উপন্যাস
প্রথম প্রেমের স্পর্শ: পর্ব ৭- মন না জাগলেও শরীর জাগে

রাত প্রায় দুটো।
ঢাকা শহর তখন নিঃশব্দের গহ্বরে নিমজ্জিত। কিছু মানুষ এখনো জেগে, ঘুমের সঙ্গে যুদ্ধ করছে—আমি তাদেরই একজন।
বিছানায় শুয়ে আছি। বই খোলা, টেবিল ল্যাম্প জ্বালানো, চারপাশে নিস্তব্ধতা। সবকিছুই যেন এক মঞ্চসজ্জা, অথচ আমি জানি না, এই নাটকের কেন্দ্রবিন্দুতে আমি কেন।
চোখে ঘুম নেই। হৃদয়ে শান্তির ছায়া নেই। চিঠির পাতায় নীলার হস্তাক্ষর এখনও ঝাপসা হয়ে ভাসে চশমার কাঁচের ওপারে। বারবার পড়েছি, তবু প্রতিবার যেন কোনো নতুন বিষণ্ণতা চেপে ধরে বুক।
ইদানীং অফিসের ফাইলে মন বসে না, কবিতার খাতাতেও কলম চলে না। একটি কবিতা উৎসবে আমন্ত্রিত হয়েও যেতে মন চায়নি।
মনে শুধু একটি প্রশ্নই জেগে থাকে—নীলা কি এখনও জেগে আছে?
এইসব রাতের নিঃসঙ্গতা আরও গভীর করে তোলে বাবার অনুপস্থিতিকে। কত কিছুই তো বলার ছিল, কিন্তু মায়ের চোখে ব্যথার ঘন অন্ধকার দেখে অনেক কথাই আর বলা হয়ে ওঠে না। বাবার মৃত্যুর পর নানা বাড়ির অনেকেই মাকে পুনর্বিবাহের পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমি নিজেও মনে করি—মায়ের বিয়ে করা উচিত ছিল।
মানুষ যতই মানসিক দৃঢ়তায় বুক বাঁধুক না কেন, একসময় শরীরের চাহিদা আর একাকীত্বের ক্লান্তি—সবই পরাজিত করে ফেলে তাকে।
আমার মা, জুলেখা বানু—তিনিও শেষমেশ সেই পরাজয়ের মধ্য দিয়েই হেঁটে গিয়েছিলেন। তার মন না জাগলেও শরীর জেগেছে বারংবার।
পাশের বাড়ির লোকমান চৌধুরী। তিনি সম্পর্কে আমার দাদার চাচাতো ভাই। বাবার মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল পঞ্চাশের কাছাকাছি। মা তাঁকে কাকা বলে সম্বোধন করতেন, আমি ডাকতাম দাদা বলে। লোকটি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। বাজারঘাট, ওষুধপত্র, গৃহস্থালির নানা বিষয়ে মাকে সাহায্য করতেন।
আমাদের বাড়িটি ছিল তিন বিঘা জমির মাঝে। যার মধ্যে মাত্র পাঁচ কাঠা জায়গায় ছিল দোতলা একটি বাড়ি। নিচতলায় ছিল রান্নাঘর, ডাইনিং, ড্রইংরুম, অতিথি ও কাজের লোকদের ঘর। ওপরতলায় ছোট রান্নাঘর, পারিবারিক লিভিং এবং মা-বাবার শোবার ঘর। পূর্ব–পশ্চিম বরাবর টানা বারান্দা আর ছাদে ছিল লোহার বেঞ্চ ও পুরোনো শালের কাঠের দোলনা। সন্ধ্যার পরে সেখানে দাদা-দাদী গল্প করতেন; পরে বাবা-মাকেও সেখানে গল্প করতে দেখেছি।
বাবা বেচে থাকতে ওপরতলায় কাউকে যেতে দেখিনি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর বদলে গেল সবকিছু। লোকমান চৌধুরীর ঘন ঘন ওপরে ওঠা, মায়ের শোবার ঘরে ঢুকে পড়া—আমার শিশু মনেও অস্বস্তির জন্ম দিত। যদিও তিনি সব সময় কিছু না কিছু মুখরোচক খাবার নিয়ে আসতেন আমার জন্য। কিন্তু তাঁর উপস্থিতি ধীরে ধীরে ‘অবিচ্ছেদ্য’ হয়ে উঠল আমাদের জীবনে।
একদিন বারান্দায় খেলা করছিলাম। হঠাৎ দেখি, লোকমান চৌধুরী মায়ের ঘরে ঢুকলেন। কিছুক্ষণ পর মায়ের গলা শুনতে পেলাম—
“দেখেন, আপনি সম্পর্কে আমার চাচা শ্বশুর হন। আপনি যা করছেন, সেটা কি ঠিক হচ্ছে?”
উত্তরে তিনি বললেন—
“তুমি আমার জীবনে খোদার রহমত। হিমেল ছিল আমার খুব প্রিয়, ওর অল্প বয়সে চলে যাওয়ার শোক আজও ভুলিনি। কিন্তু তোমার মতো এমন জোয়ান বউয়ের কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না। আমি তোমার সব বুঝি, শুধু আমাকে একটু শান্তি দাও।”
এরপরই দরজা খটাস করে বন্ধ হওয়ার শব্দ পাই।
আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। সেই সময়ই বুঝতে শিখেছিলাম শরীর আর সম্পর্কের জটিল ভাষা। একদিন খেলতে খেলতে হঠাৎ তৃষ্ণা পেয়ে দৌড়ে ঘরে ছুটে যাই। মায়ের ঘর ভেতর থেকে বন্ধ।
বারবার দরজায় ধাক্কা দিলে মা দরজা খুলেই বিরক্ত হয়ে বললেন—
“তুই আর আসার সময় পেলি না!”
জিজ্ঞেস করলাম—
“কেন মা, কী হয়েছে?”
তিনি বললেন—
“তোর লোকমান দাদার শরীর খারাপ, তাই এসে ঘুমিয়ে পড়েছে।”
আমি পানির তৃষ্ণা মিটিয়ে বের হতে না হতেই সেদিনও খটাস করে দরজা বন্ধ করা হলো।
এরপরও লোকমান চৌধুরীর যাতায়াত থেমে থাকেনি। মা নীরব থাকতেন, কিন্তু তাঁর চোখে থাকত এক অজানা টানাপোড়েন। যেন নিজেকেই প্রতিনিয়ত বোঝাতে চাইতেন—এইটুকু জীবন, যদি একটু শান্তি পাওয়া যায়, তাও কম কী?
দাদী তখনও বেঁচে ছিলেন। বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও নিচতলা থেকে ওপরতলায় লোকমান চৌধুরীর যাতায়াত তাঁর দৃষ্টি এড়াত না। তিনি মাকে বলতেন—
“তুই কাঁদিস না মা, আমি আছি তো।”
কিন্তু মায়ের কাছে তখন আর এই সান্ত্বনার কোনো শক্তি ছিল না। হয়তো সেই অসহায়তাই তাঁকে লোকমান চৌধুরীর শরীরের আশ্রয়ে ঠেলে দিয়েছিল।
একদিন দুপুরে মায়ের বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলাম। মা কাপড় ভাঁজ করছিলেন। হঠাৎ লোকমান চৌধুরী এসে মাকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
মা বললেন—
“তমাল মাত্র শুয়ে পড়েছে, ও উঠে যাবে।”
তিনি বললেন—
“ও উঠলে আজ মেরে ফেলব।”
মা আর এর উত্তরে কিছু বললেন না।
না প্রতিবাদ, না কোন আপত্তি—
শুধু নীরবতায় বহুল প্রত্যাশিত কিছু একটার জন্য কাঁপা কন্ঠে নিজেকে সানন্দে সঁপে দিলেন।
আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করেই থাকলাম। চোখের সামনে যেন বাবার মুখ ভেসে উঠছিল বারবার। আজ যদি বাবা থাকতেন…
এরপর দাদীও আর বেশিদিন বাঁচেননি। কয়েক বছর পর এক সন্ধ্যায় তিনি চিরঘুমে চলে গেলেন। আমাদের সংসারে তখন কেবল আমি আর মা।
বাবার রেখে যাওয়া সম্পদের অভাব ছিল না—জমি, বাড়ি, ব্যাংক ব্যালান্স। কিন্তু আপনজনের অভাব পূরণ হয়নি। উৎসবে কেউ ছিল না পাশে দাঁড়ানোর, বিপদে কাঁধে হাত রাখার কেউ ছিল না।
লোকমান চৌধুরীর দাদাসুলভ আচরণ মাঝে মাঝে আমার ভালো লাগত। কিন্তু মায়ের সঙ্গে তাঁর যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, সেটা কখনও মেনে নিতে পারিনি। তবুও, অদ্ভুতভাবে তাঁকে কখনও শত্রু মনে হয়নি।
মা আমাকে একা হাতে মানুষ করেছেন। শুধু খাইয়ে-পরিয়ে নয়, জীবনের প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি ঘাত-প্রতিঘাতে আমাকে প্রস্তুত করে তুলেছেন।
তিনি বলতেন—
“জীবনে কারও ওপর ভরসা কোরো না। কিন্তু যদি সত্যিকারের ভালোবাসা পাও—তাহলে তাকে ছেড়ে যেও না।”
আমি আজও সেই কথার মানে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি। মা কি ভালোবেসেছিলেন লোকমান চৌধুরীকে? নাকি সেটা ছিল পরাজয়ের এক নিঃশব্দ সম্মতি?
মাঝরাতে যখন ঘুম আসে না, নীলার চিঠি বুকে চেপে ধরি। আর ভাবি—আমার মা, যে সমস্ত জীবন নিঃসঙ্গতার চাপে কুঁকড়ে গিয়েছিলেন, তাঁর মুখে কখনও একবারও ‘ভালোবাসি’ শুনিনি।
অথচ আমি, আজও সেই একটি শব্দ খুঁজি—নীলার ঠোঁট থেকে, কিংবা আমার কবিতার পাতায়।
(চলবে)

মন্তব্য করুন