করোনাকালে মন ভালো রাখতে চিকিৎসকদের যত পরামর্শ

মহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যেই আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে মনোরোগ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এখন আশঙ্কা করছে মনোরোগ মহামারির৷ করোনাকালে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, একাকিত্ব, অবসাদ যে হারে বাড়ছে, তা রীতিমতো ভয় জাগিয়েছে তাদের মনে৷
গৃহবন্দি অবস্থায় আতঙ্কের সঙ্গে থাকতে থাকতে মনের সব প্রতিরোধ ভেঙে গেলে, বিশেষ করে যারা এমনিই উদ্বেগপ্রবণ বা অন্য মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, কী হবে তাদের অবস্থা! এত মনোরোগীর চাপ সামলানো যাবে! এই আশঙ্কা করেছেন ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের বিজ্ঞানীরা৷ ইমারজিং ইনফেকসাশ ডিজিজ নামের জার্নালে তারা জানিয়েছেন, যদিও প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ মনের জোরে এই বিপদ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন, বাকিরা পারছেন না৷ অবিলম্বে এদিকে নজর না দিলে বিপদ ঘটতে পারে৷
ইন্ডিয়ান সাইকিয়াট্রিক সোসাইটির এক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, করোনা আসার পর মনোরোগ বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ৷ অর্থাৎ পাঁচজন ভারতীয়র মধ্যে একজন ভুগছেন মানসিক সমস্যায়!
কেন এমন?
‘এ রকমই তো হওয়ার কথা৷ রাতারাতি জীবন পাল্টে যাচ্ছে, পাল্টে যাচ্ছে সম্পর্কের মানে৷ রোগ হলে কী হবে কেউ জানে না৷ ভবিষ্যতে কী হবে কেউ জানে না৷ এ রকম অনিশ্চয়তার মুখে দুর্বল মনের মানুষ তো অসুস্থ হয়ে পড়বেনই৷’ জানালেন মনোরোগ চিকিৎসক গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়৷
শুরুতে কিন্তু পরিস্থিতি এ রকম ছিল না৷ করোনা নিয়ে হাসি-মজা হতো৷ ভাবা হতো চীনেরা সাপ-ব্যাঙ খায় তাই তাদের রোগ হয়েছে৷ আমাদের হবে না৷ কিন্তু হলো৷ একটু একটু করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল রোগ৷ এসে দাঁড়াল আমাদের দরজাতেও৷
তখনও সবাই ভাবছে, আমাদের ইমিউনিটি বেশি তাই আমাদের কিছু হবে না৷ সে যুক্তিও ধোপে টিকল না৷ হু হু করে বাড়তে লাগল রোগ৷ ঘোষিত হলো মহামারি৷ অতিমারি৷ মানতেই হলো যে বিপদ এসেছে ৷ কাটল ডিনায়াল ফেজ৷
এবার হলো রাগ৷ বিনা দোষে শাস্তি পেলে যেমন হয়, তেমন ৷ মনে হলো ষড়যন্ত্র হয়েছে৷ ল্যাবরেটরিতে ভাইরাস বানিয়ে কেউ ছড়িয়ে দিয়েছে৷ প্রথমে রাগ পড়ল চীনের ওপর৷ তারপর ট্রাম্পের ওপর৷ এরপর বিদেশ থেকে আসা মানুষ, অন্য রাজ্যের মানুষ, এমনকী ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরাও বাদ পড়লেন না৷ থালা বাজিয়ে কৃতজ্ঞতা জানানোর পরদিনই ডাক্তার-নার্সদের পাড়া ছাড়া করার নোটিশ ধরিয়ে দেওয়া হল৷
তাতেও কিছু হলো না৷ বোঝা গেল দোষ-গুণ খুঁজে লাভ হবে না কোনো৷ তখন শুরু হল তাকে ঠেকানোর প্রচেষ্টা৷ মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বার্গেনিং ফেজ ৷ একদল ভগবানের কাছে হত্যে দিয়ে পড়লেন, আর যুক্তিবাদী মুক্তমনারা বিশ্বাস রাখলেন বিজ্ঞানে৷ হাত ধোওয়া, মাস্ক পরা, সবার থেকে দূরে থাকার নিয়মগুলো মানতে শুরু করলেন৷ পরিচারিক, সহকর্মী, প্রতিবেশী, সবাই দূরে সরে গেলেন৷ ঘরের মানুষদের সঙ্গেও বাড়ছে দূরত্ব৷ চেনা দুনিয়া পাল্টে গিয়েছে ক-দিনেই৷ গ্রাস করেছে অস্তিত্বের সংকট৷
একে একে বন্ধ হয়ে গেল মন্দির, মসজিদ, গির্জা৷ আবার কিছু জায়গায় বিধি মেনে তা খুলেছে। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলেছে ক্রমাগত ৷ তাকে ঠেকানোর অনিবার্য রাস্তা বার বের করতে চেষ্টা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা৷
মাস্ক, সাবান, দামী স্যানিটাইজার ব্যবহারের সঙ্গে কেউ আবার ডাক্তারদের বারণ না শুনে খেতে শুরু করেছেন হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন৷ কেউ ভাবলেন, বিসিজি নেওয়া আছে বা ম্যালেরিয়া হয়েছে বলে যদি বাঁচা যায়৷ আরেকটু গরম পড়লে যদি ভাইরাস মরে, এমনও ভেবেছেন কেউ কেউ।
তবে ভাইরাস রয়েছে ভাইরাসের মতো৷ মতিগতি কিছু বোঝা যাচ্ছে না তার৷ আর আক্রান্ত ও মৃতর ক্রমবর্ধমান গ্রাফ দেখে হতাশা গ্রাস করেছে। গ্রাস করেছে অবসাদ।
এবার তাহলে কী? অবসাদ কমানোর ওষুধ না অন্য কিছু? কী পরামর্শ দিচ্ছেন মনোচিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম৷
তার কথায়, ভালো করে বুঝতে হবে, একটা সংকটের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি৷ কী তার পরিণতি কেউই জানি না৷ কাজেই অহেতুক ভেবে লাভ নেই৷ বেশি ভাবলে মানসিক অশান্তি হবে৷ তার ছায়া পড়বে পরিবারে৷ এখন এই একজোট হয়ে থাকার সময়, সবাইকে অশান্ত করে তোলা কোনও কাজের কথা নয়৷ অসুখের প্রকোপও বাড়বে তাতে৷ কারণ এটা পরীক্ষিত সত্য যে মানসিক চাপ বাড়লে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে৷
১. দিনে একঘণ্টার বেশি খবর দেখবেন না যদি মনে তা প্রভাব ফেলে৷ আগে যেভাবে কাজকর্ম করে, বই পড়ে বা সিনেমা-সিরিয়াল দেখে সময় কাটাতেন, এখনও সেভাবে কাটানোর চেষ্টা করুন৷
২. কীভাবে সময় কাটাবেন বুঝতে না পারলে হিসেব করে দেখুন, ক-ঘণ্টা বেশি সময় পাচ্ছেন৷ এই সময়টা কীভাবে ভরাট করা যায় দেখুন৷ একটু হয়তো ব্যায়াম করলেন, ঘরের কাজ করলেন, বই পড়লেন কি সেরে নিলেন বকেয়া কাজ৷
৩. নতুন শখ তৈরি করা বা সৃজনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার এটাই আদর্শ সময়৷ আদর্শ সময় সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দেওয়ার৷ পুরোনো সম্পর্কগুলো ঝালিয়ে নিন৷ যে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গিয়েছিল, উদ্যোগ নিয়ে তাকে ভাল করা যায় কিনা দেখুন৷ ভালকে করে তুলুন আরও ভাল৷ সময় কেটে যাবে৷
৪. ভবিষ্যত ভেবে আতঙ্কিত হয়ে লাভ নেই৷ সারা পৃথিবীর ভবিষ্যতই এখন অনিশ্চিত৷ যতই ভাবুন কূলকিনারা পাবেন না৷ কাজেই আজকের দিনটা কতটা সুন্দর, কতটা কার্যকর করে তোলা যায়, ভাবুন তা নিয়ে৷ কালকের কথা কাল ভাববেন৷
৫. এভাবে তখনই ভাবতে পারবেন, যখন জীবনের ভাল দিকগুলি দেখার চোখ ও মন তৈরি করতে পারবেন৷ চাহিদা কমাতে পারবেন৷ আকাশচুম্বী চাহিদা মুহূর্তে ধূলিস্যাৎ করেছে করোনা। এখন কী হবে না হবে সেই নিয়ন্ত্রণও প্রকৃতিরই হাতে ৷
৬. আসল কথা হলো, এই মুহূর্তটুকু ছাড়া আর কিছুই আমাদের হাতে নেই৷ কাজেই যা হাতে আছে, তাকে সুন্দর করে গড়ে নিতে হবে৷ যা নেই তার জন্য হা-হুতাশ করা বন্ধ করতে হবে।
৭. দুশ্চিন্তার আগে ভেবে দেখুন, এ রকম অতিমারি আগেও এসেছে৷ মানুষ তা অতিক্রমও করেছে৷ এই মহামারিও সেভাবে অতিক্রান্ত হয়ে যাবে৷ এখন বরং চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক বেশি উন্নত ৷ জীবাণুটিও যতটা ছোঁয়াচে, ততটা মারক নয় ৷ কাজেই এই হঠাৎ পাওয়া ছুটি ভাল করে উপভোগ করতে হবে৷
৮. সব কিছু করেও যদি মনে হয় সামলাতে পারছেন না, মনোবিদের পরামর্শ নিতে হবে৷ চিকিৎসকের সাহায্যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন করে বাঁচতে শিখে যাবেন আপনি৷ সামান্য কিছু ক্ষেত্রে হয়তো ওষুধ দিতে হতে পারে৷
আগলে রাখুন বয়স্কদের
বয়স্কদের কোভিডের আশঙ্কা বেশি, সুগার-প্রেশার-হৃদরোগ ইত্যাদি থাকলে আরও বেশি, এ সব আমরা যেমন জানি, তাঁরাও জানেন৷ শুনছেন প্রতিনিয়ত। ফলে বাড়ছে দুশ্চিন্তা৷ রোগ হলে কোথায় যাবেন, কী করবেন, কাকে ডাকবেন? এ এমন রোগ, কাউকে তো পাশে পাওয়া যাবে না! অ্যাম্বুলেন্স ডাকলে কি আসবে? বাড়ির লোকেদেরও তো বিপদ। ছেলে-মেয়ে বিদেশে, ঘরে স্রেফ বয়স্ক দুটি মানুষ, একজন রোগে পড়লে অন্যজনকে কে দেখবে?
রোগী নিয়ে ছুটোছুটিই বা করবে কে? একা থাকলে তো হয়েই গেল৷ বাজার করতে, পেনশন তুলতে কি ওষুধ কিনতে বাইরে যাওয়া ছাড়া গতি নেই, তখন যদি সংক্রমণ হয়! তারপর একা হাতে ঘরের যাবতীয় কাজ।
‘এমনিতেই বয়স্ক মানুষের মধ্যে শতকরা ২০ জন অবসাদে ভোগেন৷ একাকীত্ব, উদ্বেগ, অসহায়তা মিলেমিশে থাকে তাঁদের মধ্যে৷ কোভিডের আতঙ্কে ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তা এক ধাক্কায় বেড়ে গেছে৷ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গার্হস্থ্য হিংসা৷ বাড়ির লোকেদেরও তো মাথার ঠিক নেই৷ টেনশন ও অসহায়তার শিকার তাঁরাও৷ ফলে সামান্য ঠোকাঠুকিতেই বড় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে৷ মানসিক ও শারীরিকভাবে আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন বয়স্করা’, এমনই জানালেন মনোচিকিৎসক গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়৷
সমাধান
পরিস্থিতির গুরুত্ব যারা বুঝছেন, তাদের দুশ্চিন্তা হবেই৷ অর্থবল, লোকবল না থাকলে আরও হবে৷ তার উপর যদি দিন-রাত কানের কাছে ঝুঁকি বেশি বলা হতে থাকে, উদ্বেগপ্রবণ মানুষের পক্ষে সে চাপ নেওয়া খুব কঠিন, যদি না তিনি নিজে ও তাঁর আপনজনেরা বিশেষ সতর্ক থাকেন৷
এ ক্ষেত্রে যা বোঝাতে হবে
১. প্রথমেই বুঝে নিতে হবে যে ঝুঁকি বেশি থাকলেও এই মুহূর্তে সাবধানে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই৷ বয়সটাকে নিয়ে তো আর কিছু করা যাবে না, অন্য আর যা যা রোগভোগ আছে, তাদের সামলে রাখতে হবে৷
২. ওষুধপত্র খেতে হবে নিয়ম করে৷ ওষুধের জোগান যেন ঠিক থাকে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে৷ ঠিক সময়ে ঠিকঠাক খাবার খেতে হবে৷ শরীর ঠিক থাকলে, মনও হালকা থাকবে৷
৩. ঘুম ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে৷ এক-আধদিন না হলে বা কম হলে সমস্যা নেই৷ কিন্তু দিনের পর দিন না হলে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে৷ কারণ ভাল ঘুম হল দুশ্চিন্তার অব্যর্থ দাওয়াই৷
৪. নতুন করে যাতে চিন্তা না বাড়ে, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে৷ চারদিকে তো এখন কোভিড ছাড়া কথা নেই৷ কিন্তু যারা উদ্বেগ সহ্য করতে পারেন না, তাঁদের জন্য এ রকম পরিস্থিতি মারাত্মক৷ কাজেই ঘরে এ সব আলোচনা করবেন না৷ তবে বয়স্ক মানুষের মনে কোনও প্রশ্ন জাগলে তিনি যাতে উত্তর পান সে দিকে খেয়াল রাখুন৷ একেবারে কিছু না জানালেও কিন্তু দুশ্চিন্তা বাড়ে৷ কাজেই ভারসাম্য মেনে চলুন৷
৫. হাত ধোওয়া, একটু দূরে দূরে থাকা ও বাইরে বেরোলে মাস্ক পরার যে নিয়ম আছে, তা মেনে চলুন সবাই৷ বয়স্ক মানুষটিকে বোঝান যে এ সব মানলেই বিপদ কমবে৷
৬. সকাল-সন্ধ্যা ছাদে একটু হাঁটাহাটি, হালকা দু-একটা স্ট্রেচিং বা যোগাসন করতে পারলে ভাল৷ কখন কী করা যেতে পারে তার একটা রুটিন করে নিতে হবে৷ ভাল লাগুক না লাগুক যখন যা করার কথা তা মোটামুটি মেনে চলতে হবে৷ নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলে চিন্তা কম হবে৷
৭. অসুখ হলে কোথায় যেতে হবে, কী করতে হবে, সে সব খবরও একটু নিয়ে রাখবেন, যদি দরকার হয়, তখন যাতে হাতড়ে বেড়াতে না হয়৷
৮. যারা সারাজীবন সব নিয়ন্ত্রণ করে এসেছেন, তাদের পক্ষে এই অসহায়তা মেনে নেওয়া কঠিন৷ তাঁদের বোঝাতে হবে যে পৃথিবীর তাবড় তাবড় মানুষও তার মতো অবস্থায় আছেন এখন৷ জীবাণুর মেজাজ-মর্জি বুঝতে পারছেন না কেউই৷ সূত্র: আনন্দবাজার
(ঢাকাটাইমস/২০জুলাই/জেবি)

মন্তব্য করুন