উপন্যাস
প্রথম প্রেমের স্পর্শ: পর্ব ১২- স্মৃতির দংশনে হঠাৎ ঢাকায় ফেরা

লন্ডনের এক বিকেল।
সূর্য ধীরে ধীরে গড়িয়ে যাচ্ছে পশ্চিম দিগন্তে।
আকাশে তখন যেন সোনালি-কমলা আঁচড়ের এক ক্যানভাস।
টেমস নদীর জল কাঁপছে রোদ্দুরের ভাঙা প্রতিচ্ছবিতে।
আমি বসে ছিলাম দক্ষিণ তীরে, ওয়াটারলু ব্রিজের পাশের কাঠের বেঞ্চটায়।
হাতে কাগজের কাপ—প্রতিদিনের মতো ব্ল্যাক কফির ধোঁয়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে ঠান্ডা হাওয়ায়।
পায়ের কাছে নিঃশব্দে পড়ে আছে অফিসের কাজে ব্যবহৃত পুরনো ব্রিফকেসটা—এটি কালের স্বাক্ষী। তার ভেতর লুকিয়ে আছে আমার একান্ত কিছু স্মৃতি, একান্ত অতীত। অফিস ফাইলের নিচে গোপনে সযত্নে রাখা কয়েকটা কবিতার খাতা—তাতে জড়ানো নীলার হাতের লেখার ঘ্রাণ। তার পাঠানো কিছু চিঠি, হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজে আজও টিকে আছে আবেগের ছাপ, শব্দে শব্দে এক প্রেমের অনুপম দীর্ঘশ্বাস।
সযত্নে রাখা দুটি ছবির একটা ছবিতে আমরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে—২০০১ সালের বইমেলায়। আমার চোখে তখন সদা ভয় সদা লাজ, নীলার মুখে শান্ত হাসি। আরেকটা ছবিতে শুধু একটি কদম ফুল—সেই সন্ধ্যায় তার চুলে গুঁজে দিয়েছিলাম। কে জানতো, এত বছর পর সেই শুকনো কদম এতটা জীবন্ত হয়ে ফিরে আসবে হৃদয়ের অন্ধকার অলিন্দে!
এরই মধ্যে একটি খুদে বার্তা এলো।
এরপর থেকে কেন যেন বুকের মধ্যে হঠাৎ হু হু করে একরাশ শূন্যতা ভর করে উঠল।
এমন অনুভব আমি বহুদিন পাইনি।
শেষবার এমন কাঁপুনি এসেছিল যেদিন নীলা আমার কবিতার বই হাতে চলে গিয়েছিল—ধর্ম আর সমাজের ভয় পেয়ে। আর আমি তা চেয়ে চেয়ে দেখেছি নিরবে নিভৃতে!
সেদিন আমি ভেবেছিলাম—ভালোবাসা কেবল সাহসের আরেক নাম।
আর সেই সাহসই যার ছিল না, সে কি করে ভালোবাসে?
কিন্তু আজ, এতদিন পর, আমি বুঝতে শিখেছি—ভালোবাসা মানে শুধু জিতে যাওয়ার গল্প নয়, কখনও কখনও হেরে গিয়েও ভালোবেসে যাওয়াটা জীবনে পূর্ণতা আনে। কিন্তু সেই পূর্ণতা কার জীবনে আসবে - আমার না নীলার?
ধীরে ধীরে দম বন্ধ হয়ে আসছিল।
আমি আর দেরি করলাম না।
একটি ওয়ানওয়ে টিকিট বুক করলাম—গন্তব্যে ঢাকা।
কাউকে কিছু জানালাম না—না অফিসে, না বন্ধুকে, না মাকে।
এ ফেরা কোনো অফিসিয়াল সফর নয়, এ এক স্মৃতির টানে ভেসে যাওয়া।
এটা ফেরা নয়, ফিরে আসা—নিজেরই কোনো এক অসমাপ্ত অধ্যায়ে।
ঢাকার আকাশে নামার মুহূর্তেই যেন বুকের গভীরে কেঁপে উঠল এক পুরোনো চেনা সুর।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে হাঁটা শুরু করতেই নাকে এলো সেই চিরচেনা গন্ধ—ধুলোর, ঘামের, বাসি ফুলের, আর অচেনা ব্যস্ততায় অভ্যস্ত এক আত্মীয়সুলভ গন্ধ। প্রাণভরে সেই গন্ধসুধা গ্রহণ করে স্বস্তির ঢেকুর গিললাম।
ঢাকা শহরটা যেমন ছিল, তেমনই আছে—হয়তো আরও কিছুটা ক্লান্ত, কিছুটা চওড়া, কিছুটা গুমোট ভাব। রাস্তাগুলোতে এখন বেশি গাড়ি, বেশি মানুষ, তবে সব কিছুই চেনা!
কিন্তু আমি আর আগের তমাল নই।
চুল সাদা, মুখে দাগ, চোখে গাঢ় চশমা, আর হৃদয়ে এক দীর্ঘ শোকের আগুন, যা কাউকে বলা হয়নি।
সেই আগুন এখন ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে ছাই হয়ে উঠলেও, তার উত্তাপ আজও টের পাওয়া যায়।
আমি সোজা গেলাম স্মৃতি বিজড়িত সেই পুরোনো ঠিকানায়—নীলার বাসা!
দেওয়াল জীর্ণ, কার্নিশে জং, গেটে মরিচার দাগ।
তবু জানালা দিয়ে যেন ভেসে আসে কোনো এক শীতের দুপুরে নীলার গান গাওয়ার মৃদু ধ্বনি, মিষ্টি কন্ঠে তমাল নাম ধরে ডাকার আহ্বান।
গেটের পাশে এক বৃদ্ধা বসে ছিলেন।
চোখে মেঘলা চশমা, হাতে উলের চাদর।
আমাকে দেখে বললেন, “আপনি আগেও তো এসেছিলেন! আপনার নাম কি তমাল? নীলা তো অনেক আগেই চলে গেছে মালয়েশিয়ায়। ওর স্বামী ওখানেই চাকরি করে। তবে মাসে একবার তার মেয়ে আসে দাদির কাছে—তার নাম আলো। সে খুব শান্ত মেয়ে। কি সব বইটই নিয়ে ব্যস্ত থাকে”
আলো!
নামটা শুনে বুকের ভিতর কী এক অজানা কাঁপন শুরু হলো।
সেই নাম—আলো, যাকে আমি ছোট্ট দেখে গিয়েছিলাম, যাকে ফিরে পাওয়ার পরেও আমি ধরে রাখতে পারিনি!
অথচ যাকে নিয়ে আমি একদিন কবিতার শেষ লাইনে লিখেছিলাম—
“যদি মেয়ে হতো একদিন
তোমার সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখতাম আলো-
নীল জোনাকি নীলার আলো।”
আমি হাঁপাতে হাঁপাতে হাঁটতে থাকি বইমেলার দিকটায়।
শাহবাগে সন্ধ্যার আলো ছায়ার মতো খেলছে চৌরাস্তার মোড়ে। টিএসসিতে সেই চিরচেনা ভীড়ে নানান ভাজাপোড়া আর মরিচ চা খেয়ে অনেকে সিগারেট ফুকছে অবলীলায়।
ঘটা করে আয়োজিত একুশের বই মেলায় সেই পুরোনো ব্যানার, পরিচিত মুখ, ভ্যাপসা গরমে লেগে থাকা ভীড়—সবকিছুর মাঝেও আজ যেন কিছু খুঁজে ফিরছি।
আর হঠাৎই, চোখে পড়ে—এক কিশোরী, যার চোখে যেন মায়াবী চাহনি, সেই পুরোনো ছায়া।
এক সময় যে ছায়া আমার হৃদয়ে জমে ছিল নীলার নামে।
আমি ধীরে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম—
“তোমার নাম কি আলো?”
সে চমকে তাকায়।
তার চোখে যেন নদীর মতো গভীরতা, আবার জলের মতো স্বচ্ছতা।
সেও ধীরে বলল, “আপনি কি তমাল কবি?”
আমি মাথা নিচু করে বললাম, “তোমার মা কি নীলা?”
তার চোখ জলে ভরে ওঠে, কন্ঠ জড়িয়ে যায়। কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
সে আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“তুমি সেই তমাল?
যার কবিতা মা বালিশের নিচে রেখে ঘুমাতেন? যার টানে মা সর্বস্ব ছেড়ে মানবেতর জীবন কাটিয়েছেন শেষ দিকে?
যার নাম উচ্চারণ করে মা ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, যেন কেউ একদিন তারজন্য উপর থেকে নেমে আসবেন”
এরপরই তার ব্যাগ থেকে বের হয় একটি খাম।
সে খামটি বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে।
“মা বলে গিয়েছিলেন, আপনি একদিন আসবেন। এই চিঠিটা রেখে গেছেন শুধু আপনার জন্য।”
আমি আশেপাশে তাকালাম—কোলাহলমুখর বাংলা একাডেমী, ব্যস্ত ঢাকা শহর, তবু সেই চিঠির খাম যেন এক মুহূর্তে সব শব্দ নিঃশব্দ করে দিল।
আমি সেখান থেকে বের হয়ে শাহবাগ মোড়ে এসে ফুটপাতের একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম।
চিঠিটা খোলার সময় হাত কাঁপছিল।
চেনা হস্তাক্ষরে লেখা—
তমাল,
আমি জানি, তুমি একদিন ফিরবে।
আমার বুকের ভেতর ভালোবাসার যে দাগ তুমি রেখে গিয়েছিলে, তা আজও শুকায়নি।
আমার ইচ্ছাতেই তুমি আমার সব কিছু নিয়েছিলে—দিয়েছিলে আরো অনেক বেশিকিছু।
আমার মনপ্রাণ সবই তুমি নিয়েছিলে - শুধু শরীরটা রেখে গিয়েছিলে আলোর জন্য।
আমি ভালোবেসেছিলাম তোমাকে - এটা ছিলো এক নারীর সর্বোচ্চ সাহস, বাঁধ ভাঙার উদ্দীপনা।
একজন্য ধর্ম, সমাজ, লোকলজ্জা—সবকিছুকে পিছনে ফেলে আমাকে ‘আলো’র জন্য লড়তে হয়েছে, তোমার ভালোবাসার চিহ্নটুকু বাঁচাতে হয়েছে।
তবু তুমি আসোনি-সাহস করে। কারণ তুমি চেষ্টা করো ব্যর্থ হয়েছো। সেখানে আমি সফল হয়েছি বারবার।
জানো তমাল, আলো কবিতা লেখে। তোমার মতো করেই কবিতার ছন্দে কথা বলে, আবৃত্তি করে।
তোমার মতোই ভাবে, তোমার মতোই চোখে স্বপ্ন আঁকে।
তাকে দেখলে আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, তুমি আবার জন্মেছো—আমার ভেতরেই।
ডাক্তার বলেছে, শরীরে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে।
এখন আমি ক্লান্ত, তবে অনেকটা শান্ত।
আমার শেষ অনুরোধ—তুমি আমার কবরে এসো একদিন, আর পড়ে শোনাও সেই কবিতা—যেটা তুমি কখনও আমাকে পাঠাওনি, তবু হৃদয়ে রেখে দিয়েছো সযত্নে।
তোমার,
নীলা
(পুনশ্চ:)
আমার কবর পাবে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের বাঁশবাগানের পাশে, কদম গাছের নিচে।
তুমি তো জানো—আমি কদম ফুল কত ভালোবাসতাম।
চিঠিটা শেষ হওয়ার আগেই আমার চোখ শুকিয়ে গেল।
কান্না এল না, শুধু বুকের ভেতর এক নিঃশব্দ বিস্ফোরণ।
তিন দিন পর আমি মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে পৌঁছালাম।
বাঁশবাগানের ছায়া এসে পড়েছে এক সাদা মার্বেলের ফলকে— যা দেখে চোখ আটকে যায়!
*নীলা বিশ্বাস*
জন্ম: ১৯৭৪
মৃত্যু: ২০২৪
“অকাল প্রয়াত হওয়া তিনি এক প্রেমিক রেখে গেছেন—
যার নাম আমরা জানি না, যেটা শুধু তাঁর হৃদয় জানে।”
আমি নিস্তব্ধ হয়ে বসে পড়লাম।
ঘর্মাক্ত ডান হাতের কব্জিতে চোখের জল মুছতে মুছতে
হাতের নীল খাতাটা খুললাম।
নীলার জন্য লিখে রাখা সেই শেষ কবিতার ড্রাফ্টটি পড়তে শুরু করলাম-
“তুমি যেদিন চলে গেলে,
আমি হেঁটে চলেছি—
তোমার অনুপস্থিতির শব্দহীন সঙ্গী হয়ে।
দিন শেষে সন্ধ্যার আলোয়
তোমার ছায়াকে ধরে রেখেছি শক্ত হাতের মুঠোয়।
তুমি যেদিন চিরতরে চুপ করে গেলে,
আমি জেনেছি—
প্রিয়জনেরা মরে না কখনও,
তারা শুধু আর কলম ছোঁয় না নিয়মের কাগজে,
অতল ভালোবাসা জমিয়ে রাখে শূন্য চিঠির খামে—
যা আর কখনও খোলা হয় না,
পড়া হয় না অন্তর খুলে,
তবু প্রতিদিন নতুন করে ভেঙে দেয়
হৃদয়ের অন্ধকার সীমানা।”
আমি কবিতার খাতাটি রেখে এলাম নীলার কবরের পাশে।
সঙ্গে একগুচ্ছ কদম ফুল আর একখানা সাদা কাগজ—যেখানে কিছু লেখা নেই, কিন্তু অনুভূতির ভারে ভরা।
পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল আলো—নীলা আর আমার প্রেমের উত্তরাধিকার।
সে চোখ মেলে তাকিয়ে ছিল কবরের দিকে, যেন অদৃশ্য নীলা এখনও আকাশ থেকে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে।
আলো এখন কবিতা লেখে।
আমার মতোই ভাবে, আমার মতোই হেঁটে চলে শূন্যতার ভেতর।
তাকে দেখলে মনে হয়—প্রেম শেষ হয় না।
শুধু রূপ বদলায়।
মা থেকে মেয়ে হয়ে যায়, চিঠি থেকে কবিতা হয়ে যায়, আর কখনও কবরের পাশে ফেলে যাওয়া সাদা খাতার পাতায় রয়ে যায় অব্যক্ত কথামালা।
আজ আমি একান্ন বছরের এক কবি।
তবু এখনও বেঁচে আছি।
তাকে ভালোবেসেছিলাম যেমন করে একজন কবি শব্দকে ভালোবাসে—
নিরলস, অনিবার্য, অপরাধী হয়ে।
প্রথম প্রেম কখনওই শেষ হয় না।
সে জমে থাকে কাদায়, বাতাসে, কিংবা কবিতার খাতায়।
আর একদিন, ঠিকই, কোনো কাফনের গন্ধমাখা বাতাসে বলে ওঠে—
“আমি এখনও ভালোবাসি…”
(চলবে)

মন্তব্য করুন