উপন্যাস
প্রথম প্রেমের স্পর্শ: পর্ব ১১- তমাল - নীলা সম্পর্কের অজানা অধ্যায়

অফিসের প্রয়োজনে মাঝেমধ্যেই লন্ডনে আসতে হয়।
এবারের আসাটা কোনো সফর নয়। আমাকে লন্ডন অফিসে ডেপুটি চিফ হিসেবে বদলি করে পাঠানো হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিতে বড় পদে কাজ করলে বিদেশ ঘোরার একটা বড় সুযোগ থাকে।
বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করা যেন এক নিরব যুদ্ধ—যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে লড়াই চলছে, অথচ বাইরে থেকে সে ক্লান্তির ছায়াও পড়ে না।
সবকিছু এতটাই সুচারুভাবে সাজানো, যেন জীবন এক মসৃণ প্রেজেন্টেশনের স্লাইড।
আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নেই।
সকাল শুরু হয় কাগজপত্রে ডুবে গিয়ে—চুক্তিপত্র, অনুমোদনের অপেক্ষা, সিদ্ধান্তহীন কোনো বোর্ড মিটিং।
এরপর আসে সভা, সেমিনার—যেখানে সবাই মুখে হাসি, মনে মনে হিসেব কষে।
ক্লায়েন্ট বিশ্লেষণের টেবিলে আমি কেবল একজন নামহীন বিশ্লেষক, যার অনুভূতির কোনো দাম নেই, শুধু সংখ্যার গুরুত্ব।
দিনের পর দিন এভাবেই চলে—একই নিয়মে বাঁধা, নিরুত্তাপ চক্রে ঘুরতে থাকা ঘড়ির কাঁটার মতো।
আর এই চক্রের মাঝে আমি যেন নিজের অস্তিত্বকে প্রতিদিন একটু একটু করে ভুলে যাচ্ছি।
বাহির থেকে সবাই ভাবে, কী চমৎকার চাকরি, কী সুন্দর জীবন!
আর ভেতরে?
ভেতরে আমি কেবল একজন রোবট, কর্পোরেট মুখোশের আড়ালে এক ক্লান্ত মানুষ।
কিন্তু আমি?
আমি যেন সময়ের ভেতর থেকেও সময়ের বাইরে।
মাথার ওপর উড়তে থাকা বিমানের মতো আমার হৃদয় উড়ছে এক অজানা গন্তব্যে—যার নাম নীলা।
লন্ডনে, টেমস নদীর কাছে আমার থাকার জায়গাটা শহরের কোলাহলের মাঝখানে যেন এক চিমটে নীরবতা।
ছিমছাম অ্যাপার্টমেন্ট, কাচঘেরা জানালা দিয়ে দেখা যায় দূরের লন্ডন আই-এর ঝিকিমিকি আলো।
রাতের শহরটা তখন মনে হয় এক নিরুত্তর প্রেমিকা—চুপচাপ পাশে বসে আছে, কিছু বলে না।
কাচের দেয়ালের ওপারে ঝিরঝির বৃষ্টি আর ট্রাফিক সিগনালের রঙিন আলো—আমার একাকিত্ব যেন আরও তীব্র করে তোলে।
বিছানার পাশে রাখা বইয়ের তাকটিতে রবীন্দ্রনাথ আর কাহলিল জিবরানের অনেক বই।
মাঝেমধ্যে প্রিয় লেখক কাহলিল জিবরানের দ্য প্রোফেট-এর আশাবাদী চরিত্র ‘আল মুস্তফা’-কে মনে করে কিছুটা শান্তি পাই।
ইচ্ছা হয়, যদি লেখক কাহলিল জিবরানের মতে চিত্রকর হতে পারতাম, তবে নিজের জীবনের গল্প রঙে আঁকতে পারতাম।
প্রতিদিন শেষরাতে এলোমেলো শব্দেরা আমাকে নিয়ে যায় এক ভিন্ন জগতে—যেখানে সময় থেমে থাকে, হৃদয়ের শব্দ বাজে গভীর তালে। এই একটি জগতের মধ্যে প্রতিটি মানুষের রয়েছে ভিন্ন জগৎ। আমার জগতটাএকটু বেশিই ভিন্ন। সব থেকেও কিছু না থাকার কষ্টটা যে কত অসহনীয় তা কে বুঝবে!
ছুটির দিনে হাঁটতে যাই টেমসের পাড়ে।
হাতে ধোঁয়াভরা কফির কাপ, মাথার ওপর পাখির ঝাঁক, চারদিকে ভেজা বাতাস—সবকিছু যেন আমার নিঃসঙ্গতাকে আরও ভারী করে তোলে।
আমি হেঁটে যাই, চুপচাপ—একটি মুখের খোঁজে, যে মুখ হাজার মাইল দূরের এক দেশে।
আসলে লন্ডন—এমনই এক শহর, যেখানে সব কিছু আছে, অথচ কিছু যেন নেই।
এই শহর আমাকে আপন করেছে, কারণ এখানে কেউ কিছু জানতে চায় না, কিছু বলতেও চায় না।
কেউ জানে না আমি কে, কোথা থেকে এসেছি, কী হারিয়ে ফেলেছি, কী খুঁজে ফিরি।
এখানে থাকা মানে প্রতিদিন স্মৃতি আর বাস্তবতার মাঝখানে এক সূক্ষ্ম সেতু তৈরি করা—
যেখানে আমি শুধু একজন কর্পোরেট পেশাজীবী নই, আমি এক স্বপ্ন-হরণকারী, হৃদয়খাঁচায় বন্দি এক নিঃস্ব প্রেমিক।
এইসব উদ্ভট ভাবনার ভেতর মাঝেমধ্যে একটু স্বস্তি পাই—
মায়ের শরীর আগের চেয়ে কিছুটা ভালো যাচ্ছে।
লোকমান চৌধুরীর চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট, তার উপস্থিতি কখনও কখনও বিরক্তিকর মনে হলেও মায়ের প্রতি তাঁর আন্তরিকতায় ঘাটতি নেই।
তাঁর নীরব দায়িত্ববোধ, মায়ের প্রতি তাঁর যত্নশীলতা মাঝে মাঝে আমার নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনে।
আর নীলা?
সে আজও নিজের মতো করেই আছে।
আমাদের যোগাযোগ কেবল তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে
হঠাৎ একটি মেসেজ, কখনও দীর্ঘ নিঃশব্দতা।
আমাদের সম্পর্কের জটিলতা আজও কাউকে বলা হয়নি, বলা যায়ও না। বেশ কিছুদিন হলো সেই যৎসামান্য যোগাযোগও বন্ধ।
সমাজ ও পরিবার এখনও অনেক কিছু মানতে প্রস্তুত নয়।
তারা মুখে মানবতার বুলি আওড়ায়, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে রাখে শত সংকীর্ণতা।
তবুও নীলার মতো একটি মেয়েকে ভালোবাসতে পারা আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন।
এই ভালোবাসার মূল্য বোঝে খুব কম মানুষ। পৃথিবীর মানুষ ভালোবাসা চায়, কিল্তু তারা ভালোবাসার মানে জানে না।
তারা শুধু দেখে নাম, ধর্ম—তাদের চোখে হৃদয়ের ভাষা নেই।
আমার মা জানতেন আমি একটি হিন্দু মেয়েকে ভালোবাসি।
তবে নীলাই যে সেই মেয়ে—তা পরে বুঝেছিলেন।
মা হয়তো মেনে নিয়েছিলেন আমাদের সম্পর্ক, কারণ মা নিজেও একটা অসামঞ্জস্য সম্পর্কে জড়িয়ে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছেন। যদিও সেটা ছিল পুরোপুরি শারীরিক সম্পর্ক, আর আমার ছিল হৃদয়ের।
তবুও তিনি জানতেন, এই সম্পর্ক চৌধুরী পরিবার মেনে নেবে না।
আমার নানাবাড়ি, যারা ধর্মকে মুখস্ত বইয়ের মতো দেখতেন, তারাও বলতেন—
“তুই কি হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করবি? বংশে কলঙ্ক আনবি?”
অন্যদিকে, নীলার পরিবার ছিল আরও ভয়ঙ্কর।
তাদের কাছে মুসলমান মানেই দূরবর্তী, নিষিদ্ধ এক সত্তা।
তারা কট্টর সাম্প্রদায়িক মানসিকতায় বিশ্বাসী।
নীলার মা যখন জানতে পারেন যে তার মেয়ে একটি মুসলিম ছেলের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়েছে, তখনই শুরু হয় এক নিষ্ঠুর নাটক।
নীলাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়।
ফোন কেড়ে নেওয়া হয়।
তার সামনে ধর্মীয় বই, পুরোহিতের বাণী, ভয়ভীতি—সব হাজির করা হয়।
সে কাঁদে, বোঝাতে চায়—কিন্তু কেউ শোনে না। পুরো পৃথিবী নীলার বিপরীত দাঁড়িয়ে যায়।
পরিবার তখন জোর করে তার বিয়ে ঠিক করে ফেলে।
এক প্রতিষ্ঠিত হিন্দু পাত্র, যিনি একটি বিদেশী সংস্থায় কাজ করেন, মালয়েশিয়ায় পোস্টিং।
নীলা প্রতিবাদ করেছিল, কেঁদে বলেছিল—
“আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। আমাকে সময় দিন।”
কিন্তু তারা বলেছিল—
“যার সঙ্গে তুই প্রেম করেছিস, সে তো মুসলমান!
তুই কি মরার পর কাফনের কাপড়ও ওর নামের চাদরে জড়াবি?”
এতো ঘৃণা, এতো সংকীর্ণতা দেখে নীলার ভেতরের মনুষ্যত্ব হয়তো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
আর আমাকে খবর দেওয়ারও সুযোগ পায়নি সে।
আমি তখন নিজেও একটা ভয়ের বৃত্তে বন্দী হয়ে পড়েছিলাম।
বহু কষ্টে মুক্তি পেয়ে, নিজেকে সামলে নিয়ে, এক ধরনের কৃত্রিম ফুরফুরে মেজাজে সেদিন নীলা আমাকে তার ফ্ল্যাটে ডেকেছিল—কিন্তু সেই ডাকে যে শুধু ভালোবাসার আহ্বান ছিল, তা নয়।
তার চোখে ছিল এক গভীর নিরুদ্বেগ দৃঢ়তা, আর ঠোঁটে এক অস্পষ্ট হাসি—যেন সে নিজেই জানে, এই রাতই হতে চলেছে কোনো এক প্রেমের চিরস্থায়ী স্মারক।
সে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল তার নিভৃত নিরালায়, একান্তে, উদ্দেশ্য ছিল একটাই—আমাদের ভালোবাসাকে শরীরের উষ্ণতায় নয়, স্মৃতির গর্ভে অমর করে রাখা।
সে রাতটা শুধু মিলনের ছিল না, ছিল এক বিসর্জনের; যেন নিজের সমস্তটুকু উজাড় করে দিয়ে আমাকে সে রেখে যেতে চেয়েছিল নিজের হৃদয়ের অনন্ত চিহ্ন।
আমি জানি, সেদিন নীলা কাঁদেনি।
কিন্তু তার নিঃশব্দতা, তার অনভিপ্রেত কোমলতা, তার আলতো স্পর্শ—সবই যেন বলছিল, “এই যা দিচ্ছি, তা আর কখনও পাবে না, কিন্তু ভুলতেও পারবে না।”
সে রাতের পরে, সময় থেমে যায়নি।
জীবন চলেছে, অফিস, লন্ডন, ক্লান্তি, দৌড়ঝাঁপ—সব।
কিন্তু, আমি যেন আটকে আছি সেই একটি রাতের অলসতায়, উত্তপ্ত সময়ের প্রতিচ্ছবিতে।
আমি শুধু হাতড়ে ফিরি সেই একটিমাত্র রাতের স্মৃতি—যেখানে নীলা শুধু শরীর দিয়ে নয়, আত্মা দিয়ে ছুঁয়ে গিয়েছিল আমাকে।
আর আমি আজও সেই স্পর্শে তীব্রভাবে জেগে থাকা একজন মৃত মানুষ।
এরই মধ্যে নীলার বাবার মৃত্যু নীলাকে আমার থেকে চিরকালের জন্য দূরে ঠেলে দেয়।
তারপর, একদিন শুনি—নীলা অন্তঃসত্ত্বা।
প্রথমে সংবাদটি আমাকে বিচলিত করে।
পরে জানতে পারি নীলা আমার সন্তানই নিজের শরীরে ধারণ করেছে।
সে ভেবেছিল, হয়তো তখন সবাই মেনে নেবে।
কিন্তু না—বরং তখনই শুরু হয় তার জীবনের সবচেয়ে নিষ্ঠুর অধ্যায়।
তার পরিবার তাকে গর্ভপাতের জন্য চাপ দিতে থাকে।
নীলার মা কাঁদতে কাঁদতে বলে—
“তুই যদি এই মুসলমানের সন্তান পেটে রাখিস, তবে তোর মরা মুখ আমি দেখবো না!”
নীলার প্রতি আমার মায়ের দৃষ্টিভঙ্গি—সে এক দুর্বোধ্য ব্যাখ্যার পাণ্ডুলিপি, যার প্রতিটি পাতায় ছড়িয়ে আছে সংশয় আর সমাজভীতি। মা কি সত্যিই কখনও মেনে নিতে পেরেছিলেন নীলাকে? না কি মুখে না বলা এক অদৃশ্য দূরত্ব সবসময়ই টেনে রেখেছিল তাদের মাঝে?
সেদিন, অনেক বছর পর, নীলা যখন ছোট্ট আলোকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ায়, মা যেন আচমকা এক বিস্ময়ের ঝড়ে পাথরের মতো স্থবির হয়ে গিয়েছিলেন। দরজা খুলেই থেমে গিয়েছিলেন, তারপর চোখ মেলে তাকিয়ে বলেছিলেন—“তুই?”
শব্দটা যেন অভিমান নয়, আশ্চর্যও নয়, বরং ভয়ের ধ্বনি। যেন অচেনা কোনো ছায়া হঠাৎ অতীতের বুকে হানা দিয়েছে। মা সেদিন যেন কাউকে নয়, নিজের বিশ্বাসকে দেখে আতঙ্কিত হয়েছিলেন।
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আশ্চর্য পরিবর্তন। সেই একই মানুষ, যিনি নীলাকে দেখে থমকে গিয়েছিলেন, তিনিই আবার আলোকে নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে খিচুড়ি খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নীলার মুখের দিকে না তাকিয়ে, শুধুমাত্র তার সন্তানকে আঁকড়ে ধরলেন তিনি। সেই আংশিক মাতৃত্ব যেন সমাজের সব প্রশ্নের উত্তর হয়ে আছড়ে পড়লো।
নীলা কখনওই আমাদের জীবনে বোঝা হতে চায়নি। সমাজের চোখরাঙানি বা পারিবারিক বিরুদ্ধতার বোঝা সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। এমনকি আমাকেও কষ্ট দিতে চায়নি সে। তাই হয়তো খুব ভোরে, পাখির ডানায় চড়ে, না বলা অনেক কথাকে বুকের ভেতর চেপে রেখে, নীলা আবার ফিরে গিয়েছিল নিজের অচেনা গন্তব্যে।
আর মা?
তিনি একবারও বলেননি, “থাকো।”
একবারও না।
হয়তো কোনো অদৃশ্য প্রাচীর তাকে আটকে রেখেছিল, কিংবা কোনো অব্যক্ত অভিমান, যা সময়ও ভাঙতে পারেনি। অথবা, মা হয়তো নীলাকে মেনে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সমাজের চোখে নিজের পরিচয়কেই রক্ষা করতে গিয়ে সেই ইচ্ছেটাকেই গোপনে কবর দিয়েছিলেন।
কিন্তু নীলা সমাজের এসব লুকোচুরি খেলা, সমাজের চোখ রাঙানো কাউকে পাত্তা দেয়নি।
সে আমাকে ভালোবাসত—আর সেই ভালোবাসার প্রতীক সে নিজেই হতে চেয়েছিল।
সে সন্তান জন্ম দেয়, সমাজের চোখে অবৈধ হলেও নিজের চোখে এক পবিত্র সৃষ্টিকে।
আমাদের সম্পর্ককে যারা বাইরের চোখে দেখে, তারা এই বিস্ময় বুঝবে না।
তারা জানে না, একজন নারী কতটা সাহসী হলে এমনটা করতে পারে।
তাই এক অনন্ত প্রতীক্ষার কাকের মতো আমি আজও অপেক্ষা করি—নীলার জন্য।
(চলবে)

মন্তব্য করুন