উপন্যাস

প্রথম প্রেমের স্পর্শ: পর্ব ৬- চিঠির খামে বন্দি হৃদয়ের কবর

এম এম মাহবুব হাসান
  প্রকাশিত : ৩০ জুন ২০২৫, ১৪:৪২
অ- অ+

চট্টগ্রাম থেকে ফিরেছিলাম এক ধরনের ভার বুকে নিয়ে। সাহিত্য সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা পেরিয়ে, পুরস্কার আর করতালির পরেও এক গভীর শূন্যতা আমাকে গ্রাস করেছিল। ট্রেনের জানালায় বসে ছুটে যাওয়া মাঠ, হাঁসের ঝাঁক, সারিসারি গাছ, নদী, অচেনা মানুষ আর কুয়াশার রেখা দেখে বারবার মনে হচ্ছিল—নীলা এখন কোথায় আছে? সেই ভিড়ের শহরে? নাকি কোনো নির্জন বারান্দায়? তার চোখে এখনও কি সেই চিরচেনা বিষণ্ণতা খেলা করে?

যেখানে নেই কোনো ডাক, নেই কোনো নিশ্চয়তা—শুধু এক ছায়ার মতো বেঁচে থাকা।

ফিরে আসার তিন দিন পর, এক সকালে দরজায় করাঘাত।

আমি দরজা খুলতেই ডাকপিয়নের মুখ।

সে হাতে দিল একটি সাদা খাম।

অচেনা হাতে লেখা ঠিকানায় শুধু লেখা—

“তমালের কাছে—

সেই নীল সন্ধ্যার উত্তর খোঁজার জন্য।”

হাত কাঁপছিল। বুকের গভীরে হঠাৎ এক চাপা ব্যথা।

যেন কারও নিঃশব্দ কান্না আমার বুকে আছড়ে পড়ছে।

খামটা ছিঁড়ে খোলার সময় টের পেলাম—আমার হাত নিস্তেজ হয়ে আসছে।

ভেতরে একটি চিঠি।

নীলার হাতে লেখা।

ছোট ছোট অক্ষরে, হালকা কালি—কিন্তু প্রতিটি শব্দে যেন চাপা এক বিস্ফোরণ।

চিঠির কিছু অংশ—

তমাল,

আমরা একসময় যেভাবে পাশাপাশি হাঁটতাম, সেই হাঁটার শব্দ আমি এখনও রাতে শুনি।

তোমার নিঃশব্দ ভালোবাসা, তোমার আলতো ছোঁয়া, তোমার না বলা কথাগুলো—সব আমি অনুভব করেছি প্রতিটি রাতে।

আমি কখনও বলিনি, কিন্তু আমি তো তোমার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি চোখের চাহনি, এমনকি নিঃশ্বাসও বুঝতাম—তুমিও সেটা হয়তো বুঝতে।

তবে আমি সেই মানুষটা হতে পারিনি, যে তোমার হাত চেপে ধরে বলতে পারে, “থেমে যাও, এখানেই থাকো।”

আমার ভেতরটা ছিল ছায়ায় ঢাকা, আর তোমার ভেতর ছিল আলো।

আমি ভয় পেয়েছিলাম—আমার ছায়া তোমার ওপর পড়ে যাবে।

জানো তমাল,

সেই রাতের পর আমার বিছানার চাদরটা আমি বদলাইনি বহু দিন। তাতে ছিল তোমার শরীরের গন্ধ।

তুমি চলে যাওয়ার পর, প্রতিদিন ঘুমানোর আগে আমি ওই গন্ধে মুখ গুঁজে কাঁদতাম।

ভাবতাম, হয়তো একদিন ঠিক ভুলে যাব।

কিন্তু পারিনি।

আমি কখনওই তোমার ভালোবাসার যোগ্য মনে করিনি নিজেকে। কখনও জোর করে কিছু বলতেও পারিনি। কেন পারিনি, সেটা আমি নিজেও জানি না।

তুমি যেটুকু দিলে, তার চেয়ে অনেক কমই আমি ফিরিয়ে দিতে পেরেছি।

তুমি যদি চাও, এসো।

আমি আর কোনো কথা বলব না, শুধু তোমার হাত ধরব।

আর যদি না চাও… এই চিঠিটা পুড়িয়ে দিও।

যেন আমার সব ভালোবাসা, সব অপেক্ষা—তোমার হাতে শেষ হয়।

— নীলা

চিঠিটা পড়ে আমি চুপ করে বসে ছিলাম অনেকক্ষণ।

বাইরের জানালা দিয়ে তখন রোদের হালকা রেখা এসে পড়েছিল আমার কফির কাপের পাশে।

চিঠির প্রতিটি শব্দ যেন ছুরি হয়ে কেটে যাচ্ছিল আমার ভেতর।

আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম, এক গভীর কবর খুঁড়ে ফেলছি—আমার হৃদয়ের ভিতর।

চিঠিটা পুড়াইনি।

তাকে রেখে দিলাম আমার ডায়েরির সেই পাতায়, যেখানে আমি কোনো দিন নীলার নামের নিচে ‘শেষ’ শব্দটা লিখিনি।

আমি জানতাম—সব চিঠি উত্তর পায় না,

কিন্তু কিছু চিঠি…

চিরকাল উত্তরের অপেক্ষায় থাকে।

চিঠির প্রতিটি শব্দ আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল অন্য এক সময়ের দিকে—আমার মায়ের অতীতের দিকে।

আমার মা, জুলেখা বানু। তিনি বাবাকে ভালোবেসেছিলেন প্রথমে।

একদিন গ্রামের মোড়ে সাহস করে বাবাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন প্রকাশ্যে—সকলের সামনে।

তারপর সেই প্রেমে বাঁধা পড়ে যায় দুটি পরিবার।

আমার বাবা, হিমেল চৌধুরী—একটি সম্ভ্রান্ত ঘরের ভদ্র, লাজুক মানুষ।

বিয়ের পর তাঁরা একে অন্যকে আঁকড়ে ধরেছিলেন যেমন করে আমি চেয়েছিলাম, নীলা আমাকে ধরুক।

মা যখন নতুন বউ হয়ে এলেন, তখন দাদি তাঁকে আলাদা করে যত্ন করতেন। আমি ভাবতাম, মা নীলাকেও তেমনি যত্ন করুক।

আমার জন্মের আগে মা প্রতিদিন পানিপড়া, তেলপড়া খেতেন। আমি ভাবতাম, আমাদের বাচ্চার জন্য আমার মা একদিন নীলাকেও এসব খাওয়াবেন।

আমার মা অন্তঃসত্ত্বা হলে দাদি যেমন পুরো বাড়ি মাথায় করে নাচছিলেন, আমার নীলার বেলাতেও হয়তো মা এমন কিছু করবেন।

বাবা-মায়ের জীবনের সেই প্রেম, সেই ভালোবাসা আমি ছোটবেলায় দেখতে পেতাম।

রাতে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকতাম, আর দেখতাম—

বাবা ধীরে এসে পেছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরছেন। চুমু খাচ্ছেন। তাতে মা একটুও বিরক্ত না হয়ে নিঃশব্দে বাবার হাতে হাত রাখতেন। বাবাকে আরো কাছে টেনে নিতেন।

তারপর আমাকে রেখে অন্য বিছানায় চলে যেতেন—ভাবতেন, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি।

আমি ভাবতাম, নীলার আর আমার সন্তান হলে আমরাও এভাবে চলে যাব।

আজ যখন আমি বড় হয়েছি, যখন আমি নিজের জীবনের প্রেম হারিয়েছি—তখন বুঝি,

সেই রাতগুলো শুধুই স্মৃতি নয়, সেগুলো ছিল এক জীবনের ব্যাখ্যা।

নীলার চিঠি আমার সামনে খুলে দিয়েছিল আরও একটা জানালা।

ভালোবাসা মানেই শুধু একসঙ্গে থাকা নয়, ভালোবাসা মানে ভয়ের সঙ্গে লড়াই করা।

নীলা ভয় পেয়েছিল—নিজেকে, সমাজকে, পরিবারের চাপে আমাকে হারিয়ে ফেলবে।

আমিও তখন মায়ের মতো বলিনি,

“তুমি থাকো, আমি আছি। যেখানেই যাও, ফিরে এসো, আমি অপেক্ষা করব।”

আমি চুপ করে ছিলাম।

আমার ‘ভদ্রতা’—আমার ভালোবাসার এক ব্যর্থ প্রতিরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

আজ ভাবি, মা যদি বাচ্চা নেওয়ার ভয়ে তখন দাদীকে ভয় পেয়ে পালিয়ে যেতেন?

তবে কি আমি পৃথিবীতে আসতাম?

তবে কি সেই ভালোবাসার গল্প, যেটা আমার পরিবার থেকে শুরু, তা আমার গল্পেও এভাবে জড়িয়ে যেত?

নীলার চিঠি পড়ার পরদিন, আমি সেই পুরোনো ছবিগুলো খুঁজে বের করলাম—

বাবা-মায়ের, আমার শৈশবের, আমাদের একসঙ্গে বসে খাওয়ার মুহূর্তের।

তার পাশে রাখলাম নীলার চিঠি।

কারণ সেই দুটো গল্প—একই সূতোয় বাঁধা,

শুধু সময় ভিন্ন।

মা ছিলেন সেই নারী, যিনি ভালোবাসাকে বেছে নিয়েছিলেন—

সমাজ, পরিবার, দোষারোপের ভয় উপেক্ষা করে।

আর নীলা?

সে ছিল সেই নারী, যে ভালোবেসেছিল, কিন্তু নিজেকে সেই ভালোবাসার উপযুক্ত মনে করেনি।

দুই জনেই ভালোবেসেছিল।

দুই জনই কেঁদেছিল দুইভাবে।

তবে একজন ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে তুলতে কেঁদেছিল,

আরেকজন তাকে চিঠির খামে বন্দি করে রেখে দিয়েছে—একটা কবরের মতো।

রাত গভীর হলে আমি জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াই।

আকাশে তখন পূর্ণিমা, নিচে নিঃশব্দে ভেসে যাচ্ছে কিছু ছায়া।

চিঠিটা আবার হাতে নিই।

কান পাতি… যেন দূরে কোথাও কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে।

আমি জানি, সে আর ফিরে আসবে না।

তবু এই চিঠিটা আমার কাছে ফিরে না আসার শেষ স্বীকারোক্তি হয়ে থাকবে।

চিঠির নিচে আবার একটা লাইন খেয়াল করলাম—

যা আমি আগের রাতে চোখ এড়িয়ে গিয়েছিলাম।

“যদি কখনও মনে পড়ে, আমি ছিলাম—একবার বারান্দায় দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখো। আমি হয়তো তখনও তাকিয়ে থাকব সেই একই দিকে।”

আমি জানালার বাইরে তাকালাম।

চাঁদটা পূর্ণ, শান্ত।

আর আমি…

আমি আজও তাকিয়ে আছি—একই সেই দিকের দিকে।

(চলবে)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
বিএনপিতে কেন গুরুত্বহীন লুৎফুজ্জামান বাবর
৩৬ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মাসব্যাপী কর্মসূচির ঘোষণা গণঅধিকার পরিষদের
ডিবির অভিযানে গুলিবর্ষণকারী শীর্ষ সন্ত্রাসী বাপ্পির বাসায় মিলল আরও দুটি বিদেশি পিস্তল
কালকের কর্মসূচিতে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বার্তা থাকবে: রিজভী
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা