রাজনীতিতে উত্তাপহীন একটি বছর

বোরহান উদ্দিন, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:৪৫ | প্রকাশিত : ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:৪২
আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন

জীবনের ক্যালেন্ডার থেকে চলে যাচ্ছে আরও একটি বছর। রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা ঘটনা ঘটলেও এবার এই অঙ্গনে ছিল না তেমন কোনো উত্তাপ। একাদশ সংসদ নির্বাচনে হ্যাটট্রিক জয় পেয়ে সরকার গঠনের মাধ্যমে বছর শুরু করে আওয়ামী লীগ। আর নির্ধারিত সময়ে ২১তম সম্মেলনের মাধ্যমে বছর শেষ করে সব থেকে প্রবীণ এই দলটি।

অন্যদিকে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ আনা বিএনপি ভরাডুবির ফলাফল নিয়ে সংসদে যোগ দেয়। তবে শুরুতে শপথ নিয়ে নাটক করে বেশ সমালোচিত হয় দলটি। বছরজুড়ে সংসদের বাইরে ও ভেতরে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ছিল তাদের। যদিও বেশিরভাগ প্রতিবাদ ছিল দলের কারাবন্দি চেয়ারপারসনের মুক্তির দাবিতে।

তবে আশায় বুক বেঁধে থাকলেও বিএনপি নেত্রীর মুক্তির অপেক্ষায় নেতা-কর্মীদের গোটা বছর কেটেছে। শেষ দিকে প্রত্যাশা বেড়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত মুক্তির দেখা মেলেনি। বরং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে তার পরিবার ও নেতা-কর্মীদের।

শেষ বেলায় জেলা কমিটির হিড়িক

রাজনৈতিক মাঠ নিরুত্তাপ থাকায় অন্যান্য বছরের মতো আওয়ামী লীগের সময় কেটেছে নিজেদের নিয়ে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে জয়লাভ করে গত ১২ জানুয়ারি নতুন সরকার গঠন করে দলটি।

এদিকে বছরের শুরুতেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ৩ জানুয়ারি ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে সৈয়দ আশরাফ থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ৬৮ বছর বয়সে মারা যান।

গত দুই বছরে মাত্র একটি জেলা কমিটি করলেও দলের মেয়াদ শেষে বছরে ২৯টি জেলায় তড়িঘড়ি করে কমিটি দেওয়া হয়। তবে ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে অনেক কমিটি বাকিই থেকে গেছে।

গত ২০-২১ ডিসেম্বর সম্মেলন করে তিন বছরের জন্য নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি করে আওয়ামী লীগ। এছাড়া সম্মেলনের মাধ্যমে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও উত্তরে নতুন নেতৃত্ব আনা হয়। এর বাইরে স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগ, কৃষকলীগ, মৎস্যজীবী লীগে নতুন কমিটি হয়েছে সম্মেলনের মাধ্যমে।

আলোচনায় ছিল শুদ্ধি অভিযান

গত সেপ্টেম্বরে দলে শুদ্ধি অভিযান শুরু করে আওয়ামী লীগ। ১৪ সেপ্টেম্বর চাঁদাবাজির অভিযোগে সমালোচনার মুখে থাকা রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীকে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাদের জায়গায় আল নাহিয়ান খান জয় এবং লেখক ভট্টাচার্যকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য অব্যাহতি দেওয়া হয় যুবলীগ সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরীকেও।

এরই মধ্যে শুরু হয় ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান। এতে যুবলীগসহ বেশ কয়েকটি সংগঠনের প্রভাবশালী নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয় সারা দেশে। আতঙ্কে ভুগতে থাকেন দুর্নীতিবাজ নেতা-কর্মীরা। ক্যাসিনোকাণ্ডে নিজ দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা জড়িত হওয়ায় এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় আওয়ামী লীগকে। তবে এই অভিযান ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ে।

বছরজুড়ে বিএনপির যত কর্মকাণ্ড

খালেদা জিয়ার মুক্তির লক্ষ্যে বহু পর্যবেক্ষণ, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বছর পার করেছে বিএনপি। দোয়া-মোনাজাত, কালো পতাকা মিছিল, মানববন্ধন ও কয়েকটি সমাবেশ হয়েছে বছরজুড়ে। এসব নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভও আছে। তবে বারবারই শীর্ষ নেতারা সময়মতো আন্দোলনে যাওয়ার কথা বলে বছর শেষ করেছেন।

নেতাদের শঙ্কা, দলের সার্বিক অবস্থায় কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার পরিস্থিতি নেই। তাই অতীতের মতো আন্দোলনের ফল ঘরে তুলতে না পারলে ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে।

খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে চলতি বছর প্রথম ৪ ফেব্রুয়ারি দুটি কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। খালেদা জিয়াসহ দেশের কারাগারে বন্দি নেতা-কর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিএনপির উদ্যোগে প্রতিবাদ কর্মসূচি ও একই দাবিতে ৯ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে ফাঁকে ফাঁকে শান্তিপূর্ণ এমন কর্মসূচি দিয়েই মাঠে থাকার চেষ্টা করে বিএনপি।

নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলার পর সংসদ সদস্যদের শপথ নিয়ে পুরো বিশ্বকে ডিগবাজি দেখায় বিএনপি। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে শপথ নেওয়া কাউকে বেইমান, কাউকে বহিষ্কার করলেও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া বাকি সাতজনই শেষ পর্যন্ত শপথ নেন।

শপথ নেওয়া এমপিদের মধ্যে গরম বক্তব্য দিয়ে সংসদে ঝড় তোলা রুমিন ফারহানা গত ৩ আগস্ট পূর্বাচলে ১০ কাঠার প্লট চেয়ে আবেদন করেন, যা নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পরে অবশ্য আবেদন প্রত্যাহার করে নেন।

এরই মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের ‘অনিয়ম’নিয়ে ২ ফেব্রুয়ারি গণশুনানি করে বিএনপির নতুন মিত্র ঐক্যফ্রন্ট। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে শুনানি হয়। এর আগে ভোটে ভরাডুবির পর প্রার্থীদের ঢাকায় ডাকে বিএনপি। ভোটে অনিয়ম-কারচুপির প্রমাণ, অস্বাভাবিক ভোটের হিসাবসহ আটটি বিষয়ের তথ্য-সংবলিত একটি প্রতিবেদন চাওয়া হয়। পরে নির্বাচনে অনিয়মের কথা বিএনপির তত্ত্বাবধানে ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের কাছে তুলে ধরেন ড. কামাল হোসেন।

এরপর স্থানীয় নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ভোটে অংশ নেওয়ায় বিএনপিতে শুরু হয় বহিষ্কার উৎসব। ২৬ ফেব্রুয়ারি শুরু করে ধাপে ধাপে কয়েকশ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। যদিও পরে তা প্রত্যাহারও করে নেওয়া হয়।

দলীয়প্রধান কারাগারে থাকায় জুন মাসে অন্যান্য বছরের মতো ইফতারের তেমন আয়োজন ছিল না বিএনপির। বরং খালেদা জিয়ার সম্মানে ২৮ মে ইস্কাটন লেডিস ক্লাবে ৩০ টাকার সমমূল্যের খাবার দিয়ে ইফতার করেন বিএনপি, ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলের শীর্ষনেতারা। কারণ কারাবিধি অনুযায়ী তার জন্য ইফতারে বরাদ্দ মাত্র ৩০ টাকা।

ষষ্ঠ কাউন্সিলের পর মেয়াদ শেষ হলেও এখনো কাউন্সিল করতে পারেনি দলটি। অনেকে আশায় বুক বেঁধে থাকলেও কেন্দ্রীয় কমিটির সব ফাঁকা পদ পূরণ করতে পারেনি বিএনপি। তবে এর মধ্যে সৌভাগ্যবান হলেন ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও সেলিমা রহমান। ভাইস চেয়ারম্যান থেকে পদোন্নতি দিয়ে গত ১৯ জুন তাদের স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয়।

অনেক সংগঠনের মেয়াদ শেষেও নতুন কমিটি দিতে পারেনি বিএনপি। তবে ২৮ বছর পর নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্রদলের নতুন কমিটি করা হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর মির্জা আব্বাসের শাহজাহানপুরের বাড়িতে নির্বাচন হয়। তবে এর আগে কমিটি নিয়ে বয়স্ক-বিবাহিতদের বিক্ষোভে গত ১১ জুন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা দেওয়া হয়। এ বছর নতুন নেতৃত্ব পায় মহিলা দল। ২০ বছর পর কৃষকদলেও নতুন কমিটি হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি গঠন করা হয় আহ্বায়ক কমিটি।

চিরবিদায় নেন বিএনপির প্রভাবশালী নেতা সাদেক হোসেন খোকা। ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে গত ৪ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যানসার সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তার লাশ ঢাকায় আনার পর ঢাকাবাসী তাকে স্মরণ করে। সাবেক মেয়রের জানাজায় অংশ নেন অগণিত মানুষ।

খোকার মৃত্যুর শোক না কাটতেই সাংগঠনিক কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয় থাকা ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান দল ছাড়ার ঘোষণা দেন। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত ৫ নভেম্বর পদত্যাগপত্র দেন। অন্যদিকে রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমানও।

বছরের নানা সময়ে খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্য ও বিএনপি নেতারা তার সঙ্গে হাসপাতালে সাক্ষাৎ শেষে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, তিনি ধীরে ধীরে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন। তারা জামিন দিয়ে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ চেয়েছেন। যদিও আইনের মারপ্যাঁচে মুক্তি মেলেনি তার। সবশেষে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তার জামিন আবেদন খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ, যা নিয়ে ৫ ডিসেম্বর আদালতে ব্যাপক হট্টগোলও হয়। এতে আইনি প্রক্রিয়ায় তার মুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখে বিএনপি। এখন দলটি আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে।

তবে সারা বছর মাঠে সক্রিয় না থাকলেও গত ২৬ নভেম্বর হাইকোর্টের সামনে আন্দোলনের রূপ দেখায় বিএনপি নেতা-কর্মীরা। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে হঠাৎ এই কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা দিলে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সামান্য সংঘর্ষও হয়। বহুদিন পর এটিই ছিল বিএনপির আন্দোলনের বড় দৃশ্য। পরে অবশ্য অনেকের বিরুদ্ধে এই ঘটনায় মামলাও হয়।

(ঢাকাটাইমস/৩০ডিসেম্বর/বিইউ/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

রাজনীতি এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :