হাসপাতালের গার্ডকে চড় মেরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হারান মুরাদ হাসান! কোথায় এখন!

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ০৯ জুলাই ২০২৫, ২১:২৯
অ- অ+

২০১৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিমন্ত্রী করা হয় তাকে? পুরো মাথা কামানো। চকচকে মুণ্ডুর এই মানুষটির নাম পরে হয়ে যায় টাকলা মুরাদ। তার পিতৃপ্রদত্ত আসল নাম মুরাদ হাসান। চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশোনা করায় নামের আগে ‘ডা.’ পদবিও বসে।

আসলে তাকে যতটা না চিকিৎসক হিসেবে চেনে মানুষ, তার চেয়ে অনেক বেশি চেনে নারীদের নিয়ে অশালীন-কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের কারণে। এই অভব্যতা ছিল তার নেশা।

আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী হয়ে মুরাদ হাসান এমনই বেপরোয়া ছিলেন যে, শেখ হাসিনাকে খুশি করতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নাতনি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মেয়ে জাইমা রহমানকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য করতে ছাড়েননি। তাতে অবশ্য দেশজুড়ে বিপুলভাবে সমালোচিত ও ঘৃণিত হন তিনি।

‘চোরের ১০ দিন গৃহস্থের এক দিনের’ মতো ডা. মুরাদ হাসানও ধরা খান নায়িকা মাহিয়া মাহিকে ধর্ষণের হুমকি দিয়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে নায়িকাকে পাঁচ তারকা হোটেলে ধরে এনে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া অডিও ফাঁস ও ভাইরাল হলে টনক নড়ে সরকারের।

আওয়ামী লীগ ঘরানার পরিবারে জন্ম নেওয়া মুরাদ হাসান ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জামালপুর-৪ আসন থেকে প্রথমবার সংসদ সদস্য হন তিনি।

২০১৪ সালে আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া হলেও ২০১৮ সালে আবার সংসদ সদস্য হন মুরাদ হাসান। এবার আওয়ামী লীগ সরকার তাকে নতুন মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়। প্রতিমন্ত্রী হয়ে ক্ষমতার দম্ভে বেসামাল হয়ে পড়েন ডা. মুরাদ হাসান।

একবার নিজের এলাকার এক রোগীকে দেখতে রাজধানীর একটি নামকরা হাসপাতালে যান মুণ্ডিত মস্তক প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান। হাসপাতালে মূল গেটে গাড়ি থেকে নেমে তিনি ভেতরে ঢোকার পরও সেখানেই রয়ে যায় গাড়িটি। হাসপাতালের সিকিউরিটি গার্ডরা গেট থেকে গাড়ি সরিয়ে নিতে ড্রাইভারকে অনুরোধ করেন। এতে ক্ষেপে যান মুরাদ হাসানের গাড়ির ড্রাইভার।

প্রতিমন্ত্রীর গাড়ি যেখানে ইচ্ছা সেখানে থাকবে- এমনই বক্তব্য ড্রাইভারের। তবে সিকিউরিটি গার্ডও নাছোড়বান্দা, গাড়ি সরাতেই হবে। এ নিয়ে শুরু হয় তর্কাতর্কি, হট্টগোল।

নিজের ড্রাইভারের উচ্চস্বরে তর্কাতর্কি শুনে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসেন প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান। কারণ জানতে চেয়ে নিজেই আবার সিকিউরিটি গার্ডের সাথে তর্কে জড়িয়ে যান। একপর্যায়ে হাসপাতালের সিকিউরিটি গার্ডকে চড় মারেন তিনি। এ ঘটনায় হতবাক হয়ে যান হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

এই হাসপাতালের মালিক দেশের শীর্ষস্থানীয় এক শিল্পগ্রুপ। স্বাস্থ্যখাতেও রয়েছে তাদের প্রভাব। বিষয়টিকে তারা হালকাভাবে ছেড়ে দেয়নি। প্রতিমন্ত্রীর চড়কাণ্ডের সিসিটিভি ফুটেজ পৌঁছে দেয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে।

ভিডিও দেখে প্রতিমন্ত্রীর ওপর বিরক্ত হন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৯ সালের মে মাসে লঘুশাস্তি হিসাবে মুরাদ হাসানকে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে বদলি করে দেওয়া হয়।

নতুন মন্ত্রণালয়ে গিয়েও সংযত হননি ডা. মুরাদ হাসান। বরং দিন দিন আরো বেসামাল হয়ে ওঠে তার আচরণ। ছাত্রলীগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রলীগ নেত্রীদের নিয়ে অশোভন উক্তি করেন এক অনুষ্ঠানে। এতে তীব্র প্রতিবাদ জানায় ছাত্রলীগ। আওয়ামী লীগের নারী নেত্রীরাও প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প। তাই সিনেমার শুটিং শুরুর আগে মহরত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ডাক পড়ে প্রতিমন্ত্রীর। সেসব অনুষ্ঠানে নায়িকাদের নিয়ে নানা ধরনের স্থুল মন্তব্য করতে থাকেন তিনি।

২০২১ সালে এক টক শোতে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কন্যাকে নিয়ে অশোভন মন্তব্য করেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান। এতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে বিএনপি। বিভিন্ন স্থানে মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে বিএনপির সমর্থকরা মামলা করেন। দেশের নারী নেত্রীরাও মুরাদ হাসানের মন্তব্যের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেন।

এরই মাঝে ফাঁস হয় নায়িকা মাহিয়া মাহিকে নিয়ে প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের ফোনালাপ। সেখানে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় মাহিয়া মাহিকে গালাগালি করেন মুরাদ হাসান। এমনকি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে তাকে ধরে পাঁচ তারকা হোটেলে এনে ধর্ষণেরও হুমকি দেন।

এই ফোনালাপ ফাঁসের পর দেশজুড়ে সমালোচনার মুখে তাকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন ডা. মুরাদ হাসান। এরপর বেশ কদিন নিজেকে আড়াল করে রাখেন তিনি।

এরই মধ্যে বোমা ফাটান মুরাদ হাসানের স্ত্রী ডা. জাহানারা এহসান। ঘরে স্ত্রী-সন্তানকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি আর গায়ে হাত তোলার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ৯৯৯ এ ফোন পেয়ে পুলিশ যায় তার ধানমন্ডির বাসায়। কিন্তু তার আগেই বাসা ছাড়েন মুরাদ হাসান।

নিরাপত্তার স্বার্থে মুরাদের স্ত্রী ও মেয়েকে ধানমন্ডি থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। তাদের দিয়ে করানো হয় জিডি। এরপর বাসা থেকে মুরাদ হাসানের অস্ত্র জমা নেওয়া হয় থানায়।

হঠাৎ একদিন মুরাদ হাসানকে দেখা যায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। মুখে কালো মাস্ক, চোখে চশমা আর ক্যাপ দিয়ে মাথা ঢাকা। পরনে কালো ব্লেজার ও জিন্স প্যান্ট। গোপনে পাড়ি দিচ্ছেন বিদেশে।

কিন্তু এখানেও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি তার। কানাডা যেতে চেয়েছিলেন ডা. মুরাদ হাসান। ওদিকে কানাডায় তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশিদের বিক্ষোভ, তাকে ঢুকতে না দেওয়ার আহ্বান সরকারের প্রতি।

ঢাকা ছাড়তে পারলেও মুরাদ হাসান কানাডায় ঢুকতে পারেননি। কোনো কোনো মাধ্যমে বলা হয়, করোনা টিকার যথাযথ সনদ না থাকায় তাকে ফেরত পাঠায় কানাডা।

কানাডা বর্ডার পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তুলে দেয় আবুধাবীর একটি বিমানে। সেখানকার বিমানবন্দরে তাকে দেখা যায় হুডিতে মাথা ঢাকা। ফ্লোরে মাথার পাশে স্যুটকেস রেখে শুয়ে আছেন ক্লান্ত মুরাদ হাসান। কিন্তু আবুধাবিতেও ঠাঁই হয়নি তার। সেখান থেকে পরে ঢাকায় ফিরে বিমানবন্দর থেকে উধাও হন তিনি।

এরপর দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলেন এই সাবেক প্রতিমন্ত্রী। নিজ জেলা জামালপুরেও যাননি তিনি। দুই বছর পর ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে তাকে দেখা যায় জামালপুরের এক জানাজায়। নির্বাচনে দলের মনোনয়নের উদ্দেশে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার এই চেষ্টা সফল হয়নি তার। দল তাকে নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়নি আর।

আওয়ামী লীগের টানা তৃতীয় দফা ক্ষমতাকালে একটু একটু করে স্বরূপে ফেরার চেষ্টা দেখা গেছে বিতর্কিত মুরাদের। মন্ত্রিত্ব হারিয়ে দেশ ছাড়তে না পারলেও ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন। সুযোগ বুঝে দলের অন্য অনেক নেতার মতো তিনিও দেশ ছাড়েন গোপনে।

(ঢাকাটাইমস/৮জুলাই/মোআ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
গোপালগঞ্জে সমাবেশ শেষে এনসিপির পদযাত্রায় হামলা, পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয় নিলেন নেতারা
বাংলামোটরে এনসিপি কার্যালয়ের সামনে ককটেল নিক্ষেপ
গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশস্থলে ছাত্রলীগের হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ
মিটফোর্ডে সোহাগ হত্যা: মামলার এজাহার থেকে পাঁচজনের নাম বাদ দেয় কে? জানালেন ডিএমপি কমিশনার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা