প্রথম প্রেমের স্পর্শ: পর্ব ১৪- ভালোবাসা যেখানে থেমে থাকে না

এম এম মাহবুব হাসান
  প্রকাশিত : ১২ জুলাই ২০২৫, ০৮:৩৭
অ- অ+

ঢাকার এক হিমশীতল ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যা।

আকাশে চাঁদ নেই, তবুও বাতাসে মিশে আছে এক অপূর্ব মাদকতা।

ডিসেম্বরের কুয়াশার মতো শহরের গায়ে জড়িয়ে রয়েছে এক নীরব স্তব্ধতা।

কেউ যেন দম আটকে অপেক্ষা করে আছে—

একটি কবিতার পুনর্জন্মে, একটি অসমাপ্ত প্রেমের প্রত্যাবর্তনে।

একুশের বইমেলা।

প্রকাশনার ঝলমলে আলো, ক্যামেরার ঝাঁকুনি, দর্শকের কোলাহল—

তবুও যেন কিছু একটা অনুপস্থিত।

বাতাসে ভেসে আসছে কদমফুলের অদৃশ্য ঘ্রাণ,

যা হয়তো কোনো কবির মন থেকে উঠে এসে ঢুকে গেছে কারো হৃৎপিণ্ডে।

মঞ্চে উঠছেন এক নারী।

চোখে রিমলেস চশমা, গায়ে নীল মসলিন শাড়ি, মুখে হালকা কুয়াশা-মাখা হাসি।

তার হাতে ধরা একটি বই—

“নীলার চোখে তমাল”

যার উপশিরোনাম - ‘এক অসমাপ্ত প্রেমের উত্তরাধিকার’

উপস্থাপক বলছেন—

“এই বইটি শুধু একটি প্রেম কাহিনি নয়—

এটি একটি আত্মার আলেখ্য,

এক অপূর্ণ সম্পর্কের গায়ে জমে থাকা কবিতার শরীর।

এটি উৎসর্গ করা হয়েছে সেই মানুষটিকে—

যিনি সমাজস্বীকৃত বাবা নন, তবু এক সন্তানকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন,

এবং সেই নারীকেও,

যিনি নিঃশব্দে ভালোবাসার জন্য বিসর্জন দিয়েছেন গোটা জীবন।”

মঞ্চের ঝলমলে আলো ম্লান হয়ে আসে হঠাৎ।

আর সেই আলোর ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষের চোখে জমে ওঠে পুরনো জলছবি।

চোখে পুরু চশমা, হাতে একটি পুরোনো খাম আর এক টুকরো শুকনো কদমফুল।

তার নাম মাহিব—তমালের প্রাক্তন শিষ্য, শ্রোতা এবং জুনিয়র বন্ধু।

মঞ্চের কাছ থেকে সরে গিয়ে সে সোজা হাঁটা শুরু করে ধানমণ্ডির সেই পুরনো ঠিকানার দিকে—

যেখানে একদিন তমাল বলেছিলেন,

“আমি এখানেই থাকব, যদি তুমি ফিরতে চাও।”

আজ কেউ আর সেখানে ফেরে না।

শুধু সেই কদম গাছটি দাঁড়িয়ে থাকে একা—

একজন প্রেমিকের একাকী সাক্ষী হয়ে।

পরদিন সন্ধ্যা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে আলো দাঁড়িয়ে আছে—

চুপচাপ, নির্ভার, তবুও তার চোখের গভীরে এক অদ্ভুত অস্থিরতা।

মাহিব এসে পাশে দাঁড়ায়, চোখে তার স্থির প্রশান্তি।

বলল—

“তোমার মা শেষ জীবনে আমাকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন।

বলে গিয়েছিলেন, একদিন যদি তার মেয়ে নিজের হৃদয়ের গল্প বলে, তখন যেন এই চিঠিটা তার হাতে দিই।”

আলো চমকে তাকায়।

চিঠির খাম পুরোনো, হলুদ হয়ে যাওয়া।

তবু লেখা স্পষ্ট—“আলোর জন্য, যদি সে একদিন প্রেম বোঝে।”

তার কাঁপা হাতে চিঠি খুলে পড়ে—

“আলো,

যদি তুমি কখনও নিজের ভালোবাসার গল্প লেখো,

বুঝবে—আমার আর তমালের প্রেম কখনও পুরনো হয়নি।

সত্যিকারের প্রেমের মৃত্যু নেই—

সে শুধু রূপ পাল্টায়।

কখনও থাকে কবিতার ছায়ায়,

কখনও সন্তানের চোখে,

কখনও স্মৃতির আর্দ্র বাতাসে।

আমি জানি, তুমি একদিন প্রেমে পড়বে।

হয়তো সেই প্রেমও হবে অসমাপ্ত,

হয়তো তুমি পাবে না তার পূর্ণতা,

তবুও ভালোবাসবে—আমার মতো করেই।

নিঃশব্দে, নিঃস্বার্থভাবে।

ভালোবাসা মানেই প্রাপ্তি নয়।

ভালোবাসা মানে স্মৃতি হয়ে টিকে থাকা—

এক নিঃসঙ্গ পাঠকের বুকের গভীরে,

এক শিশুর প্রথম চিঠিতে,

এক কদম ফুলের ঘ্রাণে।

যদি তা সত্য হয়,

তবে সেই প্রেম থেমে যাবে না।

সে চলবে—তোমার মধ্য দিয়েই।

পরম ভালোবাসায়,

তোমার মা

নীলা”

চিঠির শেষ লাইনে এসে আলো থেমে যায়।

তার চোখে জল নেই,

কিন্তু বুকের গভীরে যেন একজোড়া ছিন্ন পাখির ডানা কাঁপছে।

সে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।

বাইরে হালকা বৃষ্টি,

পাতার ওপর জল ঝরে পড়ছে।

মাহিব এসে বলে—

— “চিঠিতে কী ছিল?”

আলো মৃদু হেসে বলে—

— “ভালোবাসা।

যেটা থেমে যায়নি।

যেটা আমার মধ্যেও জন্ম নিয়েছে।”

সময় চলে যায়।

আলো হয়ে ওঠে একজন কবি, শিক্ষক, গবেষক—

যার লেখায় পাঠক খুঁজে পায় এক অপূর্ণ প্রেমের গন্ধ,

এক সাহসী না-পাওয়ার স্বীকৃতি।

তার দ্বিতীয় বইয়ের নাম—

“তমালের কাছে লেখা অসমাপ্ত চিঠিগুলো”

প্রথম পাতায় লেখা:

“মা, আমি এখন জানি কেন তুমি তাকে ভালোবেসেছিলে।

তমাল, আমি এখন জানি কেন তুমি ফিরে আসোনি—

তুমি কখনো হারাওনি।”

আলো মাঝে মাঝে মিরপুরের কবরস্থানে যায়।

এক পাশে মা, অন্য পাশে তমাল।

দুই কবরের মাঝখানে রাখে—একটি কদম ফুল, একটি কবিতা, একটি নির্জনতা।

অবচেতন মনে আলো যেন বলে ওঠে—

“তোমাদের প্রেম শেষ হয়নি।

তোমরা না পেয়েও একে অপরের হৃদয়ে চিরকাল পূর্ণ হয়ে আছো।

আমি জানি, আমি তোমাদের ভালোবাসার উত্তরাধিকার।”

বইমেলার শেষ দিন।

আলো এক কোণায় দাঁড়িয়ে, হাতে নিজের বই।

কভারে তার ছবি—

তবে প্রতিটি পৃষ্ঠায় লেখা আছে নীলা-তমালের নিঃশব্দতা।

ঠিক তখনই আসে একটি শিশু।

হাতে কদম ফুল।

সে মায়ের হাত ধরে বলে—

“মা, এই ফুলটা খুব ভালোবাসি!”

আলো হেসে ওঠে।

এক নতুন আশ্বাস জন্ম নেয় বুকের ভেতরে।

ভালোবাসা আবার জন্ম নিচ্ছে—

এবার আর তমাল-নীলার নয়,

আলো-অজানা কারো।

রাতের আকাশে চাঁদ নেই।

তবু আলো জানে—তমাল ও নীলা এখনও একে অপরের পাশে শুয়ে আছেন—

একটি কবিতার দেহে, একটি চিঠির স্তব্ধতায়।

মাহিব পাশে এসে দাঁড়ায়।

তার চোখে কোনো দাবি নেই,

শুধু গভীর সম্মতি।

— “তোমার গল্প শেষ নয়, আলো।

তুমি এখন নিজের গল্প লেখো।

এবার তুমি প্রেম করো—পূর্ণভাবে।”

আলো তাকায় তার দিকে—

এক দীর্ঘ চোখে, যেখানে অনিশ্চয়তা নেই,

শুধু সম্ভাবনা।

কবিতা:

“যেদিন তুমি হারালে—

নীরব দুপুরে হাঁসের পালকের মতো হাওয়ায় উড়ে গেলে,

আমি শুধু খুঁজি তোমায়—

কোনো এক মৃত কবিতার পাতায়,

শিশুর চোখের অপলক বিস্ময়ে,

আর বর্ষার কদমের গন্ধে।

যেদিন তুমি মরলে,

সেদিনই জেনেছিলাম—

প্রেম মরে না,

সে শুধু আর চিঠি লেখে না।”

একটু বিরত নিয়ে আলো আবার পড়ে—

“ভালোবাসা যেখানে সত্য হয়—

সেখানে সে থেমে থাকে না কোনো বিকেলের ছায়ায়,

সে হয় উত্তরাধিকার—

অন্ধকার ভেদ করা এক আলো হয়ে,

নির্বাক শিশুর চোখের তারায়,

কখনওবা কুয়াশাভেজা সকালে—

বুকের গোপন গহীণে

নির্জন পাঠকের হৃদয়ের কোণে

সে জেগে থাকে অনন্তকাল।”

আলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

মাহিব তার পাশে—

আলোর ডান কাঁধে আলতো করে হাত রাখে।

আলো স্থির থাকে।

দুজনেই জানে—

প্রেম শেষ হয় না।

প্রেম থেমে থাকে না।

সে শুধু রূপান্তরিত হয়—

উত্তরাধিকারে।

(আপনি যদি এখনও কদম ফুলের ঘ্রাণ পান,

জেনে নিন—তমাল এখনও ভালোবাসেন।

নীলা এখনও অপেক্ষা করেন।

আর আলো এখনও হাঁটছেন সেই পথে—

যেখানে ভালোবাসা থেমে থাকে না।)

সমাপ্ত

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
ইতিহাসে প্রথমবার ক্রিকেট বিশ্বকাপে ইতালি
পরকীয়া প্রেমিকা নিয়ে কাঠমান্ডু যাচ্ছিলেন ইমন, ঠেকাতে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলকে ফেক কল দেন মা: র‍্যাব ডিজি
ফেনীতে রান্নাঘরে সাপের কামড়ে গৃহবধূর মৃত্যু
সুনামগঞ্জ সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নিহত
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা