কবিতা
ঘুমন্ত নগরী

গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন এক নগরী,
নিয়ন আলোয় ঢেকে গেছে তার সারা ক্লান্তি—
মুখোশ-পরা ভোরের আশ্বাস বুকে নিয়ে,
নিভে গেছে চৌরাস্তায় চিৎকার করা স্বপ্নেরা।
সেই রাস্তায় হাঁটে একা—
জুতোর তলায় ধুলো হয়ে জমে থাকা
স্তরে স্তরে সঞ্চিত দিনগুলোর স্মৃতি বয়ে।
.
এই আজব বোবা শহর কথা বলে না,
শুধু দেয় ঘো-ঘো শব্দের ধোঁকা—
নিষ্ঠুর হর্নের কর্কশতা, মেট্রোর করুণ ধ্বনি,
চোখের পাতায় জমে থাকা না-ঝরা অশ্রুজল।
নগরীর বাড়ির নাড়িতে নাড়িতে নিঃশব্দে জেগে থাকে
রক্তাক্ত আঘাতের চিহ্ন, নখের আঁচড়;
একেকটি অসহ্য ব্যথা, একেকটি অজানা প্রশ্ন,
যা কেউ জিজ্ঞেস করে না মুখ ফুটে,
তবু বুকের ভেতর পাথরের মতো চেপে রাখে—
সবকিছু চুপচাপ, শব্দহীন সহিষ্ণুতায়।
.
ঘুমন্ত শহরের গায়ে ছুঁয়ে থাকা বাতাসে
খুঁজে ফেরে হারিয়ে যাওয়া সত্ত্বাকে—
যে কবিতা লিখত, গান লিখত,
যে প্রতিটি রাস্তায় প্রেমের ঠিকানা খুঁজত,
জানালার কাঁচে নিজের ছায়া দেখে বলত—
“তুই এখনও বেঁচে আছিস নির্ভয়ে!”
সে আজ নিজের ভেতরেই নির্বাসিত,
মনে হয়—কিছুটা নিশ্চিহ্ন, ধুলিসাৎও বটে।
.
তবে নগরী ঘুমিয়ে থাকলেও
তার স্বপ্ন কিন্তু জেগে থাকে অবিরাম—
একজন ভিখারির কাঁথায়,
এক কিশোরীর ফেলে যাওয়া প্রেমপত্রে,
এক বৃদ্ধের স্মৃতিবোনা সিগারেটের ধোঁয়ায়,
এক বালকের সদ্য গজানো গোঁফে।
এই শহরের প্রতিটি ঘুমভাঙায়
লুকিয়ে থাকে একেকটি গল্প,
যা কেউ লেখে না—কী আশ্চর্য সে কথা!
তবু তা প্রতিদিন পড়া হয়—
চোখের পলকে, নিঃশ্বাসের ছন্দে।
.
তবুও সে বসে থাকে চৌরাস্তার ধারে,
একটা পুরোনো চায়ের দোকানের ছায়ায়—
যেখানে শেষবার কাঁপা হাতে ধরা হয়েছিল ভালোবাসা,
আর বলা হয়নি সেই শেষ কথাটি।
এখনও শহরের ঘুম ভাঙেনি—
কোলাহলশূন্য এই লোকালয়ে
সে জেগে উঠবে নিজেই—
এই অলীক প্রতীক্ষায় সবাই—কী আজীব!
কিন্তু এই শহরের অলিগলি নিজেও জানে
সে জাগলেই তাকে ধরা হবে আবার
শুনতে হবে নিজেরই নীরবতার আর্তনাদ!
.
মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে—কিন্তু কী জিজ্ঞেস করবে?
বলতে ইচ্ছে করে—কিন্তু কাকে বলবে?
ওহে ঘুমন্ত নগরী—
তোর বুকের নিচে কতটা অন্ধকার?
আমি কি সেই ছায়া—
যাকে তুই মুছে ফেলেছিস অচেনা আলোর ভয়ে?
এসবই পাগলের প্রলাপ হয়ে মিশে যাবে
হয়তো ট্যানারিপাড়ার দুর্গন্ধ বাতাসে,
নয়তো ড্রেনের মুখে দিয়ে ঢুকে যাবে
শহরের অভিজাত আকাশে—
প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসার সম্ভাবনা
এখানে একেবারেই ক্ষীণ।
.
তবু বিশ্বাস রাখা—এই ঘুমন্ত নগরীর উপরই
একদিন সে জেগে উঠবেই, সেটা তার জানা আছে।
সেই একাকী রাতের গানের মতো—
অসংখ্য তারার মেলায় পুরনো স্মৃতি হাতড়িয়ে
শ্রোতামুক্ত গান গেয়ে—
অতল অন্ধকার ছুঁয়ে—
স্নিগ্ধতা ও সুবাতাস মেখে—
ঘুমন্ত নগরী ফিসফিস কণ্ঠ ছেড়ে
হঠাৎ স্ফুলিঙ্গ হয়ে আবার একসাথে গেয়ে উঠবে
যা আগে কেউ শোনেনি।
.
আর তখন, চৌরাস্তার খুব কাছে
নগরীর নিঃশব্দ ভিন্ন রাস্তায় হেঁটে যাবে
একটা মানুষ—
যার হৃদয় থেকে উঠে আসা সুরে
নগরের প্রতিটি বাতি জ্বলবে নতুন করে।
ঘুমন্ত নগরী তার আপ্লুত শরীরে—
স্মৃতির জানালা হাতড়ে বলবে—
ঘুম নয়, ভালোবাসাই একমাত্র বিশ্রাম।
মন্তব্য করুন