এসএসসি পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে নতুন পদ্ধতি কী ছিল
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এবার নতুন পদ্ধতি হিসেবে পরীক্ষকদের সামনে ‘মডেল উত্তরপত্র’ সরবরাহ করা হয়েছিল। ‘স্ট্যান্ডারডাইজেশন’ নামের এ পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়নে একটি মডেল উত্তরপত্র থাকায় আগের চেয়ে ঢালাও পাসের হার কমেছে বলে মনে করছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা।
নতুন পদ্ধতিতে ‘মডেল উত্তরপত্র’ অনুযায়ী সারাদেশের পরীক্ষার্থীদের খাতা মূল্যায়ন করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়নে নম্বর বেশি কম দেয়ার সুযোগ সেই। সবকিছু এই উত্তরপত্র অনুযায়ী মূল্যায়ন করা হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন পদ্ধতির নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে- এসএসসির ২২টি বিষয়ের খাতা প্রথম পরীক্ষক মূল্যায়ন করার পর নিয়ম অনুযায়ী প্রধান পরীক্ষক দ্বারা মূল্যায়নের পর এগুলোর সাড়ে ১২ শতাংশ খাতা তৃতীয়পক্ষ পুনঃনিরীক্ষণ করবে। এ ছাড়া দুই বছর আগে পরীক্ষার নৈর্ব্যক্তিক অংশের পূর্ণমান ছিল ৫০ নম্বর। গত বছর তা কমিয়ে ৪০ করা হয়। এ বছর তা আরও ১০ নম্বর কমিয়ে ৩০-এ নামিয়ে আনা হয়। নতুন এই পদ্ধতির প্রভাব পড়ে এবারের ফলাফলে।
এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অকৃতকার্য ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা গত সাতবছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলেও, শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়ন তুলনামূলক বস্তুনিষ্ঠতা অর্জন করেছে। খাতা মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় গুণগত এই পরিবর্তনকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক বলে ভাবছেন তারা।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন এই পদ্ধতির ফলে ঢালাও নম্বর দেয়া বন্ধ হয়েছে। কাউকে অতিমূল্যায়ন ও অবমূল্যায়ন করা হয়নি। শিক্ষকরাও যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে খাতা মূল্যায়ন করেছেন। এদিকে পরীক্ষকদের সামনে মডেল উত্তরপত্র থাকায় খাতা মুল্যায়নেও কোনো সমস্যা হয়নি বলে দাবি করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘নতুন পদ্ধতিতে একটি মডেল উত্তরপত্র তৈরি করা হয়েছে। এই নতুন মডেল উত্তরপত্র অনুযায়ী শিক্ষকরা খাতা মূল্যায়ন করেছেন। এটিই নতুন পদ্ধতি। এই পদ্ধতির নাম হচ্ছে স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন। অর্থাৎ একটা মান ধরে মডেল উত্তরপত্র তৈরি করা হয়েছে। সেই উত্তরপত্রের উপর প্রধান পরীক্ষকদের প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তপন কুমার সরকার বলেন, ‘যে মডেল উত্তরপত্র তৈরি করা হয়েছে, সেটা অনুযায়ী এবার সারাদেশে খাতা মূল্যায়ন করেছেন শিক্ষকরা। এতে করে খাতা মূল্যায়নে কোনো ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়নি। একজন শিক্ষার্থী উপযুক্ত নম্বর পেয়েছে। এ কারণে এবার এসএসসি পরীক্ষায় সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে। ফলাফলে তার প্রভাব পড়েছে।’
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, 'শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্য যদি মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন আনা হয়ে থাকে, তবে তা অবশ্যই ইতিবাচক। সঠিক মূল্যায়নই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারে।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান এ বিষয়ে ঢাকাটাইমসকে বলেন, নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন আপাত বিশ্লেষণে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে, সত্যি। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব নেতিবাচকও হতে পারে।
অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, ‘মডেল উত্তরপত্রের বিষয়টা অনেকটা বাটখারা রেখে ওজন করার মত। একজন শিক্ষক এমন বাটখারা রেখে খাতার মূল্যায়ন করবে, সেটা শিক্ষকদের নিজস্ব সামর্থ্য অর্জনের জন্য অন্তরায় হিসেবে কাজ করবে। শিক্ষকদের দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ দিয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে খাতা মূল্যায়নের স্বীয় সামর্থ্য অর্জনের সুযোগ ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে’।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে এতদিন কোনো সঠিক দিকনির্দেশনা ছিল না। পরীক্ষকরা নম্বর দিতেন তাদের মন-মর্জি মতো। এ কারণে প্রতি বছরই ফল প্রকাশের পর বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থীকে ফল পুনঃনিরীক্ষার (খাতা চ্যালেঞ্জ) আবেদন করতে দেখা যায়। আবেদনকারীদের মধ্য থেকে আবার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পরীক্ষার্থীর ফল বদলে যেতেও দেখা গেছে। শুধু গত বছরেই এসএসসিতে ১০টি বোর্ডের অধীনে প্রায় ১৫ হাজার পরীক্ষার্থীর ফল পুনঃনিরীক্ষণে পরিবর্তিত হয়েছে।
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চলতি বছরের শুরুতে উত্তরপত্র মূল্যায়নের একটি নতুন স্ট্যান্ডার্ড পদ্ধতি চালু করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর উদ্দেশ্য হলো, উত্তরপত্র মূল্যায়নে নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে আসা। চলতি বছরের জানুয়ারিজুড়ে এসএসসির প্রধান পরীক্ষকদের (হেড এক্সামিনার) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় মাস্টার ট্রেইনারদের দিয়ে। এ সময় তাদের প্রতিটি প্রশ্নের সঙ্গে একটি নমুনা উত্তরপত্রও দেওয়া হয়। প্রধান পরীক্ষকরা আবার তাদের অধীন পরীক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেন। মাসব্যাপী উত্তরপত্র মূল্যায়নের স্বীকৃত পদ্ধতির ওপর এ প্রশিক্ষণের পর ফেব্রুয়ারি থেকে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়।
এ বিষয়ে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার একজন পরীক্ষক জানান, ‘আমাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। তবে আমাদের প্রতি নির্দেশনা ছিল খাতা কড়া করে দেখার। সেটি আমরা করেছি’।
এবারের নতুন পদ্ধতিতে ফলাফল মূল্যায়নের পর দেখা গেছে, দেশের ১০টি শিক্ষা বোর্ডের প্রতিটিতেই পাসের হার গতবারের চেয়ে কমেছে। জাতীয়ভাবে এবার পাসের হার কমেছে প্রায় আট শতাংশ। গণিত এবং ইংরেজিতে ফেলের হার বেড়েছে। সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের। এখানে ইংরেজিতে ফেল করা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাই ২৫ হাজার ৬০৬ জন। আর গণিতে তো আরও বেশি, ৩৪ হাজার ৯৮৯ জন।
(ঢাকাটাইমস/ ১১ মে/এমএম/এসএএফ)
মন্তব্য করুন