয়ে আসতেন।ছুটির দিনে খিচুড়ি রান্না হতো, তিনজনে একসাথে খেতাম।

তখন ভাবতাম, মা হয়তো আবার সংসার করতে চাইছেন।

কিন্তু পরে বুঝেছি, মায়ের সংসার করার ইচ্ছা ছিল না।

আমার প্রতি ভালোবাসার কোনো ঘাটতিও ছিল না।

তবে লোকমান চৌধুরীর স্পর্শ মাঝে মাঝে তাঁকে দুর্বল করে তুলত।

কিন্তু এখন মা যেন নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়েছেন।

রান্নাঘরে একা থাকেন, চুপচাপ রান্না করেন, দরজার কপাট বন্ধ রাখেন—

যেন বাইরের পৃথিবী আর না ছুঁতে পারে তাঁকে।

এক সন্ধ্যায় মায়ের ঘরে ঢুকে দেখি, তিনি একটি পুরোনো ডায়েরি পড়ছেন।

হঠাৎ হাত থেকে খসে পড়ে একটি চিঠি।

আমি কুড়িয়ে নিতে গিয়ে দেখি—চিঠিটি লোকমান চৌধুরীর হাতে লেখা।

মা প্রথমে একটু অপ্রস্তুত হলেও থামালেন না।

আমি জিজ্ঞেস করলাম,

“মা, তুমি কি তাঁকে ভালোবাসো?”

অনেকক্ষণ চুপ থেকে মা ধীরে ধীরে বললেন—

“ভালোবাসা খুব সহজ একটা শব্দ, তমাল।

তোর বাবা চলে যাওয়ার পর আমি শুধু একটা ছায়া খুঁজেছি—

যে এই নিঃসঙ্গতা ভাগ করে নেবে।

লোকমান চৌধুরী তোর বাবার বংশীয় চাচা।

দুঃসময়ে পাশে থেকেছে।

কিন্তু জানিস, ভালোবাসা আর আশ্রয়ের মাঝে একটা সূক্ষ্ম সীমান্তরেখা থাকে।

আমি ওর আশ্রয় চেয়েছিলাম, কিন্তু ও ভালোবাসার দাবি করতে লাগল।”

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।

মা আবার বললেন—

“আমি একা থেকেছি, তমাল।

অনেক একা।

এই সমাজে একা নারী মানেই যেন খোলা শিকারক্ষেত্র।

তোর বাবার মৃত্যুর পর, আমার শরীরের দিকে যেভাবে মানুষ তাকিয়েছে—

সেটা তুই কোনোদিন বুঝবি না।”

শেষবার যখন লোকমান চৌধুরী এসেছিলেন, মা তাঁর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেছিলেন—

“আমি আর তোর বউ হতে চাই না, লোকমান।

আমি শুধু একজন মা থাকতে চাই।

যিনি নিজের ছেলেকে মানুষ করেছেন—

সেই পরিচয়টাই আমার জন্য যথেষ্ট।”

লোকমান চৌধুরী কিছু না বলেই মাথা নিচু করে ফিরে গিয়েছিলেন।

মা দরজা বন্ধ করে চিৎকার করে কেঁদেছিলেন।

সেই কান্না আমি প্রথমবার শুনেছিলাম—

একজন নারীর সমস্ত হেরে যাওয়া, অভিমান আর যন্ত্রণার গলিত প্রতিবাদ।

সেই রাতে আমি বারান্দায় বসেছিলাম।

চাঁদের আলো পড়েছিল বালিশে।

আমি ভাবছিলাম—

একজন নারী যদি ভালোবাসা হারিয়েও শক্ত থাকতে পারেন,

তবে আমি কেন পারছি না?

আমার মধ্যে মাঝে মাঝে নীলা জেগে ওঠে।

তার চোখ, ঠোঁটের পেছনে লুকানো কষ্ট,

সব মিলে আমার ঘুম কেড়ে নেয়।

একদিন রিকশায় করে যাচ্ছিলাম পুরোনো শহরের দিকে।

হঠাৎ দেখি, এক মহিলার হাত ধরে হাঁটছে একটি ছোট্ট মেয়ে।

মেয়েটি হঠাৎ আমার দিকে ফিরে তাকায়।

চট্টগ্রামে নীলার সঙ্গে দেখা সেই মেয়েটি!

ওর চোখে আমি যেন আমার ছায়া দেখি।

চোখে জল এসে গেল।

মনে হলো—এই ছোট্ট মেয়েটিই আমার জীবনের একমাত্র উত্তরাধিকার।

যে ভালোবাসা পরিণতি পায়নি, কিন্তু রয়ে গেছে রক্তে।

আমি ভাবতে থাকি—নীলার পরের বিয়েটা কি সত্যিই হয়েছে?

নাকি সমাজের চোখে ধোঁয়াশা তৈরি করে রেহাই পাওয়ার উপায়?

আমি জানি না।

আমি শুধু জানি—সে আমার হয়েই বেঁচে আছে।

সেই ছোট্ট মেয়েটির ভেতর দিয়ে নীলা এখনো আমার পৃথিবীতে রয়েছে।

আজকাল আমি আর তেমন একটা লিখি না।

কলম ধরলেই মনে পড়ে যায় তার হাতে লেখা চিঠির অক্ষর।

সে বলেছিল—

“তুমি যদি একদিন ফিরে আসো, আমি আমার মেয়েকে তোমার কোলে তুলে দেব।”

আমি জানি, আমি ফিরিনি।

তবে হারিয়েও যাইনি।

আমার মা এখন প্রতিদিন আমাকে ভাত খেতে বসান।

মাঝে মাঝে বলেন—

“তোর একটা পরিবার হলে ভালো হতো।”

আমি শুধু হাসি।

না, সেই হাসির ভেতরে কোনো উচ্ছ্বাস নেই।

আছে তীক্ষ্ণ এক শূন্যতা—যা কেবল নিজেরাই বোঝে, যারা কোনোদিন একটি পরিবার গড়ে তুলেও হারিয়ে ফেলেছে।

আমার পরিবার…

আমি তো গড়ে ফেলেছিলাম—

নীলা আর আমাদের ভালোবাসার ছায়ায় গড়ে তোলা এক ক্ষণিক স্বপ্নের সংসার।

যেখানে ভাষার চেয়ে গভীর ছিল দৃষ্টির ইশারা,

স্পর্শের চেয়েও সত্য ছিল আত্মার নিবিড় টান।

কিন্তু সেই পরিবার সমাজ মানেনি।

পৃথিবী তার নিয়মের বৃত্তে আমাদের টিকিয়ে রাখতে পারেনি।

ভালোবাসা সেখানে অপরাধ, নারী যদি নিজের পছন্দে ভালোবাসে, আর পুরুষ যদি প্রথার বাইরে কিছু চায়।

তবু আমার হৃদয়…

আজও খালি পড়ে আছে শুধু সেই মেয়েটির জন্য,

যে একদিন আমার হাত ধরেছিল, আবার ফেলে গিয়েছিল অন্ধকারের একা একান্তে।

রাত গভীর হলে, অথবা বিকেলের ফাঁকা আকাশের দিকে তাকালে,

কখনও কখনও আমার মনের ভেতর জন্ম নেয় এক প্রশ্ন—

সীমান্তরেখা আসলে কোথায়?

একজন নারীর জীবনে?

একজন পুরুষের ভালোবাসায়?

একজন মায়ের আত্মত্যাগে?

আমার মা…

যিনি জীবনভর নিজের ভেতরের কান্না চেপে শুধু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে থেকেছেন,

তিনি কি পারেছিলেন সেই অদৃশ্য সীমান্ত পার হতে?

যেখানে নিজের ইচ্ছা বলে কিছু নেই, যেখানে ভালোবাসাও একটা অপরাধ?

না, মা পুরোপুরি পারেননি।

তিনি জীবনের সীমান্তে দাঁড়িয়ে শুধু চেয়েছিলেন—

ছেলের ভালোবাসাকে আকড়ে ধরে বাঁচতে, ছেলের একটি সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় নিজেকে সমাজের চোখে অনেক কিছু থেকে আড়াল করেছেন।

কিন্তু নিজের শরীরকে শপে দিয়েছেন লোকমান চৌধুরীর বয়স্ক শরীরের কাছে!

আর নীলা?

সে হয়তো পেরেছিল সেই সীমান্তরেখা অতিক্রম করতে।

হয়তো পেরেছিল সমাজের চোখ রাঙানি, সংসারের চাহিদা, সন্তানের নীরব অস্বীকার—সব কিছু পেছনে ফেলে নিজের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে।

তবু,

সীমান্তরেখার এপারে এখনো আমি একা।

একজন নামহীন, গৃহহীন, অপেক্ষারত পুরুষ—তমাল।

যার কাঁধে এখনো জমে আছে অনন্ত অপেক্ষার ধুলো।

যার ভেতর এখনো ঘুমিয়ে আছে এক অসমাপ্ত কবিতার দেশ।

(চলবে)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
শাহজালাল বিমানবন্দরে ৮৯৬ গ্রাম স্বর্ণালঙ্কারসহ দুজন আটক
স্কুলছাত্রকে পিস্তল ঠেকিয়ে তুলে নেওয়ার ২ ঘণ্টা পর ফেরত দিলো অস্ত্রধারীরা
জুলাইযোদ্ধাদের জন্য ২৫ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠন বাংলাদেশ ব্যাংকের
ষড়যন্ত্রকারী যত চেষ্টাই করুক সফল হবে না: আমিনুল হক 
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা