বোর্ডগুলোতে প্রশ্ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে বৈষম্য
বাংলাদেশে পাবলিক পরীক্ষা নেয়া হয় ১০টি বোর্ডের অধীনে। এর মধ্যে একটি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড এবং একটি কারিগরি বাদ দিলে বাকি আটটি বোর্ডে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এবং খাতা মূল্যালয়ের পদ্ধতি থাকে আলাদা। ফলে কোনো কোনো বোর্ডে প্রায়ই শিক্ষার্থীরা নিয়মিত খারাপ ফলাফল করছে। আর এসএসসি ও এইচএসসির পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হতে গিয়ে স্কোর হচ্ছে এই ফলাফলের ভিত্তিতেই। আর এতে পিছিয়ে পড়ছে এসব বোর্ডের শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারা দেশে একই পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়ন এবং প্রশ্ন প্রণয়ন না হলে বৈষম্য হয়। আর বছরের পর বছর এই বৈষম্য চলে আসলেও সরকারের বিষয়টিতে কোনো উদ্যোগ না থাকা আরও হতাশাজনক।
এবার সবচেয়ে বেশি পাস করেছে রাজশাহী বোর্ডে। রাজশাহীতে পাসের হার ৯০ দশমিক ৭০ শতাংশ। সবচেয়ে কম পাসের হার কুমিল্লা বোর্ডে। কুমিল্লায় পাসের হার ৫৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। এই দুই বোর্ডের পাসের পার্থক্যটা ৩১ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
এছাড়া ঢাকা বোর্ডে ৮৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ, দিনাজপুরে ৮৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৮৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ, সিলেট বোর্ডে ৮০ দশমিক ২৬ শতাংশ, যশোর বোর্ডে ৮০ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, বরিশাল বোর্ডে ৭৭ দশমিক ২৪ শতাংশ পাস করেছে।
অর্থাৎ ঢাকা ও রাজশাহী বোর্ডে উচ্চহারে পাস ছাড়া পাঁচ বোর্ডে পাসের হারের দিক থেকে মোটামুটি একটা সামঞ্জস্য আছে। কিন্তু কুমিল্লা বোর্ডের ফলাফল হয়েছে অনেক বেশি খারাপ।
এটা এবারই প্রথম নয়। কুমিল্লা বোর্ডে এর আগেও পাসের হার কম হয়েছে। এই বোর্ডে জিপিএ ফাইভ এর সংখ্যাও অন্যান্য বোর্ডের তুলনায় কম থাকে। আনুপাতিক হারেও কম হয় এটা।
কুমিল্লা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কায়সার আহমেদ ফলাফল বিপর্যয়কে অস্বাভাবিক আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘আমরা প্রথমবারের মত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মত পরীক্ষক আর প্রধান পরীক্ষকদের কঠোর মনিটরিং এ রেখেছি। এটাও ফলাফলের উপর একটি প্রভাব ফেলেছে।’
কায়সার আহমেদের এই বক্তব্য সঠিক হলে প্রশ্ন করা যেতেই পারে, তাহলে অন্য নয়টি বোর্ড কি এই নির্দেশনা কঠোরভাগে অনুসরণ করেনি? যদি একটি একক বোর্ড এক ধরনের নীতিমালা অনুসরণ করে এবং অন্যগুলো তা না করে, তাহলে বৈষম্যের অভিযোগ তো থেকেই যায়।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, যেহেতু এসএসসি এবং এইচএসসির পর উচ্চশিক্ষায় এই ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য স্কোর নির্ধারিত হয়, সেহেতু দুই পাবলিক পরীক্ষায় সব বোর্ডে একই প্রশ্ন এবং একই ধরনের মূল্যায়ন পদ্ধতি থাকা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সাবেক পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে এক বোর্ডের সঙ্গে অন্য বোর্ডের পার্থক্যটা চোখে পড়ার মতো। ৩০ শতাংশের উপরে তফাৎ থাকা অস্বাভাবিক। এরকম হওয়াটা প্রশ্নবিদ্ধ।’ তিনি বলেন, ‘পাসের হার কম বলে এর অর্থ এই না যে কুমিল্লা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে খারাপ। পরীক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে এটা হতে পারে।’
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান একে আজাদ চৌধুরী্র ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিভিন্ন বোর্ডের পাসের হারের তারতম্যটা চোখে পড়ার মতো। একই ব্যাকগ্রাউন্ডে, একই বই, একই কালচার ও একই কারিকুলাম থাকার পড়ালেখা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আলাদা আলাদা। মূল্যায়নও হচ্ছে আলাদা। আর এ কারণে ফলাফলেও হচ্ছে পার্থক্য। এটা প্রশ্নবোধক। পার্থক্য পাঁচ বা ১০ শতাংশ হতে পারে। তাই বলে ৩০ শতাংশ কীভাবে হবে?’।
নটরডেম কলেজের সাবেক অধ্যাপক এ এন রাশিদা বেগম বলেন, ‘ফলাফলের এই পার্থক্যটা খতিয়ে দেখা উচিৎ। এই পার্থক্যের কারণে উচ্চ শিক্ষাগ্রহণে খারাপ ফল করা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়বে। তাই সেখানে ফলাফল বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ভর্তি পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে ভর্তি করা ঠিক হবে।’
কুমিল্লা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কায়সার আহমেদের তথ্যমতে, গণিত এবং ইংরেজিতে পরীক্ষার্থীরা খারাপ করায় তার বোর্ডে ফল বিপর্যয় হয়েছে। এই বোর্ডে এবার এবার প্রায় ৩৫ শতাংশ পরীক্ষার্থী ফেল করেছে গণিতে আর প্রায় ৩০ শতাংশ পরীক্ষার্থী ফেল করেছে অংকে।
এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা স্ট্যান্ডারাইজেশন করে উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য দিক নির্দেশনা দিয়েছি। এখানে পৃথক মূল্যায়নের কোনো সুযোগ নেই। একটা পদ্ধতি আমরা ঠিক করে দিয়েছি। এই পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন হবে। কোনো ধরনের বৈষম্য যাতে না হয় সেই জন্যই এটা করা।’
ঢাকাটাইমস/০৫মে/এমএবি/ডব্লিউবি
মন্তব্য করুন