‘হালদা’ নদী ও নারীর গল্প: তৌকীর আহমেদ

অনলাইন ডেস্ক
| আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০১৭, ১২:২৮ | প্রকাশিত : ১৫ নভেম্বর ২০১৭, ১২:১৬

আগের বছর ‘অজ্ঞাতনামা’ দেশ-বিদেশের বোদ্ধামহলে দারুণ প্রশংসিত হয়েছে। আবার নতুন ছবি নিয়ে আসছেন গুণী নির্মাতা ও সফল অভিনেতা তৌকীর আহমেদ। ডিসেম্বরের প্রথম দিনেই মুক্তি পাবে তার ছবি ‘হালদা’। নির্মাণ ও অভিনয়জীবনের নানা বিষয়ে তৌকীরের সঙ্গে আলাপ করেছে এই সময়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সৈয়দ ঋয়াদ

আপনার আরও একটি নতুন ছবি ‘হালদা’ আসছে। এ বিষয়ে বলুন।

‘হালদা’ মুক্তি পাচ্ছে ১ ডিসেম্বর। এই ছবিটি যেন দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় পরিবেশক এবং ‘হালদা’ ছবির পুরো টিম সেই চেষ্টা করছে। ‘হালদা’ অর্ধশতাধিক হলে মুক্তি পাচ্ছে এই বিষয়টি ইতিমধ্যে নিশ্চিত হয়েছে। এর আগে যে সংকটগুলো ছিল ‘হালদা’ মুক্তির ক্ষেত্রে সেসব অনেক কিছুই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। এর আগে দর্শক সেভাবে ‘অজ্ঞাতনামা’ দেখতে পারেনি। তারপরও তারা তাদের অনুভূতি আমাকে জানিয়েছে, প্রচুর প্রশংসা পেয়েছি। তাদের ভালোবাসা এবং সাপোর্ট পেয়েছি বলেই কিন্তু ‘হালদা’ করতে পেরেছি।

দর্শকরা ‘হালদা’ কেন দেখবে?

‘হালদা’ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। এই বিপন্ন নদীটি নিয়েই ‘হালদা’ সিনেমাটি। নদী ও নারী এই দুটো বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি জীবনের উৎস বলি তাহলে একটি হলো নদী অরেকটি নারী। এই দুটোই আমাদের মা। কিন্তু এই দুটোকেই আমরা বিপন্ন করি। এটি আসলে নদী ও নারী বিপন্ন করার গল্প। এই যে নারী- কখনো কন্যা কখনো প্রেমিকা, কখনো মাতা এ বিষয়গুলো এখানে এসেছে। হালদা পারের জনপদের মধ্য দিয়ে আবহমান কালের বাংলাকেই দেখা যাবে। হালদা বিপন্ন হওয়ার কারণে মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। তাদের জীবন বাধা পড়ে এই চক্রের মধ্যে। হালাদাতে হিংসা আছে, সংঘাত আছে, আছে প্রেম। হালদা পারের মানুষের জীবন এবং সংস্কৃতিই আছে এই ছবিতে। আমি মনে করি এই দেশ, এই মাটিকে দর্শক হালদায় দেখতে পাবে। ‘হালদা’ নদী ও নারীর গল্প।

‘অজ্ঞাতনামা’ সিনেমা যারা দেখেছে, তারাই প্রশংসা করেছে। কিন্তু অনেকেই দেখার সুযোগ পাননি। এমন অভিযোগ কিন্তু কম নয়।

একজন নির্মাতার কোনো হাত নেই এই বিষয়ে। এটা নির্ভর করে প্রযোজকের হাতে। সেখানে আমি এবং আমার প্রযোজক ব্যর্থ হয়েছি। সেই ব্যর্থতা এবং দর্শকদের অভিযোগের কারণে আমরা হালদা নিয়ে কাজ করছি। দর্শক থেকে শুরু করে সবাই এই অভিযোগটি করেছে সেটি হলো অজ্ঞাতনামা প্রচার হওয়া দরকার ছিল। সবাই সেটা দেখতে চেয়েছে। এবার ‘হালদা’র বেলায় দর্শক সেই সাপোর্টটা করছে। এটাই আসলে স্পিরিট। নির্মাতা এবং দর্শক ছবির জন্য কাজ করা। আমি ছবি বানাই তাদের জন্য। তারাও দেখেন আমার জন্য। দর্শকের সঙ্গে নির্মাতার একটা ভালোবাসার সম্পর্ক। আমি তাদের নিয়েই হালদার জন্য কাজ করছি। যেন আমাদের দর্শক ছবিটা দেখতে পায়। দুই পক্ষ সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে। এটা উচিত না। সম্প্রতিক দুটি ছবি থেকে আমার এটা মনে হয়েছে। খারাপ প্র্যাকটিস। আবেগতাড়িত হয়ে আমরা যেন সম্পর্কটা নষ্ট না করি।

সেটা কি দর্শকের প্রাপ্তি বা প্রত্যাশা থেকে হয়েছে বলে মনে করছেন?

প্রচারেই প্রসার। এই কনজিউমার্স ওয়ার্ল্ডে এই রিয়ালিটিকে আমি অস্বীকার করতে পারি না। তবে আমি যেটা বলতে চাই, প্রচার করার আগে যেন প্রডাক্টটি ঠিক থাকে। তা না হলে এটা ফলস মার্কেটিং হয়ে যাবে। তাহলে যা হবে, পরবর্তীতে এটা বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে। তবে আমাদের ছবিও ভালো হতে হবে। দর্শকদের মতমত তো থাকবে, সেটাও গ্রহণ করতে হবে। তবে এটা যেন একটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ের না হয়। কারও সম্মান ক্ষুণœ করে ট্রল করা ঠিক উচিত নয়। কারণ নির্মাতা কিন্তু চেষ্টা করেন দর্শককে ভালো কিছু দেওয়ার।

অজ্ঞাতনামা গল্পটাই ছিল ব্যতিক্রম। গল্পের উৎসটা জানতে চাই।

আমার একজন পরিচিত মানুষ আমাদেরই কাজ করেন। তিনি তার গ্রামে বিদেশ থেকে একটি লাশ আসার গল্প বলেছিলেন। একটি কফিন এসেছিল যেটাতে ভুল লাশ ছিল। সে আমাদেরকে যখন বলে আমি তখন বারবার প্রশ্ন করি তারপর কি হয়েছিল? সে তখন বলে আমি তো জানি না তারপর কি হলো। তখন আমার মাথায় কাজ করতে থাকে আসলে তারপর কি হয়েছিল? লাশটা কি ফেরত যায়। কিছু একটা তো হয়েছিল। তার আগে ভেবেছি আগে কি হয়েছিল। এতো মানুষ কেন বিদেশে যায়। আমি সার্চ করতে থাকি। ২০১৪ সালের আগে মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ১৪ হাজার লোক মারা গেছে। এমন অসংখ্য খবর আমি পত্রিকায় পেতে থাকি। প্রতিদিন আসা কফিনের সংখ্যা প্রায় আট-দশটির মতো। একজন মানুষ হিসেবে এটা আমাকে ভাবিয়েছে। তার পরই আমি মঞ্চনাটকের স্ক্রিপ্ট লিখি। মঞ্চনাটক বিলম্বিত হওয়ায় আমি এটাকে ফিল্ম বানাই। অজ্ঞাতনামা বিভিন্ন মানুষ দেখেছেন। অনেক ফেস্টিভালে গেছে। ইতালির এক লোক কেঁদেছেন, কসোবোর একজন কেঁদেছেন, ইরানের একজন কেঁদেছেন। এই একই সঙ্গে আমি বলতে চাই এই নামহীন মানুষের প্রাপ্য সম্মানটা যেন আমরা দেই। আমরা যেন আমাদের ন্যাশনাল প্রাইড নষ্ট না করি। এটার সঙ্গে আমাদের ন্যাশনাল ডিগিনিটি জড়িত। আমরা শুধু লেবার পাঠিয়ে দেব আর রেমিট্যান্স গুনব, আমাদের আত্মসম্মানের জায়গাটা নিশ্চিত করব না, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করব না, এটা ভুল হবে।

ফেস্টিভালকেন্দ্রিক ফিল্ম তৈরি হচ্ছে, সেগুলোর আবার একশ্রেণির দর্শক আছে, কিন্তু দর্শকের বড় যে সংখ্যাটা আছে তারা এই ফিল্ম থেকে বিমুখ কি না?

আমার মনে হয় ফেস্টিভালের ফিল্মগুলোর ধরন একটু আলাদা। কমার্শিয়াল ধারার ছবিগুলো আবার সেগুলো থেকে আলাদা। এটা যদি আমি একটু পরিষ্কার করে বলি, পৃথিবীতে যে দুটি কমার্শিয়াল ধারা সবচেয়ে বেশি প্রচলিত, তার একটি হলো হলিউড, অন্যটি বলিউড। এই দুটি ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু মূলত কমার্শিয়াল ফিল্ম তৈরি করে। অস্কারের যে পাঁচটি ছবি নমিনেশন দেওয়া হয় সেখানে কিন্তু ওই ধরনের ছবি খুব কম থাকে। পুরস্কারের সময় দেখা যাচ্ছে র‌্যাম্বো পুরস্কার পাচ্ছে না, পাচ্ছে বার্ডম্যান। পার্থক্যটা আসলে এখানেই বোঝা যায়। যেখানে জীবনের অনেক আবিষ্কার আছে, উপলব্ধি আছে, কিংবা সিনেমা ‘অ্যাজ এ ক্রাফট’ যেখানে নতুন কিছু দেওয়া হচ্ছে। ইউরোপীয় ফেস্টিভালগুলোতে দেখা যায় যে, তাদের প্রকাশ ভঙ্গি আর তৃতীয় বিশ্বের মানুষ হিসেবে আমাদের প্রকাশভঙ্গির মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। এটাই রিয়ালিটি।

আমাদের দর্শকের উপযোগী কিংবা তাদের রুচিবোধ নিয়েই তো নির্মাতারা কাজটা করেন।

ওখানে যখন জার্মান আর্ট নবো নিয়ে কথা হচ্ছে, ফভিজম, একসপ্রেশনিজম, ফিউচারিজম, কিউবিজম, দাদাইজম কিংবা সুরিয়ালিজম নিয়ে কথা বলছে, তখন কিন্তু আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের মানুষ অর্থনীতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছি। এই মহাদেশ কিংবা এই দুটো দেশের জীবনযাপনের মধ্যেও কিন্তু পার্থক্য আছে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও পার্থক্য আছে। আমি আমার সংস্কৃতি তাদের কাছে দেব নাকি অন্য কিছু দেব? কিন্তু তারা প্রায়ই সেটার সঙ্গে কানেক্ট করতে পারবে না। আরেকটা হতে পারে, উপমহাদেশের অন্যরা কি পছন্দ করে? আমরা যদি তাদের ঢঙে ছবি বানাই, সেটা ফেস্টিভালে অনেক বেশি ভালো করবে। আমি অজ্ঞাতনামাকেই যদি ইউরোপকে মাথায় রেখে বানাই তাহলে মেকিংটা ডিফারেন্ট হবে। আমি কিন্তু অজ্ঞাতনামাকে আমার ছবি হিসেবে বানাতে চেয়েছি। ডকুমেন্ট্রি করে পিকচারাইজেশনের চেষ্টা করেছি। অনেকে বলেছে এটার ক্যামেরার কাজ আরও সুন্দর হতে পারতো। কালার আরও ভালো হতে পারতো। আমরা কিন্তু রিয়ালিটিকেই তুলে ধরতে রাশ জিনিসটাই রেখেছি। যেন ঘটনাটাকে বাস্তব বলে মনে হয়। আমার মনে হয় পৃথিবীতে নানা ঢং থাকবে। নানা স্টাইল থাকবে। কন্টেন্ট থেকে স্টাইল বা ফর্ম আসবে। আমি যদি শুধুমাত্র স্টাইল অনুকরণ করতে যাই তখন আমার ছবি দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু আমি যদি আমার দেখা বাস্তবতাকে তুলে ধরতে পারি তা সাবলীল হবে। আমার ছবিটা এই রকমই। সেই সাহসের সঙ্গেও কিন্তু আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে।

সেই বাস্তবতা থেকে যদি বলি, আমাদের ফিল্মগুলো কি আমাদের গল্প বলতে চেষ্টা করেছে?

এটা আসলে খুবই সত্য। আমি যখন ‘জয়যাত্রা’ বানিয়েছিলাম, আমার ধারণা ছিল, লোকে ছবিটা দেখবে। আমাদের দেশের গল্প নিয়ে ছবিটা। কারণ এটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছবি। এটার সঙ্গে এই বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী জড়িত। কিন্তু আমার ধারণা মিথ্যা হলো। দর্শক ছবিটি দেখেনি। পরবর্তীতে যখন ‘রূপকথার গল্প’ বানাই তখন একটা-দুইটা হল ছাড়া সেটা কোনো হল মালিক নিতেই চায়নি। আবার ‘দারুচিনির দ্বীপ’ যখন এন্টারটেইনিং করে বানালাম সেটা আবার খুব দেখলো। অজ্ঞাতনামার ক্ষেত্রে আবার ‘জয়যাত্রা’ কিংবা রূপকথার গল্পের বাস্তবতা ফিরে আসলো। হলওয়ালারা এটা নিলেন না। তারা বিশ্বাস করেন না এটি দর্শক দেখবে! তারা বিশ্বাস করলেন না, এই ছবিতে বিনোদন আছে! এই জায়গাটায় নির্মাতা অসহায়। কারণ তাকে বিপণনযোগ্য হতে হবে। কিন্তু এই দায় নিয়ে আমি ছবি বানাইনি।

এটা কি শুধু বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য।

এটা সারা বিশ্বের বাস্তবতা। চটুল জিনিস বা পপ আর্ট বেশি দেখে লোকে, সেটা বেশি বিক্রি হয়। ভালো ছবি ইউরোপ- আমেরিকাতেও কমার্শিয়াল মুভির সঙ্গে পারে না। বক্স অফিসের হিসেবে এটাই রিয়ালিটি। যদিও ওদের এখানে অন্যান্য ব্যবস্থার মাধ্যমে সেগুলো দেখানো হয়। সেখানে মাস টেস্টের কাছে নির্মাতাকে যেতে হয়।

একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। অভিনেতা তৌকীর আহমেদ নাকি নির্মাতা- কে এগিয়ে?

আমি মনে করি, অভিনেতা তৌকীর আহমেদকে আরও অনেক ব্যবহার করা যেত। তার অভিনয় দক্ষতার খুব সামান্যই ব্যবহার করা হযেছে। এই দুইটার মধ্যে তুলনা করা কঠিন। আমি আজকে যা, তা আমার গতকালের ভাবনারই ধারক। গতকালের উপলব্ধি দিয়েই তো আজকের আমি। অভিনেতা তৌকীর আহমেদই আসলে নির্মাতা তৌকীর। অভিনয় তার পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেকখানি সহায়তা করেছে। আমি অভিনয় করতে পছন্দ করি। কেউ ডাকলে আমি অভিনয় করি। আর আমার ধারণা আমাকে ব্যবহার করার সুযোগ আছে। আমি কখনো সো কল্ড রোমান্টিক হিরো হিসেবে থেকে যেতে চাইনি। আমি নব্বইয়ের দশকে সেই ফেইসটা এড়িয়ে গেছিলাম। যখন আমাকে বারবার ওই ধরনের চরিত্রে ডাকা হচ্ছে, তখন আমি নায়ক হতে চাইনি। অভিনেতা হতেই চেয়েছি।। বয়স এবং অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে যেই ম্যাচিউরিটি আমাদের হয়েছে। এখন দেখছি সেটা ব্যবহার করার চেষ্টা হচ্ছে না। অভিনেতা তৌকীর আহমেদ কিন্তু একজন পরিচালককে অনেক সহযোগিতা করতে পারে।

অসাধারণ কিছু অভিনয় আছে, রূপকথার গল্পের সেই ট্রাক ড্রাইভার হিসেবে।

এই সিনেমায় আমি লুঙ্গি পরা, পান খাওয়া, চা খাওয়া এক ট্রাক ড্রাইভার। আমার রূপকথার গল্প সিনেমার এডিটর কলকাতার। উনি যখন এডিট করছেন আমি তখন তার পাশে বসা। এডিটর আমাকে বলছেন এই ট্রাক ড্রাইভারটা কে? খুব ভালো অভিনয় করেছে। আমার দাড়ি, গোঁফ এবং আচরণে ফার্স্টলুকে তিনি বুঝতেই পারেননি এটা আমি। আপনি যদি ‘রাবেয়া’ দেখেন সেখান আমার একটা পাগলের চরিত্র। আড়াল দেখেন আমি সেখানে ভিলেন। আবদুল জলিলের বিদেশ যাত্রা দেখেন, সেখানে আমি একটা খাইশটা ধরনের লোক। সুতরাং আমার চরিত্র নির্মাণের চেষ্টা করি। ইমেজ নিয়ে হাজির হওয়ার চেয়ে চরিত্র নিয়ে হাজির হওয়া। আপনি জালালের গল্প দেখেন। আমি একটি ভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছি যার সন্তান ধারণের ক্ষমতা নেই। সে একটা সন্তান চায়। এগুলো এপ্রিশিয়েট করার মতো ডিরেক্টরও লাগবে, সেই দর্শকও লাগবে।

ব্যবহার করা হয়নি কোন অর্থে?

আমাদের দেশে একটু সিনিয়র হলে তাকে দিয়ে আর কাজ করানো হয় না। কারণ তখন সবাই বলে উনি সিনিয়র হয়ে গেছেন। আপনি যদি ডেনজেল ওয়াশিংটনকে দেখেন তার ৫৮ বছর বয়স, টম হ্যাঙ্কসকে দেখেন, ডেনিয়েল ডে-লুইসকে দেখেন। তার মানে ম্যাচিউরড হতেই কিন্তু ৪০ বছর চলে যায়। তার পরে তারা তাদের আসল স্কিলডটা কাজে লাগাচ্ছে। আমাদের দেশে ঠিক উল্টো। অভিনেতারা যখন পরিণত হচ্ছে, তখন আর ব্যবহার করা হচ্ছে না। টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি থেকে ঝামেলাটা শুরু হয়েছে। সেখানে একদল লোক এই ইন্ডাস্ট্রিটাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন- সো কল্ড এজেন্সি এবং স্পন্সরের নাম করে। কোনো যোগ্যতা নেই এই মিডিয়াকে গাইড করার। কিন্তু পুঁজি যেহেতু তাদের হাতে চলে গেছে, নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে। এগুলো শোনার পর তারা বলবেÑ ওকে নিও না।

নির্মাণের ওপর আপনার কিছু প্রশিক্ষণও আছে।

আসলে এগুলো বলার মতো কিছু না। আমার যেটা শিখতে হবে মনে হয়েছে সেটাই করেছি। আমরা যদি উন্নত বিশ্বে থাকতাম তাহলে সেই সুযোগটা আরও বেশি হতো। আমাদেরকে স্বশিক্ষার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হয়েছে। অজ্ঞাতনামাতেও আমার করার মতো চরিত্র ছিল, হালদাতেও ছিল। কিন্তু আমি ক্যামেরার সামনে গেলে, পেছনের এটা করবে কে? এখানে একা ভ্যাকুয়াম তৈরি হবে। বিদেশে কিন্তু এটা প্রচুর হয়। সেই রিয়ালিটি আমাদের এখানে নেই। এখানে ওয়ান ম্যান আর্মিতে কাজ করতে হয়। আমাদের এখানে এক-দুইজন ভালো এসিসটেন্ট থাকে এই টিমটি যদি আরও স্টং করা যেত। তাহলে হয়তো বা নিজের ছবিতে নিজের অভিনয় করার রিস্ক নেওয়া যেত। আমি এটা দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করি, অজ্ঞাতনামায় সেলিম ভাইকেও এটা বলি, তিনি যখন রাজি হচ্ছিলেন না। তখন আমি বলেছি- আমি কিন্তু দাঁড়িয়ে যাব।

অভিনয় তো আপনি কমই করছেন।

আমি কিন্তু অন্যদের ছবিতে অভিনয় করছি। ইমরান মিঠুর ‘কমলা রকেট’ সেটার প্রধান চরিত্রে আমি কাজ করছি। মোহাম্মদ দিদারের একটি ছবিতে কাজ করেছি। সামনেও কেউ আমাকে ডাকলে আমি করব সেটা যদি ভালো কাজ হয়। ভালো স্ক্রিপ্ট, ভালো পরিচালক হলেই তৌকীর আহমেদ অভিনয়ের জন্য ডেডিকেটেড।

দারুচিনির দ্বীপ ২০০৮, এর পর দীর্ঘ সময় সিনেমা নির্মাণে ছিলেন না।

সেই সময়ে আমি যেই ছবিটি করতে চেয়েছিলাম সেটি আজও করতে পারিনি। সেটা হলো ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে, নাম ‘ফাগুন হাওয়ায়’। এটি আমি অনুদানের জন্য জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু অনুদান মিলেনি। আমি সত্যি বুঝিনি একটি ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটের ছবিকে তারা কেন গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি। অথচ ওনারা অনেক হাস্যকর ছবির জন্য অনুদান দেন। কোনো প্রযোজকও এটার ব্যাপারে এগিয়ে এলো না। একটা অভিমান তৈরি হলো। আমি কাজের লোক তাই বসে থাকিনি। ছোটপর্দায় নাটক বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আমার মেকিং স্কিল্ড নিয়েও কাজ করেছি। ‘জয়যাত্রা’ নিজে বানিয়েছিলাম, প্রযোজনাও করেছি। দেউলিয়া হতে হয়েছে। এক ধরনের সিকিউরিটি দরকার। আমাদের পেশায় কোনো পেনশন নেই, কোনো ধরনের সোশ্যাল সিকিউরিটি নেই। এই সময়টাতে আমি অনেক কিছু গুছিয়েছি। ‘জালালের গল্প’ নিয়ে আমি ইমনের সঙ্গে বুসানে গেলাম। ফিরে এসেই ‘অজ্ঞাতনামা’ করেছি। তখন আমি ঠিক করলাম আমি যত দিন বেঁচে থাকব প্রতিবছর কিংবা দেড় বছরে হলেও একটি করে ফিল্ম করার চেষ্টা করব। এরই ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় প্রজেক্ট হিসেবে ‘হালদা’ করেছি। আপনি শুনলে খুশি হবেন যে, ‘ফাগুন হাওয়ায়’ নামে যে সিনেমাটি করতে চেয়ছিলাম সেটি খুব শিগগিরই শুরু করব।

আমাদের দর্শক কী হলে ফিরতে শুরু করেছে?

মধ্যবিত্ত দর্শক, যাদেরকে ফিল্ম থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল, তারা আবার হলে ফিরছে। এটা আমাদের জন্য শুভ বার্তা। ভালো দর্শক হলে ফিরলে নির্মাতার দায় আরও বেড়ে যাবে। কারণ নির্মাতাদেরকে দর্শকের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। ছবি সম্পর্কে যেভাবে আমাদের দর্শকরা সরব সেটি আশার খবর। তাৎক্ষণিক তাদের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে। এটা খুব শুভ লক্ষণ। চলচ্চিত্র এমন একটি মাধ্যম যে ছবি সময়কে অতিক্রম করতে পারবে সেগুলোই ভালো ছবি। আজকে আমরা যতই সার্টিফিকেটই দেই না কেন। ফিউচারে যদি এটা কেউ না দেখে তাহলে সেটা আর ভালো বলে বিবেচিত হবে না।

শোনা যায় হলের সংকট আছে, সিন্ডিকেটও?

হলের সিন্ডিকেট বলেন আর মনোপলি বলেন এটা কোনো ব্যবসার জন্যই ভালো না। এটা চালের হোক আর চিনির হোক। আমাদের দেশের ফিল্ম এবং টিভি ইন্ডাস্ট্রিও একটি সিন্ডিকেটের মধ্যে পড়ে গেছে। সিনেমা হল সেই সিন্ডিকেট থেকে বেরিয়ে আসবে বলে মনে করি। এই ক্ষেত্রে কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভূমিকা রাখতে হবে। চলচ্চিত্র কতটা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রকে তুলে ধরতে হবে। আমাদের শাসকেরা অনেক সময় বুঝতে ভুল করেছেন। একটি জাতির মননশীলতা ও মানস গঠনে চলচ্চিত্র সবচেয়ে সক্ষম মাধ্যম। এটাকে আমি বিদ্যাপীঠ বলব না। তার দার্শনিক জায়গাটা ইউটিলাইজ করা সম্ভব। বিনোদন না থাকলে এই সমাজের ক্রাইম বেশি হয়। যখন ফুটবল বিশ্বকাপ হয় তখন কিন্তু ক্রাইম কমে যায়। আমরা যদি উন্নত ধারার চলচ্চিত্র ছড়িয়ে দিতে পারি ছেলেরা অন্যান্য নেশা জাতীয় দ্রব্য থেকে ফিরে আসবে। তারা ভালো চিন্তা করবে। হলের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এই জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ১২০০ থিয়েটার তৈরি করে। যেন থিয়েটারের মাধ্যমে মেসেজগুলো জনগণের কাছে পৌঁছে যায়। জেলায় শুধু না প্রতিটি কমিউনিটিতে সিনেপ্লেক্স হওয়া উচিত। এমনও অনেক মফস্বল শহর আছে যেখানে দু-তিনটি সিনেমা হল আছে। আমার জেলায় তিন- চারটি হল ছিল । আমি যেখানে পড়াশোনা করেছি ঝিনাইদহতে সেখানে তিনটি হল ছিল। গভর্নমেন্ট চাইলে খুবই সহজ কাজ। সরকার ইদানীং একটি খুবই প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। ৬৪টি জেলায় শিল্পকলার মাধ্যমে ছবি দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটা বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসব নামে শুরু হয়েছে সেখানে ‘অজ্ঞাতনামা’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ নির্মাতা হিসেবে পুরস্কার জিতেছে। এর মানে হচ্ছে একটি ছবি ৬৪টি জেলার মানুষ দেখতে পারছে।

স্থাপত্যের ছাত্র, থিয়েটার করলেন, অভিনয়- সেই সঙ্গে লেখাজোখাও।

আমি যখন প্রথম থিয়েটার করতে যাই তখন সবাই বলাবলি করছিল বুয়েটের ছেলে থাকবে না। এটা ১৯৮৫ সালের কথা। তখন আবদুল্লাহ আল মামুন স্যারসহ সবাই বারবারই বলার চেষ্টা করলেন আমি সময় দিতে পারব না। আমি বলেছিলাম আমি করতে চাই। পরে আমাকে নেওয়া হলো। থিয়েটার থেকেই শুরু। টেলিভিশনে অভিনয় করার প্রসেস ছিল, কিন্তু প্রতিযোগিতা ছিল অনেক বেশি। আপনি নিজেকে প্রমাণ করতে পারলেই শুধু আপনি সুযোগ পাবেন। আর এখন আপনি এই কাজটি না করতে পারলেও যেতে পারছেন। আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘তোমরাই’ নাটকটি যখন ১৯৮৭ সালে করি তখন দারুণ নাম করি। তখন আমাকে এনলিস্টেড করা হয় বিটিভিতে। তিনি আবার খ ম হারুনের কাছে আমাকে রিকমেন্ডও করলেন। বললেন, ‘আমাদের দলের একটি ছেলে আছে তুমি তাকে দেখ।’ ১৯৮৮ সালে ‘ফিরিয়ে দাও অরণ্য’ নাটকে প্রথম এপিসোডের শেষে আমার এন্ট্রি হয়। ওই দৃশ্যে আমি দেশব্যাপী আলোচিত হই। আমি এতটাই ভাগ্যবান ছিলাম। তখন একটি-দুটি নাটক করতে পারলেও অনেক ভাগ্যবান মনে হতো। এখন সন্তানদের আমি যদি বলি আমার ছোটবেলায় টিভি ছিল না তারা তখন অবাক হয়।

আপনাকে ধন্যবাদ।

আপনাকেও ধন্যবাদ। সেই সঙ্গে এই সময় পরিবারের সবাইকে শুভেচ্ছা।

একনজরে

বিশ শতকের আশির দশকে তার অভিনয় জীবনের সূচনা। মঞ্চ ও ছোটপর্দায় নব্বইয়ের দশকে বিপুল জনপ্রিয়তা পান। হালে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেই বেশি ব্যস্ত। প্রথম চলচ্চিত্র ‘জয়যাত্রা’র জন্য ২০০৪ সালে শ্রেষ্ঠ প্রযোজক, পরিচালক ও চিত্রনাট্যকারের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এরপর একে একে তৌকির নির্মাণ করেন রূপকথার গল্প, দারুচিনি দ্বীপ, অজ্ঞাতনামা ও হালদা। তৌকির আহমেদ শিক্ষাজীবনে বুয়েট থেকে স্থাপত্যে স্নাতক করেছেন। লন্ডনের রয়্যাল কোর্ট থিয়েটার থেকে মঞ্চনাটক নির্দেশনার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। নিউইয়র্ক ফিল্ম একাডেমি থেকে ডিপ্লোমা সনদ নিয়েছেন চলচ্চিত্র বিষয়ে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিনোদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিনোদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :