করোনাকালে কমেছে আলোক দূষণ

শেখ মোজাহীদ
  প্রকাশিত : ২৭ জুন ২০২০, ২০:৩৯| আপডেট : ০৭ জুলাই ২০২০, ১৬:৪৯
অ- অ+

আলো ভালো ও শুভ্রতার প্রতীক এবং অন্ধকার কালো ও ভয়ের প্রতীক। এ ভাব নিয়েই মূলত বাংলা সাহিত্যে আলোর মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব বর্ণনা করে অনেক কবিতা, গান, নিবন্ধ ইত্যাদি রচনা করা হয়েছে। কিন্তু এই সময়ে আমাদের আলোর পাশাপাশি সমানতালে অন্ধকারের মাহাত্ম্য ও বর্ণনা করা‌ প্রয়োজন। এ কথা বলছি এ কারণে যে, এখন দূষণ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র বা শ্রেণি হিসেবে আলোক দূষণ (Light Pollution) নামক শব্দটি পৃথিবীর সকল অভিধানে যুক্ত হয়ে গেছে।

আলো যে আশীর্বাদ তাতে সন্দেহ নেই, তবে বর্তমানে আলোক দূষণ যে অভিশাপ হিসেবে হাজির হয়েছে তা অনেকেই মেনে নিচ্ছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে জনসাধারণের মধ্যে পরিবেশ দূষণ তথা পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, মাটিদূষণ, শব্দদূষণসহ বিভিন্ন প্রকার দূষণের সঙ্গে পরিচিত থাকলেও আলোক দূষণের সঙ্গে তেমন পরিচিত নয়। অনেকেই আলোক দূষণকে কোনো প্রকার দূষণই মনে করেন না। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও মানব স্বাস্থ্যের ওপর আলোক দূষণের ক্ষতিকর প্রভাবকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করতে পারি না। বিষয়টি নিয়ে আরও উদ্বেগের কারণ হলো আলোক দূষণ নিয়ে আমাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র সচেতনতা নেই।

আলোক দূষণ যা ইংরেজিতে সাধারণত লাইট পলিউশন (Light Pollution) বা ফটো পলিউশন (Photo Pollution) নামে পরিচিত।‌ আন্তর্জাতিক রাতের আকাশ বিষয়ক সমিতির মতানুসারে, উষ্ণ আকাশ, মাত্রাতিরিক্ত আলো, আলোর অনুপ্রবেশ, বিশৃঙ্খল আলো, রাতের বেলায় অপ্রতুল দৃশ্যমানতা এবং শক্তির অপচয়সহ যেকোনো ধরনের কৃত্রিম আলোর ক্ষতিকর প্রভাবকে আলোক দূষণ বলে। তবে সাধারণত অন্ধকারের সাধারণ ধর্মকে বিনষ্ট করে পরিকল্পনাহীন ও কৃত্রিম আলোর অবৈজ্ঞানিক ব্যবহারকে আমরা আলোক দূষণ নামে অভিহিত করতে পারি।

প্লেটো বলেছিলেন, আঁধারের ভয় পাওয়া শিশুটিকে আমরা সহজেই ক্ষমা করতে পারি। কিন্তু জীবনের ট্রাজেডি তখনই শুরু হয় যখন কেউ আলোকে ভয় পায়। আজকে আমরা এমনই একটা সময়ে অবস্থান করছি যখন জীবনের ট্রাজেডি শুরু হয়ে গেছে আর আমরা আলোকে ভয় পাচ্ছি। আলো জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও অন্ধকার কেউ আমাদের সমান প্রয়োজন। এই কারণেই হয়তো সৃষ্টিকর্তা আলো এবং আঁধারের একটি অপূর্ব সমন্বয় সাধন করেছেন। কিন্তু সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ আজ আলোক প্রযুক্তির অতি ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং অবৈজ্ঞানিক ব্যবহার করে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য কে ধ্বংসাত্মক করে তুলছে।

আলোক দূষণ সম্পূর্ণরূপে কৃত্রিমভাবে মানুষের দ্বারা সৃষ্ট হওয়ায় এর সাথে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কিছু আচার-ব্যবহারের সংযুক্তি রয়েছে। শহরে বড় ভবনে বিজ্ঞাপন প্রচারে ব্যবহৃত বৃহৎ আকৃতির চোখ ধাঁধানো এলইডি মনিটর, আলোকিত বিলবোর্ড, রাস্তায় অপ্রয়োজনীয় স্ট্রিট লাইট, আলোকসজ্জা, খেলার মাঠের তীব্র শক্তির লাইট, বাসা বাড়ির জানালা থেকে নির্গত আলো, গাড়ির হেডলাইট, অফিস ও কলকারখানায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত আলোর ব্যবহার এবং সর্বোপরি দৃষ্টি বিজ্ঞানের আলোকে আলোর নকশা না করা ইত্যাদির মাধ্যমে সাধারণত আলোক দূষণ ঘটে থাকে।

আলোক দূষণের কারণে আমরা রাতের আকাশের সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছি। শহুরে মানুষ কবে রাতের আকাশে ছায়াপথে নক্ষত্রের পতন কিংবা উল্কাবৃষ্টি দেখেছে তা কি মনে করতে পারে। রাতের বেলা খোলা আকাশের নিচে জোসনার খেলা আর জোনাকীর লুটোপুটি কখন যেন ভুলতে বসেছি। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় এবং মানব মনের ও মননের স্বাস্থ্য সুরক্ষায়। প্রাণিজগতের অন্যান্য অনেক প্রজাতি আলোক দূষণের কারণে আজ মারাত্মক হুমকির মুখে। বিশেষ করে নিশাচর বন্যপ্রাণী এবং অনেক কীটপতঙ্গের স্বাভাবিক দৈহিক কার্যকলাপ ও আচরণ আলোক দূষণ দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত হয়।

এ সকল প্রাণীর প্রজনন, পুষ্টি এবং আত্মরক্ষার কৌশল পুরোপুরিভাবে আলো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পেচা, বাদুড়, ইঁদুর, সাপ, সামুদ্রিক কাছিম, পরিযায়ী পাখি ইত্যাদি প্রাণী প্রজাতিগুলো আলোক দূষণ ধারা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাতে আলোক দূষণের কারণে মানুষের ঘুমের মারাত্মকভাবে ব্যাঘাত ঘটে যা অনিদ্রা সৃষ্টি করতে পারে। এই কারণে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়াসহ নানা রকম অসুখ বিসুখে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

বর্তমানে পৃথিবীতে আলোক দূষণ নিয়ন্ত্রণে অনেকগুলো সংগঠন কাজ করছে। বেশ কয়েকটি দেশেও সরকারিভাবে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। আমেরিকাতে আলোক দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৮৮ সালে গঠন করা হয় ইন্টারন্যাশনাল ডার্ক স্কাই অ্যাসোসিয়েশন। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো গঠন করেছে সেভ ডে নাইট ইন ইউরোপীয় ইউনিয়ন। অস্ট্রেলিয়ায় আলোর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে সমস্ত পরিচিত রুট ব্যবহার করে পরিযায়ী পাখিরা চলাচল করে সেখানে রাতের বেলায় তাদের চলাচল নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করার উদ্দেশ্যে আলোর ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশসহ অনেকগুলো দেশে সামুদ্রিক কাছিমের ডিম পাড়া নির্বিঘ্ন করতে এবং ডিম থেকে সদ্য বের হওয়া কাছিমের বাচ্চার সমুদ্র অভিমুখে চলাচল নিশ্চিত করতে সৈকতে অবাঞ্চিত ও অনিয়ন্ত্রিত আলোর ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছে।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে সামাজিক অর্থনৈতিকসহ সকল প্রকারের কর্মকাণ্ড কোভিড-১৯ জনিত সৃষ্ট মহামারির কারণে সীমিত হয়ে পড়ায় অন্যান্য দূষণের ন্যায় আলোক দূষণের উপরও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ইতিমধ্যে সমগ্র বিশ্ব এ বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেছে। আলোক দূষণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসায় প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের অনেক ইতিবাচক খবর বিভিন্ন প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় আমরা দেখেছি। নিশাচর বন্যপ্রাণী এখন স্বাচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায় প্রকৃতির কোলে। সামুদ্রিক কাছিম নির্বিঘ্নে ডিম দিয়ে ফিরে যায় সমুদ্রে। কীটপতঙ্গের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে এসেছে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন। তাই সুস্থ পরিবেশ রক্ষায়, সংরক্ষণে ও উন্নয়নে অন্যান্য দূষণের পাশাপাশি আলোক দূষণ নিয়ন্ত্রণের এখনই সময়।

লেখক: পরিদর্শক, পরিবেশ অধিদপ্তর

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
পানির নিচে কৃষকের স্বপ্ন
গাজায় ঈদের দ্বিতীয় দিনেও ইসরায়েলি হামলা, নিহত ৭৫
যুক্তরাজ্য সফরে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা 
ঈদের নামাজ নিয়ে বিরোধ, সন্ত্রাসী হামলায় বিএনপি কর্মী নিহত
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা