খাগড়াছড়ি তামাক চাষে সয়লাব
পার্বত্য খাগড়াছড়িতে তামাক গিলে খাচ্ছে ধানসহ অন্যান্য ফসলের জমি। প্রতিবছর নতুন নতুন এলাকায় সম্প্রসারণ হচ্ছে এর চাষ। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের উদাসীনতা ও তামাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নানা প্রণোদনামূলক প্যাকেজের ছদ্মাবরণে কৃষকেরা প্রলুব্ধ হচ্ছেন এ ক্ষতিকর চাষে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, খাগড়াছড়ি জেলার রামগড়, মাটিরাঙ্গা ও মানিকছড়ি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকভাবে তামাক চাষ হচ্ছে। আগে ধান ও অন্য ফসল হতো এরকম জমিতে- এখন হয় তামাক। কয়েকটি সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কৃষকদের অগ্রিম অর্থসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তামাক চাষ করানোয় উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে অন্যান্য ফসলের জমি মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে। তামাক চাষে আয় বেশি হওয়ায় কৃষক উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিবছর তামাক ক্ষেত সম্প্রসারণ করছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, রামগড় এক নম্বর ইউনিয়নের দাতারাম পাড়া, বৈদ্যপাড়া, লাছারিপাড়া, লক্ষ্মীছড়া, হাজাছড়া, ওয়াছুমৌজা, ধনীরামপাড়া, মুসলিমপাড়া পিলাকছড়া, অভ্যা মৌজা ও সোনাই আগা এবং নলুয়াছড়া এলাকায় নিয়মিত ফসলের পরিবর্তে তামাক চাষ হয়। এখানে তামাক পাতা শুকাতে ক্ষেতের পাশেই বড় বড় চুল্লি স্থাপন করা হয়েছে।
লক্ষ্মীছড়ার কৃষক মো. হারুন ও দুধুমিয়া জানান, প্রতিটি চুল্লিতে প্রতিবারে দুইশ কেজি কাঁচা পাতা শুকাতে প্রায় একশ মণ কাঠ প্রয়োজন হয়। পাহাড়ের টিলা ভূমি থেকে সংগৃহিত এসব কাঠ প্রতিমণ ৭০ টাকায় তারা কেনেন।
এদিকে মাটিরাঙ্গা উপজেলার ভারত সীমান্ত সংলগ্ন তবলছড়ি, তাইন্দং, কালাপানি, বেলছড়ি, গুমতি, বরনাল প্রভৃতি এলাকার বিপুল পরিমাণ জমিতে এবং মানিকছড়ির বাটনা ও এর আশপাশের আরও বিস্তীর্ণ জমিতে তামাকের চাষ হচ্ছে।
রামগড় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সদস্য মো. নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, এসব উপজেলা ছাড়াও খাগড়াছড়ির দিঘীনালায় তামাকের চাষ হয় সবচেয়ে বেশি। এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে কৃষকেরা অবগত নয়। তামাক চাষে মাটির উর্বর শক্তি নষ্ট হয়। পরপর কয়েকবার তামাক চাষ হয় এ রকম জমিতে অন্য ফসল ভাল হয় না। কতিপয় অসাধু লোক নিরীহ কৃষকদের মোটা অংকের আর্থিক প্রলোভন দেখিয়ে ধানের জমিতে তামাক চাষ করাচ্ছে।
তিনি বলেন, ক্ষতিকর আবাদ থেকে কৃষকেরা যেন মূল চাষে ফিরে আসে সে ব্যাপারে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক তরুণ ভট্টাচার্য ও কৃষি বিভাগের মাঠ কর্মীরা বলেন, প্রথমে অল্প জমিতে চাষ হয়। পরে ক্রমান্নয়ে চাষের আওতা বাড়ে। আগামী বছরগুলোতে হয়ত আরও বাড়বে। তাই এলাকায় নানা ফসলের জমি কমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে। কৃষকদের এর খারাপ দিক বুঝিয়ে মূল চাষে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি বিভাগ।
রামগড় পাহাড়াঞ্চল কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. জুলফিকার আলী ফিরোজ বলেন, তামাকের জমিতে ভবিষ্যতে স্বাভাবিক উৎপাদন হয় না। কৃষক যদি এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানত- কখনই এ সর্বনাশা কাজ করত না।
আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় তামাক চাষ বেশি হওয়ায় উপজাতি নেতাদের এটি বন্ধে এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।
বিশিষ্ট উপজাতি নেতা ও রামগড় উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু তামাকের আগ্রাসন প্রসঙ্গে বলেন, বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। এতে এলাকায় শাক-সবজির উৎপাদন অনেকটাই কমে যাচ্ছে। তাই পাহাড়ি হেডম্যান (পাড়া প্রধান) ও কারবারিদের সঙ্গে নিয়ে প্রত্যন্ত এলাকার কৃষকদের মাঝে তামাকবিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধিতে উদ্যোগ নেয়া উচিত।
এদিকে তামাক পাতা শুকানোয় নিয়োজিত শ্রমিকরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রাজেন্দ্র ত্রিপুরা ও ডা. নরেশ বিশ্বাস জানান, তামাক চুল্লিতে নিয়োজিত শিশু ও নারী শ্রমিকদের শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
লাছাড়ি পাড়ার কৃষক মো. মুজিবুর রহমান, আবদুল খালেক মোল্লা, মংপ্রু চাই মারমা ও থৈমং মারমা বলেন, সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ আমেরিকা টোব্যাকো কোম্পানি, আকিজ বিড়ি কোম্পানি, ঢাকা টোব্যাকো ও আবুল খায়ের গ্রুপের স্থানীয় প্রতিনিধিরা সার-বীজ কীটনাশকসহ সকল বিষয়ে কৃষকদের সার্বিক সহযোগিতা করেন। ভালো আয় ও তামাক ব্যবসা সংশ্লিষ্টদের সর্বাত্মক সহযোগিতা থাকায় প্রতিবছর এই অঞ্চলে চাষির সংখ্যা বাড়ছে।
তারা বলেন, তামাক চাষের জন্য প্রতিকানি জমি বাবদ (৪০ শতাংশ) ৫ হাজার টাকা করে পাচ্ছেন কৃষকরা।
কৃষিবিদ তরুণ ভট্টাচার্য বলেন, কৃষকদের তারা নানাভাবে বোঝাচ্ছেন। কিন্তু ক্ষতিকর তামাক চাষে লাভ বেশি হয় বলে তাদের ফিরতে সময় লাগবে।
সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক ও বনবিভাগের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
(ঢাকাটাইমস/২০এপ্রিল/প্রতিনিধি/এলএ)
মন্তব্য করুন