প্রথম প্রেমের স্পর্শ: পর্ব ৮- নীলার গর্ভে তমালের চিহ্ন

এম এম মাহবুব হাসান
  প্রকাশিত : ০৫ জুলাই ২০২৫, ১৪:৪২
অ- অ+

সকাল পাঁচটা।

জানালার কাচে জমে থাকা শিশিরকণা ঠিক যেন কোনো পুরনো কবিতার অসমাপ্ত লাইন। বাতাসে ভেসে আসা পাখির ডাকেও আছে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা। এই শহর জেগে উঠেছে, রাস্তায় চায়ের দোকানে ধোঁয়া উঠছে, মানুষ ঘর ছাড়ছে—কিন্তু আমার ভিতর এখনো ঘুম জমে আছে। সেই ঘুম, যে রাতে তুমি ছিলে—নীলা।

আমার পাশে, আমার বুকের উপর, আমার শরীরের গভীরে গেঁথে থাকা। সেই রাতে তুমি প্রথম বলেছিলে—

“তমাল, ভালোবাসা মানে শুধু শরীর নয়।

তবু আমি আমার শরীরটা শুধু তোমাকেই দিতে পারি।

কেন যেন মনে হয়, এইটুকু হলেও তুমি আমার হয়ে থাকবে।”

আমি কিছু বলিনি, কারণ সেদিন ভাষা ছিল অপ্রয়োজনীয়। তোমার শরীরই কথা বলেছিল—নিঃশ্বাসে, ছোঁয়ায়, কাঁপুনিতে।

তারপর তুমি বেশ কিছুদিন নিখোঁজ।

আমার ফোনে কোনো সাড়া নেই। বারবার রিং বাজে, তারপর থেমে যায়। হৃদয়ের গভীরে তখন এক অচেনা শূন্যতা জমছিল, যাকে ভাষায় বলা যায় না।

একদিন পোস্ট অফিসের মোড় থেকে ফেরার পথে তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা। মুখোমুখি হতে না চাইলে কী হবে, নিয়তি ঠেলে দিলো সামনে।

উনি চোখে আগুন নিয়ে বললেন,

“তোমার জন্যই আমার মেয়ের সংসার ভাঙতে বসেছে। এখন আর ফোন কোরো না।”

আমি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। সেই মুহূর্তে বুঝলাম—তুমি আর নেই আমার জন্য, তুমি সমাজের নিয়মে অন্য কারো হয়ে গেছো। তোমার হাসি, তোমার দৃষ্টি, তোমার শরীরের সেই ঘ্রাণ—সবই হয়তো আজ অন্য কারো আয়ত্তে।

তোমার স্বামী একজন সুসজ্জিত, ভদ্রলোক।

তবে তার ভদ্রতার মুখোশের নিচে ছিল অস্বীকৃতির বিষ।

সে তোমার গর্ভে লালিত এই সন্তানকে নিজের বলে স্বীকৃতি দিতে চায়নি।

সে চেয়েছিল, তুমি গোপনে ‘মিটিয়ে’ ফেলো সবকিছু।

তুমি সেটা করোনি, নীলা।

তুমি আমার সন্তানকে নিজের শরীরে বয়ে নিয়ে চলেছিলে, সমস্ত ঘৃণা, সমস্ত প্রশ্ন, সমস্ত অভিযোগ উপেক্ষা করে।

“তোমার সন্তান কার?”—এই প্রশ্ন যেন প্রতিনিয়ত তোমার গায়ে ছুরি চালিয়েছে।

তবু তুমি দমে যাওনি।

তুমি নিজেকে বলেছিলে,

“যদি এই সন্তান তমালের, তবে ওর মধ্যে আমার প্রেম থাকবে। আমি চাই সেই প্রেম পৃথিবীতে বাঁচুক।”

তোমার সেই সাহস আমাকে এখনো স্তব্ধ করে দেয়।

তোমার শাশুড়ি একদিন মুখ ফসকে বলেছিল,

“অবৈধ সন্তান নিয়ে ঘর করা যায় না।”

তুমি তাকে একবার গভীরভাবে তাকিয়ে বলেছিলে—

“অবৈধ কেউ নয়, এই সন্তান আমার গর্ভে ভালোবাসায় জন্ম নিয়েছে। তার চেয়ে পবিত্র কিছু আমি জানি না।”

তুমি সেই রাতেই ঘর ছেড়েছিলে।

তোমার কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা ছিল না, ছিল না নিজের একটা বিছানা।

তবু তোমার গর্ভে ছিল ভবিষ্যতের একটা স্বপ্ন—যে পৃথিবীতে আসতে চাইছিল সমস্ত অন্যায়, ঘৃণা আর প্রশ্নকে উপেক্ষা করে।

অনেক দিন পর, চট্টগ্রামে তোমার সঙ্গে থাকা ছোট মেয়েটিকে দেখে আমি থমকে গিয়েছিলাম।

মেয়েটির চোখে ছিল ঠিক তোমার মতোই গভীরতা, কিন্তু পেছনের ছায়া যেন আমারই।

আমি ভেবেছিলাম, ভুল দেখছি।

তুমি তাকিয়েছিলে আমার দিকে।

তোমার চোখে ছিল না কোনো অভিযোগ, না কোনো অভিমান।

ছিল এক গভীর প্রশান্তি—যেন কিছুই বলার নেই, শুধু জানিয়ে দেওয়া।

আমরা কথা বলিনি।

কিন্তু আমি বুঝে গিয়েছিলাম, তুমি এখন একা মা, আর সেই ছোট্ট মেয়েটি আমার রক্তেরই অর্ধেক।

নীলা, তুমি জানো?

আমি অনেক রাতে জেগে থাকি।

বালিশে তোমার গন্ধ খুঁজে ফিরি।

কল্পনায় দেখি—তুমি আমার পাশে শুয়ে আছো,

আর পাশের বিছানায় ঘুমাচ্ছে আমাদের মেয়েটি।

তার নাম রেখেছো কী?

আমি ভেবেছিলাম, যদি তার নাম রাখি “আলোরেখা”, তবে সে আমাদের জীবনে আলোর একটি রেখা হয়ে থাকবে।

তুমি কি সেই নামই রেখেছো?

তুমি এখন সংসার করো না।

একটা ছোট স্কুলে পড়াও।

ছোট্ট একটা ঘর, নিজস্ব আয়, আর সেই একরত্তি মেয়েটিই এখন তোমার সম্পূর্ণ জগৎ।

আমি জানি না, তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো কিনা।

তবে তুমি যে আমার প্রেমকেই জন্ম দিয়েছো, সেটা জানি।

আমার কাছে তুমি একজন যোদ্ধা—

তুমি ভালোবাসা, তুমি বিসর্জন, তুমি মা, তুমি ঈশ্বরী।

তুমি বলেছিলে—

“তমাল, আমি চাই না আমার প্রেম শুধু চোখে চোখ রেখে থেমে যাক। আমি চাই তুমি আমায় পুরোপুরি ছুঁয়ে দেখো।

আমার ভয়গুলো খুলে দাও, আমার ভিতরের আমাকে দেখে ফেলো।”

সেই রাতে আমি তোমাকে ছুঁয়েছিলাম—

যেভাবে পূজারী ছুঁয়ে দেয় তার দেবতাকে।

তোমার কাঁপুনি, তোমার কান্না, তোমার ঠোঁটের কম্পন—

সবটাই আজো আমার মধ্যে জীবন্ত।

সেই রাতে তুমি বলেছিলে—

“তুমি যদি থেকো, আমি তোমার সন্তান বহন করতেও রাজি।”

আমি হেসেছিলাম, বলেছিলাম—

“আমরা তো কোনোদিনই আলাদা হব না, নীলা।”

কিন্তু হয়েছি। আমরা হয়েছি।

তোমার মেয়েটি এখন বড় হচ্ছে।

তোমার ফেসবুক প্রোফাইলে ওর ছোট ছোট ছবিগুলো দেখি।

তুমি ওর পেছনে ছুটছো, ও হাসছে।

কখনো কখনো ভাবি, যদি সে একদিন এসে জিজ্ঞেস করে—

“আমার বাবা কে?”

তখন তুমি কী বলবে?

তুমি কি আমার নাম বলবে, নীলা?

আমি জানি, সমাজ তোমায় একাধিকবার আঘাত করেছে।

তোমার চাকরির কাগজে লেখা আছে “বিবাহিত”—

কিন্তু তুমি এখন আর কোনো স্বামীর সঙ্গিনী নও।

তুমি প্রতিদিন যুদ্ধ করো—নিজের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে, অতীতের সঙ্গে।

এই সমাজ তোমাকে ‘পাপিনী’ বলেছে,

কিন্তু আমি জানি, তুমি ঈশ্বরী।

তুমি সেই নারী, যে ভালোবাসাকে বাঁচাতে নিজের শরীর, আত্মা, জীবন দিয়ে দিয়েছে।

সেদিন তুমি আমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলে।

তুমি লিখেছিলে—

“তমাল, আমি জানি তুমি আসবে না।

তবু আমি লিখি, যেন আমার প্রতীক্ষা পরিপূর্ণ হয়।

তুমি যদি কখনো আমার মেয়েকে দেখো,

তোমার যদি মনে হয়, তার চোখে তোমার ছায়া—

তবে জেনে নিও, আমি কোনোদিন তোমায় মুছে ফেলিনি।

আমি প্রতিদিন একটা ‘যদি’ নিয়ে বাঁচি।

যদি তুমি একদিন ফিরে আসো… শুধু একবার।”

আমি সেই চিঠি হাতে নিয়ে বসে ছিলাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

চোখের জলে কাগজটা ভিজে উঠেছিল।

তবু কাগজটা এখনো আমার বুকপকেটে, ঠিক হৃদয়ের পাশে।

আজ সকালে মনে হচ্ছে আমি সেই ছোট্ট মেয়েটিকে আবার দেখতে চাই।

তোমাকে কিছু বলতে চাই না,

শুধু একবার ওর চোখে নিজের ছায়া খুঁজে নিতে চাই।

যদি সে সত্যিই আমার হয়,

তবে ওর হাতে হাত রেখে বলব—

“তুমি আমার প্রথম প্রেমের চিহ্ন,

তুমি আমার ভোরের জানালায় লেগে থাকা প্রথম শিশির,

একটি অসমাপ্ত কবিতার নাম—

যা শুধু একজন মা নয়, ঈশ্বরীর গর্ভ থেকে পৃথিবীতে এসেছে।”

তোমার ভাবনায় এভাবেই রাত পেরিয়ে সকাল,

সকাল পেরিয়ে বিকাল তবুও তুমি থাকো মনের গহীনে- অন্তহীন ভালোবাসার ঠিকানা হয়ে।

(চলবে)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
টয়োটার ব্যবসা হারাচ্ছে নাভানা?
সারজিস বনাম নওশাদ: ভোটে কার পাল্লা ভারি?
মনোহরদীতে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে ছাত্রদল নেতা গণধোলাইয়ের শিকার
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদও জয় করব: নাহিদ
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা