উপন্যাস
প্রথম প্রেমের স্পর্শ: পর্ব ১৩- আলোর চোখে দ্বিতীয় প্রেমের যাত্রা

আমি—‘আলো’,
আমার নামের ছায়াতেই বেঁচে আছে এক মহীয়সী নারীর ইতিহাস,
যার নাম নীলা বিশ্বাস।
যিনি ছিলেন মা, প্রেমিকা, যোদ্ধা—
আর একজন ‘আলো’র নি:স্বার্থ উৎস।
আমার মা নীলা বিশ্বাস ছিলেন ছায়ার মতো কোমল, আবার পাহাড়ের মতো অবিচল।
তিনি একা মানুষ করেছেন আমাকে, নিজের সমস্ত আলো আর অন্ধকার গায়ে মেখে।
তাঁর বুকের উষ্ণতায় আমি শিখেছি ভালোবাসা কাকে বলে,
আর তাঁর নীরব কান্নায় বুঝেছি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত নারীরও গভীরে থাকে এক সমুদ্রের জোয়ারভাটা।
আমার পিতার নামটুকু সমাজের কাগজে ছিল মাত্র, হৃদয়ের পাতায় নয়।
তিনি ছিলেন মালয়েশিয়ার এক বহুজাতিক কোম্পানির নির্বাহী কর্মকর্তা—
অত্যন্ত সুশৃঙ্খল, নিখুঁত, সময়নিষ্ঠ।
কিন্তু তাঁর ভেতর ছিল না কোনো ঋতুচক্র, কোনো ছায়া, কোনো শিকড়ের টান।
তিনি ছিলেন ধাতব, নির্বিকার, গাণিতিক এক মানব—
আমি আজও ভাবি—
আসলে বাবা কাকে বলে?
যিনি জন্ম দেন?
না, যিনি কাগজে নাম লেখান?
কিন্তু আমি জানতাম, আমার মায়ের চোখে বাস করতেন আরেকজন—যিনি আমার প্রকৃত বাবা।
একজন অনুপস্থিত পুরুষ,
একজন অনলস প্রেমিক,
একজন কবি,
যিনি কখনো আমাদের সেভাবে জীবনে আসেননি,
তবুও আমাদের সমস্ত জীবনের ভিতর ঢুকে ছিলেন নীরবে।
তিনি তমাল চৌধুরী—একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের নিঃসঙ্গ জ্যোতি, একমাত্র সন্তান। জীবনের শুরুতে পিতার স্নেহের ছায়া হয়তো ছিল না, কিন্তু মাতৃস্নেহের কোমল স্পর্শে তিনি ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছেন এক নিঃশব্দ শক্তিতে। মায়ের আঁচলের উষ্ণতা তাঁর চরিত্রে গেঁথে দিয়েছিল এক ধরনের সহনশীলতা ও মমতার গভীরতা।
কাকতালীয়ভাবে, পেশাগত জীবনে তিনিও একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়ে উঠেছিলেন। কর্পোরেট রঙিন জীবন তাঁকে দিয়েছিল অর্থ, খ্যাতি ও কাঠামোবদ্ধ একটি রুটিন, যেখানে তিনি ছিলেন নিখুঁত, সুশৃঙ্খল, প্রায় যন্ত্রের মতো সময়নিষ্ঠ।
তবে সেই পরিপাটি জীবনের আড়ালে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল ঠিক বিপরীত—এলোমেলো, আবেগপ্রবণ, এবং অনেকটা অজানা বেদনায় আচ্ছন্ন। মনের ভেতর জমে থাকা না বলা কথাগুলো, অসমাপ্ত চিঠিগুলো কিংবা অতীতের কোনো চিরায়ত অভিমান যেন প্রতিদিনই তাঁকে একটু একটু করে ভেঙে দিচ্ছিল—যেন একটি সুগঠিত প্রাসাদের ভেতরে চুপিসারে বসবাস করছিলো এক পরিত্যক্ত নিঃসঙ্গ পুরুষ।
আমি ছোটবেলায় মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখতাম,
মা ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন।
কখনো শূন্যের দিকে তাকিয়ে থাকেন, কখনো চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে কিছু বলেন,
যেন কেউ তাঁর পাশে আছে—
আমার অদেখা বাবা,
না কি সেই অদৃশ্য প্রেমিক?
আমি জিজ্ঞেস করলেই মা মৃদু হাসতেন।
“তোমার বাবার কথা ভাবছিলাম।”
তবু আমি বুঝতাম—এই ‘বাবা’ সে বাবা নয়,
যিনি প্রতিদিন সকালে পত্রিকা হাতে আমাদের বাসায় বসে থাকতেন।
মায়ের মৃত্যুর পর, ঘর গোছাতে গিয়ে আমি পেলাম একটা পুরনো লোহার ট্রাঙ্ক।
ভেতরে যত্নে রাখা অসংখ্য চিঠি।
সবই লেখা এক মানুষকে উদ্দেশ করে।
যিনি তমাল।
প্রতিটি চিঠির শব্দে একটা জ্বলন্ত আত্মা ছিল—
প্রেম, পাপ, ক্ষমা, আকাঙ্ক্ষা, বিষণ্ণতা, উদ্দীপনা আর অনন্ত প্রতীক্ষার মিশ্রণে গড়া এক হৃদয়ের দলিল।
আমি চিঠিগুলো পড়তে পড়তে কাঁপছিলাম।
কখনো চোখে জল আসত না, বরং বুকের ভেতর একটা শূন্যতা ফেটে পড়তে চাইত।
আমি বুঝলাম—
আমার জন্ম হয়েছিল এক অসমাপ্ত প্রেমের কোলাজ থেকে।
সেই সময় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ি।
একদিন বইমেলায় এক অচেনা লোক এসে দাঁড়াল আমার সামনে।
চুলে সাদা রেখা, কপালে ক্লান্তির ভাঁজ, তবু দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত আকর্ষণ।
তিনি সরল স্বরে বললেন—
“তোমার নাম আলো?”
আমি মাথা নাড়লাম।
তিনি কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন—
“তোমার মা কি নীলা বিশ্বাস?”
আমার ঠোঁট কেঁপে ওঠে।
আমি কোনো কথা বলতে পারি না।
তিনি তখন বললেন—
“আমি তমাল।
তমাল কবি।”
আমার শিশুকালের স্মৃতির ফাঁকগলে তার সাথে দুই-তিনবার সাক্ষাতের কিছু ঝাপসা মুহূর্ত মনে আসতে চাইলো, কিন্তু পুরোটা আসে না।
তবে এটা বুঝতে বাকি রইল না,
মা যে নামটা মুখে আনতেন না,
কিন্তু বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখতেন—
আজ সেই মানুষটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে।
এক মুহূর্তে আমি অনুভব করলাম—
এই মানুষটা আমার জীবনের অনুপস্থিত অধ্যায়ের একমাত্র জীবন্ত পৃষ্ঠা।
তাকে নিয়ে মায়ের কবর দেখতে যাওয়ার পর
আমরা সেদিন ধানমণ্ডির এক ক্যাফেতে বসেছিলাম।
তিনি চুপচাপ ছিলেন, আমি খরগোশের মতো ভয়ে জড়সড়।
— “তুমি কবিতা লেখো?”
তিনি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন।
— “লিখি… তবে তোমার মতো হয় না।”
তিনি মৃদু হেসে বললেন—
“তুমি আমার মতো নও, তুমি নীলার মতো।
তোমার ভেতরে যে ব্যথা, তা কেবল জন্ম দিয়ে আসে না—
ভালোবাসা দিয়েও আসে।”
আমি জানি না, কেন তখন আমার চোখ ভিজে উঠেছিল।
হয়তো সেই ‘নীলার মতো’ শব্দটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম পূর্ণ স্বীকৃতি।
যেটা কেউ কখনও আগে বলেনি, ভাবেওনি হয়তো।
সেই শব্দ দুটো ছিল যেন এক দীর্ঘ নিঃসঙ্গ পথচলার শেষে দেখা পাওয়া কারো স্পর্শ,
যা বুকের ভেতরে জমে থাকা শূন্যতার দেয়ালে এক মুহূর্তে জোয়ার এনেছিল।
মনে হচ্ছিল, তাকে একটু জড়িয়ে ধরি—
ধরি এমনভাবে, যেন একটুখানি স্পর্শে মিলিয়ে যায় এই ভেতরের অনাহূত হাহাকার,
বুকের গোপন গহ্বরে জমে থাকা হিমশীতল নিঃসঙ্গতা আর শব্দহীন কান্না।
তাকে কাছে টেনে নিয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল—
‘তুমি বুঝেছো আমাকে,
যেভাবে কেউ কোনোদিন বোঝেনি।’
মনে হয় নিজের আপন বাবাকে একবার ‘বাবা’ বলে ডাকি, কিন্তু সেই ডাকে তিনি কি সাড়া দেবেন? তিনি কে আমাকে স্নেহের পরশে বুকে টেনে নেবেন?
এসব ভাবতে ভাবতে এক আশ্চর্য বন্ধন গড়ে ওঠে আমাদের মাঝে।
তিনি ছিলেন আমার অদেখা অতীতের একমাত্র সাক্ষ্য।
তিনি ছিলেন আমার মায়ের প্রেমিক—তবু আমারও এক ধরনের জন্মান্তরের আত্মীয়,
শিক্ষক, পাঠক, আমার কৌতূহলী মনের প্রতিফলন।
তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন—
প্রেম মানে কেবল অনুভূতি নয়, এটি একটি বিশ্বাস,
প্রেম মানে অতীতকে ধারণ করে ভবিষ্যতের দিকে হাঁটা।
একদিন আমি সাহস করে বললাম—
“তুমি জানো, মা বলেছিলেন,
যদি কখনো প্রেমে পড়ি, যেন তোমার মতো কাউকে খুঁজি?”
তিনি চুপ করে থাকলেন।
আমি বললাম,
“আর আমি খুঁজেছি… অনেকবার… কিন্তু পাইনি।”
তমাল তখন গভীরভাবে আমার চোখে তাকিয়ে বললেন—
“কারণ তুমি খুঁজছিলে প্রেম নয়, ছায়া।
তুমি যাকে খুঁজছিলে, সে তোমার জন্মের আগেই তোমার হয়ে গিয়েছিল।”
আমরা মাঝে মাঝে যেতাম নীলার কবরের পাশে।
আমি ফুল রাখতাম,
তিনি পড়তেন কবিতা।
একবার তিনি পড়ে শোনালেন—
“আমি এখন আলোকে ছুঁয়ে বুঝি—
তুমি হারাওনি—
তুমি আছো,
এক অলক্ষ স্মৃতির মতো—
পাতা ভেজা ভোরে, কুয়াশার গায়ে,
এক ম্লান কদমফুলের ঘ্রাণে…”
আমি সেই মুহূর্তে বোঝাতে পারিনি,
তবে অনুভব করেছিলাম—আমার জীবনের গল্প, যা এতদিন অজানা ছিল,
তা আসলে শুরু হয়েছিল তমালের কবিতার শব্দ থেকেই।
এর দুই বছর পর, হঠাৎ এক ভোরবেলা ফোন আসে।
তমাল নেই।
গভীর উদ্বেগের সাথে জানতে চাইলাম-
কি হয়েছে তমালের?
হার্ট অ্যাটাক!
মৃত্যুর সময় তিনি বারান্দায় বসে ছিলেন।
চায়ের কাপ পাশে, আর একটা খোলা নীল খাতা।
শেষ পাতায় লেখা—
“আমি তোমায় ভালোবাসি, এমন নয়—
আমি ভালোবাসার নামেই তোমায় চিনতাম।”
আমি সেদিন ভেঙে পড়েছিলাম,
কিন্তু নিজেকে নিঃস্ব মনে করিনি,
বরং ভাবলাম—তাঁরা দুজনেই এক জায়গায় মিলিত হলেন,
যেখানে কবিতা আর প্রেম একসঙ্গে ঘুমায়।
আজ আমি নিজেই কবিতা লিখি।
তবে নীলার মতো নয়, তমালের মতো নয়—
নিজের মতো।
আমি লিখি সন্ধ্যার আকাশ দেখে,
চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ দেখে,
নিঃশব্দে ঝরে পড়া কদম ফুল দেখে।
আমি জানি—
আমার জন্ম হয়েছে একটি অসমাপ্ত প্রেম থেকে।
তবে আমার জীবন সেই অসমাপ্ততাকে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে।
আমি আজও মাঝে মাঝে যাই সেই কবরস্থানে।
দুইটি কবরে পাশে দাঁড়াই—একটি মায়ের, একটি মায়ের প্রেমিকের। আমি তাকে বাবা না বলে মায়ের প্রেমিক বলি,
কারণ আমার বাবার স্থানটিতে সামাজিকভাবে জায়গা করে নিয়েছেন আমার মায়ের স্বামীর নামটি।
কবর দেখে চিন্তা করি-
দুজনেই কি শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন!
তাদের কেউ আর নেই,
তবু আমি জানি—
আমি যখন কোনো কবিতায় “নীল” শব্দ লিখি,
তখন তাঁরা দুজনেই আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন।
একজন কবির ভঙ্গিতে,
আরেকজন প্রেয়সীর চোখে।
আজ আমার নিজের জীবনেও প্রেম এসেছে।
তবে সে প্রেম আর তমালের বা নীলার মতো নয়।
সে প্রেম একটু সহজ, একটু ক্লান্ত, একটু সাহসী।
সে অবিশ্বাস্য প্রেম—মেঘেদের মতো ঢুকে পড়েছে আমার জীবনে, প্রতিটি ক্ষণে,
সে তমালের অসমাপ্ত কবিতা- কিন্তু আমার মতো করে,
সে আমাকে জানান দেয় তমাল কে ছিলেন।
সে জানায়, আমার মা কে ছিলেন, কি আমার পরিচয়!
তবু সে আমাকে দেখে না কারও ছায়া হিসেবে।
সে দেখে আলোকে—গহীন অরণ্যে,
আলোর নিজস্ব দীপ্তিকে।
আমি আজও মাঝে মাঝে ভাবি—
তমাল আর নীলা কি আমাকে তাদের শেষ কবিতা হিসেবে গড়েছিলেন?
একটি আলোর অপেক্ষায় তারা জীবনের এতো বাঁক পেরিয়েছেন?
আমি কি তাদের স্বর্গীয় উত্তরাধিকার—
যা কেবল রক্তে নয়, শব্দে, ব্যথায়, কবিতায় প্রবাহিত হয়?
আমি জানি—
প্রথম প্রেম কখনো মরে না।
সে শুধু পরিণতির পথে নতুন আলো জ্বালে।
(চলবে)

মন্তব্য করুন