উপন্যাস

প্রথম প্রেমের স্পর্শ: পর্ব ১০- একটি অসমাপ্ত কবিতার ঘরে ফেরা

এম এম মাহবুব হাসান
  প্রকাশিত : ০৭ জুলাই ২০২৫, ১০:২৫
অ- অ+

ঘরটার এক কোণায় ধুলো জমে থাকা একটা ট্রাঙ্ক অনেকদিন খোলা হয়নি।

বাবার পুরনো জামাকাপড়, আমার প্রথম লেখা কবিতার খাতা, কিছু স্যাঁতসেঁতে পোস্টকার্ড, আর কিছু চিঠি—যেগুলোতে ঠিকানা ছিল, প্রাপক ছিল, কিন্তু প্রেরক ছিল নিঃশব্দ।

সেদিন সকালবেলা মা কিছু খুঁজতে গিয়ে বললেন,

“এই ট্রাঙ্কটা তো বহুদিন খোলা হয়নি, ওটা তুই একবার দেখ।”

আমি কিছু না বলে বসে পড়লাম পুরনো ধুলোয়।

চোখে-মুখে নস্টালজিয়ার ছিটে পড়তে লাগল।

হঠাৎই খাতার নিচে বেরিয়ে এলো একটা পাতলা নীল রঙের নোটবুক।

খোলার সঙ্গে সঙ্গে আমার হৃদপিণ্ড কেমন ধক করে উঠল।

এই হাতের লেখা আমি চিনেছি অগণিত রাতের স্বপ্নে।

নীলার হাতে লেখা।

নোটবুকের প্রথম পাতায় লেখা:

“তমাল,

এই চিঠিগুলো কখনও তোমার হাতে পৌঁছাবে কি না জানি না।

তবু লিখি, কারণ ভালোবাসা বলে দিতে না পারলে শরীরে ও মন ব্যথা ধরে।”

চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে এলো সব কিছু।

একটা ঝড়ো নিশ্বাসে পাতা উল্টাতে শুরু করলাম।

প্রথম চিঠি:

“তোমার চলে যাওয়ার পর আমি আয়নার সামনে দাঁড়াইনি অনেকদিন।

নিজেকে দেখতে ভয় লাগে।

যে মুখ তোমার কাছে ছিল কোমল, সে মুখ এখন সবার সামনে হয়ে উঠেছে কঠোর।

তবে একা ঘরে আমি এখনও তোমার নাম নিঃশ্বাসে ডাকি।

আমার শরীরের ভেতরে যে হৃদয়ের বাস, তা এখনও তোমার ছায়া ধরে ঘুমায়।”

দ্বিতীয় চিঠি:

“তোমার সন্তান আমার শরীরে বেড়ে উঠছিল,

তুমি জানো না।

তোমার অজান্তেই আমি এক গভীর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম—

আমি এই সমাজের প্রশ্ন, অবজ্ঞা, আঙুল—সব উপেক্ষা করে এই প্রাণটিকে পৃথিবীর আলো দেখাব।

কিন্তু সেই যাত্রা আমার সহজ ছিল না।

তবে ওকে তুমি চিনতে পারবে কি না, জানি না।

ওর চোখ তোমার মতোই, শুধু ওর হাসিতে আমার কান্না লুকানো থাকে।”

আমি আর পড়তে পারছিলাম না। হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে..

চোখের কোণে জলের পর্দা।

বুকের ভেতর জমে থাকা যে ক্ষোভ ছিল—তাকে এখন মনে হলো নিজেরই ভুল বোঝাবুঝি।

আমি নীলার বার্তাটি পেয়েছিলাম, “আমি বেঁচে আছি”—

কিন্তু নীলা তো শুধু বেঁচে ছিল না, সে আমায় হৃদয়ে রেখেই বেঁচে ছিল।

সন্ধ্যায় হালকা বৃষ্টি।

মা পাশের ঘরে রান্না করছেন।

আমি বারান্দায় বসে আছি, হাতে সেই নোটবুক, মনে এক অদ্ভুত আলোড়ন।

ঠিক তখনই দরজায় একটা ধাক্কা।

ধক করে উঠল বুক।

সন্দেহ, কল্পনা, ভয়—সব একসাথে ধেয়ে এলো।

দরজা খুলতেই দেখি, এক নারী—চোখের নিচে হালকা কালি, মাথায় খোলা চুল, পরনে নীল শাড়ি।

নীলা।

পাশে একটা ছোট্ট মেয়ে দাঁড়িয়ে—হাতটা শক্ত করে মায়ের আঁচলে ধরেছে।

নীলার চোখে জল টলটল করছে।

বলল—

“তোমার কাছে ফিরে আসতে অনেক সাহস লাগে, তমাল।

আজ সেই সাহস করেছি। জানিনা সেটা কতটুকু স্থায়ী হবে”

আমি কথাও বলতে পারলাম না।

মেয়েটি এক পা এগিয়ে এসে বলল,

“তুমি কি তমাল আঙ্কেল?”

আমার বুকের ভেতর কেমন যেন একটা শব্দ করে ভেঙে পড়ল একটা দেওয়াল।

আমি হাঁটু গেড়ে বসে বললাম,

“তুমি কে নাম বলো তোমার?”

সে মৃদু হেসে বলল,

“তোমার লেখা কবিতার নামেই তো—‘আলো’র গল্প।”

আমি বুঝলাম, নীলা সেই চিঠিগুলো শুধু নিজের কষ্ট লাঘবের জন্য লেখেনি,

ও একটা দিন কল্পনা করেছিল—যেদিন তার সন্তান বাবার সামনে দাঁড়িয়ে নাম বলবে।

আমার হাত দুটো কাঁপছিল।

আমি আলোর হাত ধরলাম।

ও বলল,

“তুমি কি আমায় ভালোবাসো?”

আমি ওকে বুকে জড়িয়ে নিলাম।

আর কিছু বলার ছিল না।

মা ঘর থেকে চোট পায়ে বেরিয়ে এলেন।

নীরব বিস্ময়ে নীলার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,

“তুই?”

নীলা মায়ের এমন প্রশ্নে একটু বিচলিত হলো,

কিছুক্ষণ চুপ থেকে নীলা মাথা নিচু করে বলল,

“আমি চলে গিয়েছিলাম তমালকে ছেড়ে, আজ ফিরে এলাম কিছু হিসেব বুঝিয়ে দিতে।

তবে আজ আর শুধু নিজের জন্য ফিরিনি।”

ও মেয়ের দিকে ইশারা করল।

মা কিছুমাত্র দ্বিধা না করে আলোর কপালে হাত বুলিয়ে বললেন,

“তুই আজ থেকে আমার নাতনি। তুই আমার কাছেই থাকবি।

ভাত খেয়েছিস?”

আলো মাথা নাড়ল না, না ও করল না।

মা বললেন

“চল, খিচুড়ি রাঁধা আছে, খেয়ে নিবি।”

আলো মায়ের সাথে খাবার ঘরে চলে গেল।

নির্জন সন্ধ্যায় এক পশলা বৃষ্টি যেন শহরের ক্লান্ত মুখটা ধুয়ে-মুছে স্নিগ্ধ করে দিল।

ভ্যাপসা গরমের ভারী অবরোধ যেন এক ঝটকায় হালকা হয়ে গেলো। বাতাসে এক ধরনের শীতলতা—শরীরে আর মনে—

তবুও কেমন এক গন্ধ ভাসছে চারপাশে।

কোনো অদৃশ্য বস্তু কিংবা অনুভব,

কিন্তু সে গন্ধ যেন আমাকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে।

সে গন্ধে লুকিয়ে আছে উষ্ণতার এক গুপ্ত উৎস—

যা আমার শরীরের প্রতিটি জমাট বরফ গলিয়ে দিতে চায়,

আমার শিরা-উপশিরায় ঢেউ তুলতে চায়।

এরই মাঝে রাত নেমে এসেছে নীরবে,

ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে গেছে অচেনা কোনো সময়ের দিকে।

আলোর নরম দীপ্তি ঘরে ছায়ার খেলা করছে।

ঠিক তখনই নীলা এলো—

চুপিসারে, যেন বাতাসেও তার পায়ের শব্দ নেই।

আমার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ,

তারপর নিঃশব্দে ভেতরে এল।

হালকা আবছা আলোয় ওর মুখটা পুরোটা বোঝা যাচ্ছিল না,

তবুও চোখ দুটি ছিলো যেন ঝরনার মতো স্বচ্ছ—

নীরব, অথচ বর্ণনাতীত কিছু বলছে।

ওর উপস্থিতি আমার ঘরের বাতাসকেও উষ্ণ করে তুললো।

এক মুহূর্তে সব শীতলতা,

সব গুছিয়ে রাখা অনুভূতি

আবার নতুন করে আলোড়িত হলো।

নীলার ওই নীরব আগমন যেন রাতের শরীরে এক অনুচ্চারিত কবিতা হয়ে নেমে এলো।

আলোকছায়ার সেই খেলায়, আমার ঘরটাও যেন এক রহস্যময় মঞ্চে রূপ নিলো—

যেখানে ভাষার দরকার নেই,

শুধু অনুভবই যথেষ্ট।

নীলা বলল,

“আমরা কোথায় যাব এখন, তমাল?

তুমি কি আমাদের জায়গা দেবে?”

আমি উত্তর দিলাম না।

ওর দিকে তাকিয়ে শুধু বললাম,

“আমার পৃথিবী তো তোদের ফাঁকেই খালি পড়ে ছিল এতদিন।”

ও বলল,

“তোমার কবিতার শেষ পঙক্তি আমায় ডাকত প্রতিদিন।”

আমি বললাম,

“তোমার চোখই তো আমার প্রতিটি কবিতার শুরু।”

নীলা এসে মাথা রাখল আমার বুকে।

একটা দীর্ঘ নীরবতা।

তারপর হঠাৎ ফিসফিস করে বলল,

“তমাল, আমি সেই চিঠিগুলো কখনও পোস্ট করতে পারিনি।

কারণ আমার ভয় ছিল—তুমি ফিরবে না।

কিন্তু আজ, আমার মেয়ে আমায় সাহস দিয়েছে।

তোমাকে বলতে এসেছি—আমি এখনও ভালোবাসি।

কিন্তু এই ভালোবাসা একা আমার না, এখন আর আমি একা নই।”

আমি বললাম,

“ভালোবাসা যতবার হারায়, ততবার সে ফিরে আসে অন্য নামে।

আলো—তোমার দেওয়া আমার নতুন নাম।”

রাত গভীর।

মা ঘুমিয়ে পড়েছে।

আলো পাশে বিছানায় জেগে আছে।

নীলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল।

আমি কাছে যেতেই বলল,

“তমাল, এত বছর পর আমি আর ফিরে আসতে চাইনি।

কিন্তু জানো, একদিন রিকশায় তোমায় দূর থেকে দেখেছিলাম।

তুমি তাকিয়ে ছিলে আমার মেয়ের দিকে।

সেই চোখের ভাষা আমায় টেনে এনেছে।”

তমাল, তুমি যেভাবে আমাকে দেখছ, আমি আদৌ সে রকম নই,”

নীলার কণ্ঠে ছিল একধরনের মৃদু কাঁপুনি—অবদমন আর স্বীকারোক্তির মিশেল।

“আমি একেবারে আলাদা একজন মানুষ। আমার শৈশব, আমার বেড়ে ওঠা—সবই ঘটেছে এক ভিন্ন রকমের যুদ্ধের ভেতর দিয়ে। প্রতিটি দিন ছিল একটা যুদ্ধ… বেঁচে থাকার, টিকে থাকার।”

সে একটু থামল। চোখের কোণে জল জমেছে কি না, বোঝা গেল না, কিন্তু গলায় জমে থাকা শব্দগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল।

“আমি তোমাকে অনেক কিছু দিয়েছি, তমাল। নিজের ভালোবাসা, শরীরের স্পর্শ, এমনকি জীবনের অজস্র মুহূর্ত… কিন্তু নিজেকে পুরোপুরি তোমাকে দিতে আমি ভয় পাই। আজও।”

আমি কিছু বলার আগেই নীলা আবার বলল,

“আমার ভেতরে এমন কিছু গল্প আছে, এমন কিছু না-বলা ব্যথা, যেগুলো কখনও তোমাকে বলা হয়ে ওঠেনি। সাহস পাইনি… অথবা কখনও পাইনি সেই সময়টুকু।”

নীলার আঠালো কণ্ঠ, তার ভেতর থেকে উঠে আসা শব্দের ভার—সবকিছু মিলিয়ে আমাকে যেন এক নিমিষে স্তব্ধ করে ফেলল। আমার কণ্ঠে শব্দ ছিল না, শুধু হৃদয়ের ভেতর একটা অচেনা হাহাকার ছড়িয়ে পড়ছিল…

আমি ওর পাশে দাঁড়িয়ে বললাম,

“নীলা, আমরা কেউ ফিরিনি।

আমরা শুধু যাত্রাটা স্থগিত রেখেছিলাম।”

আমার কথা শুনে নীলা কেমন যেন কেঁপে উঠল। নারী-পুরুষের মিলনের চূড়ান্ত সুখের মুহূর্তে যেমন শরীর কেঁপে উঠে একে অপরের মাঝে স্বস্তির সুখ ছড়িয়ে দেয়, নীলার এই কেঁপে ওঠাও যেন তেমনি এক স্বস্তির সুখ বিলিয়ে দেওয়ার মুহূর্ত।

ও আমার হাতে হাত রাখল।

তিনটি হাত—

আমি, নীলা, আলো।

একটি অসমাপ্ত কবিতা—আজ যেন নতুন করে শুরু হলো।

(চলবে)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
নদী ভাঙনে ধসে পড়ল ফেনীর সোনাগাজীর ৩ সড়ক
জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডে রাজসাক্ষী হলেন সাবেক আইজিপি মামুন 
ইতিহাস গড়ে মিয়ামিকে জেতালেন মেসি
চাঁদপুরে দেশীয় অস্ত্রসহ কিশোর গ্যাংয়ের ৬ সদস্য গ্রেপ্তার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা