বাংলাদেশে তথ্য পাওয়ার আইনগত অধিকার

বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১ (এক) অনুযায়ী দেশটির নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। অনুচ্ছেদ ৭ (সাত) এর ভাষ্য- ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে এবং জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।’
আবার, অনুচ্ছেদ, ৩৯ (উনচল্লিশ) দেশের জনগণের মৌলিক অধিকারের অংশ হিসেবে তাদের ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করেছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করেছে।’
এখানে বলে রাখা ভালো যে, যেহেতু এটি মৌলিক অধিকার, সেহেতু আমাদের সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘মৌলিক অধিকারের বিধানাবলীর সহিত অসমঞ্জস সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।’ আবার এও বলা হয়েছে যে, ‘রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসমঞ্জস কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।’
এখন দেখা যাক, 'তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯' পাশের উদ্দেশ্যে কী বলা হয়েছে-
‘যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে চিন্তা, বিবেক ও বাক-স্বাধীনতা নাগরিকগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত এবং তথ্য প্রাপ্তির অধিকার চিন্তা, বিবেক ও বাক-স্বাধীনতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ; এবং যেহেতু জনগণ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক ও জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক; এবং যেহেতু জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা হইলে সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারী ও বিদেশী অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারী সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাইবে, দুর্নীতি হ্রাস পাইবে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হইবে; এবং যেহেতু সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারী ও বিদেশী অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারী সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়।’
সেহেতু বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ সংসদে পাস করেছে, যা এখনো বলবত। এই আইনের ধারা ২(খ) অনুযায়ী ‘কর্তৃপক্ষ’ অর্থ –
(অ) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সৃষ্ট কোন সংস্থা;
(আ) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৫(৬) অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত কার্য বিধিমালার অধীন গঠিত সরকারের কোন মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা কার্যালয়;
(ই) কোন আইন দ্বারা বা উহার অধীন গঠিত কোন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান;
(ঈ) সরকারী অর্থায়নে পরিচালিত বা সরকারী তহবিল হইতে সাহায্যপুষ্ট কোন বেসরকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান;
(উ) বিদেশী সাহায্যপুষ্ট কোন বেসরকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান;
(ঊ) সরকারের পক্ষে অথবা সরকার বা সরকারী কোন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের সহিত সম্পাদিত চুক্তি মোতাবেক সরকারী কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন বেসরকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান; বা
(ঋ) সরকার কর্তৃক, সময় সময়, সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে বুঝাবে।’
ধারা ২ (চ) অনুযায়ী ‘তথ্য’ অর্থ কোন কর্তৃপক্ষের গঠন, কাঠামো ও দাপ্তরিক কর্মকান্ড সংক্রান্ত যে কোন স্মারক, বই, নকশা, মানচিত্র, চুক্তি, তথ্য-উপাত্ত, লগ বহি, আদেশ, বিজ্ঞপ্তি, দলিল, নমুনা, পত্র, প্রতিবেদন, হিসাব বিবরণী, প্রকল্প প্রস্তাব, আলোকচিত্র, অডিও, ভিডিও, অংকিতচিত্র, ফিল্ম, ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়ায় প্রস্তুতকৃত যে কোন ইনস্ট্রুমেন্ট, যান্ত্রিকভাবে পাঠযোগ্য দলিলাদি এবং ভৌতিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য নির্বিশেষে অন্য যে কোন তথ্যবহ বস্তু বা উহাদের প্রতিলিপিও ইহার অন্তর্ভুক্ত।’
উক্ত তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ এর ৩ ধারার বিধান হচ্ছে যে ‘প্রচলিত অন্য কোন আইনের তথ্য প্রদান সংক্রান্ত বিধানাবলী এই আইনের বিধানাবলী দ্বারা ক্ষুণ্ন হইবে না; এবং তথ্য প্রদানে বাধা সংক্রান্ত বিধানাবলী এই আইনের বিধানাবলীর সহিত সাংঘর্ষিক হইলে, এই আইনের বিধানাবলী প্রাধান্য পাইবে৷’
উক্ত আইনের ধারা ৪ এর বক্তব্য যথা-‘এই আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে, কর্তৃপক্ষের নিকট হইতে প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য লাভের অধিকার থাকিবে এবং কোন নাগরিকের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাহাকে তথ্য সরবরাহ করিতে বাধ্য থাকিবে৷’
এখন দেখা যাক জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১ (২০১১ সনের ৭ নং আইন ) প্রনয়নের উদ্দেশ্য ও বিধান কি?
উক্ত আইনের শুরুতে বলা হয়েছে যে, ‘যেহেতু জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশকারীকে আইনগত সুরক্ষা প্রদান এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়" বিধায় উক্ত আইন প্রনয়ন করা হলো। আইনের ধারা ৩ ও আবার এই আইনের বিধানবলীকে প্রাধান্য দিয়েছে, যথা- ‘আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধানাবলী প্রাধান্য পাইবে।’
ধারা ৪ বলছে যে ‘জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশকারী উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিকট, যুক্তিযুক্ত বিবেচনায়, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সঠিক তথ্য প্রকাশ করিতে পারিবেন। এবং কোন তথ্য প্রকাশকারী, এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সঠিক তথ্য প্রকাশ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।’ এও বলা হয়েছে যে, উল্লিখিত ‘কোন তথ্য, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিকট, লিখিতভাবে, সরাসরি হাতে হাতে, ডাকযোগে বা যে কোন ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা যাইবে।’
উপরোক্ত সকল আইন ও আইনের বিধানাবলী স্বচ্ছ এবং সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে ও জনগনের কল্যানে এবং রাষ্ট্রের ও সরকারের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চাকুরী সংক্রান্ত নিরাপত্তা বিধানকল্পে করা হয়েছে।
এখন আসা যাক, 'Official Secrects Act, 1923' বা 'দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন ১৯২৩' এর বিধান পর্যালোচনায়। ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন যখন তুঙ্গে ঠিক তখন এ আইনটি সমগ্র ভারতবাসীদের ওপর ব্রিটিশরা চাপিয়ে দেয় যা নির্যাতনমূলক বললেও কম বলা হবে। আবার পাকিস্তান ১৯৫৬ সনে আইনটির সংশোধন করে। উক্ত আইনটির ধারা ৩ ও ৩ (ক) অনুযায়ী গুপ্তচর বৃত্তি ও রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কাজের উদ্দেশ্যে যদি কেউ রাষ্ট্রের কোন নিষিদ্ধ স্থানে প্রবেশ করে, যাতায়াত করে কিংবা কোন ডকুমেন্টস নিয়ে গিয়ে শত্রুকে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে প্রকাশ করে তবে তার ১৪ বছর কারাদণ্ড হবে। তবে রাষ্ট্রকে দেখাতে হবে যে, ঐ ব্যক্তির উদ্দেশ্য ছিলো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্বার্থের পরিপন্থী। উক্ত আইনের ৩ (ক) ধারায় বলা হয়েছে যে, আইন দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয়েছে এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও জিনিসের কোন ছবি বা ডকুমেন্টস সরকারের অনুমতি ব্যতীত গ্রহন করা যাবে না। আমরা মাঝে মধ্যে এরকম স্থান ও স্থাপনা দেখতে পাই। যেমন, জাতীয় প্রকাশনা অধিদপ্তর এলাকা। এখানে লেখা থাকে, Key Point Installation বা সংরক্ষিত এলাকা। সচিবালয়ও কি সংরক্ষিত এলাকা?
তথ্যের অবাধ প্রবাহের এ যুগে শুধু বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪৫ ক অনুচ্ছেদ অনুসারে ‘বিদেশের সহিত সম্পাদিত সকল চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন। তবে শর্ত থাকে যে, জাতীয় নিরাপত্তার সহিত সংশ্লিষ্ট অনুরূপ কোন চুক্তি কেবলমাত্র সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করা হইবে।’
সমসাময়িক সময়ে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের দায়ের করা অফিসিয়াল সিক্রেটস এক্টস, ১৯২৩ ও দন্ড বিধিতে বর্নিত চুরির অভিযোগে করা মামলাটিতে অভিযোগ এই যে, চীন রাশিয়ার সাথে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সম্ভাব্য চুক্তির ডকুমেন্টস স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে ঢুকে তিনি চুরি করেছেন। দেখতে হবে যে, এখানে সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত শর্তসমূহ যথা 'রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থবিরোধী' কিছু আছে কিনা এবং ১৪৫ ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই চুক্তিগুলো সংসদে পেশ করার কথা কিনা। এখানে যুদ্ধবিমান কিংবা অস্ত্র কেনার চুক্তি হচ্ছে না। টিকা বা ভ্যাক্সিন জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য কেনা হচ্ছে। এটা জনস্বার্থ রক্ষা করছে। এ ধরনের চুক্তির তথ্য পাবার অধিকার তথ্য অধিকার আইনের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট উল্লেখ আছে এবং যারা তথ্য দিবেন তাদের সুরক্ষা, ২০১১ সনের আইনে দেওয়া আছে। সংবিধান যদি সংবাদপত্র তথা মিডিয়ার স্বাধীনতা মৌলিক অধিকার হিসেবে দিয়ে থাকে এবং মৌলিক অধিকারের সাংঘর্ষিক কোন আইন যদি বাতিল বলিয়া গন্য হয় আর উক্ত সংবিধানের পরিপূরক আইন যদি হয় 'তথ্য অধিকার আইন-২০০৯' এবং সে আইনের প্রাধান্য অপর যেকোন আইনের ওপর দেওয়া থাকলে তথ্য পাওয়ার অধিকার টিকে থাকবে। সে যেভাবেই পেয়ে থাকেন কি না।
কেউ প্রবেশের অনুমতি না দিলে সাংবাদিক রোজিনা কোন রুমে প্রবেশ করতে পারেন নাই এবং কেউ সরকারি নথি ফটোকপি কিংবা ছবি তুলে না আনতে দিলে তিনি আনতে পারতেন না। আর এগুলো গোপনীয় তথ্য ও দলিল নয়। এগুলো জনসাধারনের নিকট প্রকাশ পাবে তত সরকার তথা নির্বাহী বিভাগের স্বচ্ছতা বাড়বে। প্রশ্ন হচ্ছে কেন তারা এগুলোতে ভীত? যদি সব প্রকাশ পায় তাহলে কানাডার বেগমপাড়া গড়ে তোলা বাড়ি-ঘরের তথ্য মানুষ জেনে যাবে।
আমরা অন্ধকার যুগে থাকতে চাই না। রাষ্ট্রের ক্ষতি না করে সকল তথ্য জানতে চাই। এটা কোন দয়া নয় দেশের সকল নাগরিক তথা জনগনের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

মন্তব্য করুন