নৌকা-ধানের শীষে ভোটে লড়েছেন, তারা ছিলেন ছাত্রলীগের সভাপতি

তুখোড় বক্তা ফজলুর রহমান ইটনা-মিঠামইন, অষ্টগ্রাম থেকে ভোটে লড়তে চাইলেও ‘৮৬ তে আওয়ামী লীগ তাকে পার্শ্ববর্তী হোসেনপুর-পাকুন্দিয়া থেকে মনোনয়ন দেয়। সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন তিনি। কিন্তু বরাবরই মন পড়ে থাকে তার তৎকালীন সংসদ সদস্য আবদুল হামিদ, বর্তমান রাষ্ট্রপতির আসনে। এভাবে এক পর্যায়ে দলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে। পরবর্তীকালে মনোনয়ন বঞ্চিত হন। এক পর্যায়ে কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে দল গঠন করেন ও পরে বিএনপিতে যোগ দেন।
ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয়। ডাকসু ভিপি হয়েছিলেন। ‘৯৬ তে হয়েছিলেন সংসদ সদস্য, পরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।
এক-এগারোর পরে ছিটকে পড়েন। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণফোরামের কোটায় ধানের শীষ প্রতীকে সংসদ সদস্য হন।
৯০’র অভ্যুত্থানের অন্যতম জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব। ‘৯১ তে নৌকায় নির্বাচন করলেও হেরে যান। ‘৯৬ এ যোগ দেন বিএনপিতে।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের এই তিন সভাপতি নৌকা এবং ধানের শীষ দুই প্রতীকেই ভোটে লড়েছেন। প্রত্যাশিত মূল্যায়ন না হওয়ায় নৌকা ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন বিএনপি ও গণফোরামে। কারো প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। কেউ পাননি কাঙ্ক্ষিত সাফল্য।
কেমন আছেন এখন ফজলুর রহমান? জানতে চাইলে রবিবার দুপুরে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ভালো আছি সব মিলে।’ রাজনীতিতে সক্রিয়তার বিষয়ে বললেন, ‘মাথায় আমি রাজনীতি করি। কাজে আইন পেশা। এক কথায় মাথা থাকে রাজনীতিতে, দেহ ওকালতিতে।’
দেশে বর্তমানে সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ নেই উল্লেখ করে সাবেক এই ছাত্রনেতা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শের যে রাজনীতি আমি করতাম, তা এখন আর নেই।’ আওয়ামী লীগে কখনো ফিরবেন কি না, জানতে চাইলে হেসে জবাব দেন তিনি। বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে যে রাজনীতি নিয়ে সারাদেশে চষে বেড়িয়েছি তা কি আর এখন আছে? এখন তো রাজনীতি নেই।’
এখনো মুজিব কোর্ট গায়ে জড়িয়ে রাখেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। মনেপ্রাণে বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের আদর্শকেই ধারণ করেন, জানান সে কথাও। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি দিয়েই রাজনীতি শুরু। এখনো সেই আদর্শই মনেপ্রাণে ধারণ করি। আওয়ামী লীগে পদ না থাকলেও আমি তো আওয়ামী লীগ ঘরানার লোকই। সংসদে গত তিন বছরে আমার বক্তৃতা শুনলে তা স্পষ্ট হবে।’
গণফোরামের কোটায় ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রসঙ্গে বললেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের মূল লক্ষ্য ছিল বাহাত্তরের সংবিধান। একটা সংবিধানই তো আছে বঙ্গবন্ধুর লেখা। সেই সংবিধানে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি তখন ছিল বলেই নির্বাচনে গিয়েছি।’
আওয়ামী লীগে কখনো ফিরবেন কি না? জবাবে সুলতান মনসুর বললেন, ‘এটি নির্ভর করছে আমাদের প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যার ওপর। আমি তো বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির বাইরে কোথাও যায়নি।’
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব। বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। সময় কীভাবে কাটছে জানতে চাইলে বলেন, ‘দলের কেন্দ্রীয় সভাগুলোতে উপস্থিত থাকি। প্রেসক্লাবে কোনো সভায় আমন্ত্রিত হলে যাই। এছাড়া নিয়মিত টিভি টকশোতেও কথা বলি।’
রাজপথের সভা-সমাবেশ না থাকলেও জনসেবার মাধ্যমে রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন বলে জানান হাবিব। বলেন, ‘আমি কোনো এমপি, মন্ত্রী কিছুই ছিলাম না। তারপরও এই করোনার মধ্যে ব্যক্তিগত অর্থায়নে পাবনায় ৩০ লাখ টাকার ত্রাণ বিতরণ করেছি। আমার দেখাদেখি আরও অনেকে এগিয়ে এসেছেন। জনসেবার ব্রত নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছিলাম, এখনো সেই পথেই আছি।’
ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের ফেরার কোনো ইচ্ছে আছে কি না, জানতে চাইলে বলেন, ‘না, কোনো ইচ্ছে নেই। তা না হলে অনেকবার সুযোগ এসেছে। আমি ফিরে যাইনি। আমি যখন বিএনপিতে যোগ দিই, তখন বিএনপি কিন্তু ক্ষমতায় ছিল না। সেই যে কোনো লোভে বিএনপিতে এসেছি তাও না। এখনো আমি বাসে চড়ি, পায়ে হেঁটে পথচলি। বাকি জীবনটাও সাদামাটাভাবেই কাটাতে চাই।’
সাংসদ হতেই বিএনপিতে গিয়েছিলেন ফজলুর রহমান?:
পঁচাত্তরের পর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন ওবায়দুল কাদের ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বাহলুল মজনুন চুন্নু। এরপরে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসেন ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এবং খ ম জাহাঙ্গীর। তাদেরও দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান হয়নি। তবে ওই সময়ে ছাত্রলীগের একটি বিদ্রোহী কমিটি হয়। এ কমিটির সভাপতি ছিলেন ফজলুর রহমান।
একাত্তরে স্বাধীনতা সংগ্রামেও অংশ নেন ফজলুর রহমান। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দুঃসময়ে ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে সারাদেশে শিক্ষাঙ্গন চষে বেড়ান তিনি। জেলা থেকে নগরে তার অনলবর্ষী আবেগ ও যুক্তিনির্ভর বক্তৃতায় ছাত্রছাত্রীদের ছাত্রলীগের পতাকাতলে টেনেছিলেন। '৮৬-এর নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে কিশোরগঞ্জ-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। '৯৬ সালের নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বর্তমান রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেড় হাজার ভোটে হেরে যান। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগেরও সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন তিনি। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে জনতা লীগের প্রার্থী হিসেবে ভোটের লড়াইয়ের নামলেও জয়ের দেখা পাননি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে যোগ দেন বিএনপিতে। নবম ও একাদশ জাতীয় সংসদ (২০১৮) নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে কিশোরগঞ্জ-৪ আসন থেকে ভোটে লড়াই করে হেরে যান। ছিলেন কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি। বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এবং জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সদস্য সচিব।
যেভাবে আওয়ামী লীগ থেকে ছিটকে পড়লেন সুলতান মনসুর:
বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৬৮সালে পূর্ব পাকিস্থান ছাত্রলীগে যোগ দেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। তৎকালীন মৌলভীবাজার জেলার অন্যতম বৃহৎ মাধ্যমিক বিদ্যালয় মৌলভীবাজার বহুমূখি উচ্চ বিদ্যালয়ে স্কুল ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হন। অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। ১৯৭২সালে সিলেট এম সি ইন্টারমেডিয়েট কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি, ১৯৭৫ সালে সিলেট মদনমোহন কলেজ ছাত্র সংদের ভিপি হন সুলতান মনসুর। সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকও হয়েছিলেন তিনি। ১৯৮৫ সালে সভাপতি হন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে। এই পদে ছিলেন ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত।
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৮৯ সালে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে তিনিই প্রথম ভিপি নির্বাচিত হন। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলনেও অগ্রণী ভূমিকা রাখেন তিনি। ১৯৯১ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে মৌলভীবাজার ২ (কুলাউড়া) আসন থেকে নির্বাচন করে পরাজিত হন। পরে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে একই আসন থেকে সংসদ সদস্য হন তিনি। ২০০১ সালের ভোটে ফের হেরে যান ছাত্রলীগের সাবেক এই সভাপতি। ২০০২ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয় তাকে। ১/১১’তে বদলে যায় রাজনৈতিক পট। ওই সময়ই আওয়ামী লীগ থেকে ছিটকে পড়েন তিনি। যার ধারাবাহিকতায় ২০০৮ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফের নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন চেয়ে বঞ্চিত হন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণফোরামের ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেন। পরে গণফোরামের কোটায় ধানের শীষ প্রতীকে মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
’৯৬’র নির্বাচনের আগে বিএনপিতে যান হাবিব:
নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের অগ্রনায়ক হাবিবুর রহমান হাবিব। রাগে ক্ষোভে অভিমানে '৯৬ সালে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ছাড়লেও বিএনপিতে তেমন সুবিধা করতে পারেননি হাবিব। ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাবনা-৪ আসন (ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া) থেকে ধানের শীষের মনোনয়ন চেয়ে বঞ্চিত হন সাবেক এই ছাত্রনেতা। অবশ্য ২০০১ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর চেয়ে বেশি ভোট পান তিনি।
১৯৬৫ সালে পাবনা সারা মারোয়ারী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালীন ছাত্রলীগের প্রাথমিক সদস্য হয়ে ছাত্ররাজনীতিতে নাম লেখান হাবিব। তৎকালীন পাবনার ঈশ্বরদী জিন্নাহ কলেজ এবং পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অনার্স পড়া অবস্থায় ছাত্রলীগের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। পরে একই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাব বিভাগে মাস্টার্স করেন। এ সময় তিনি কাদের-চুন্নু কমিটি, ফজলু-চুন্নু কমিটিতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরে মান্নান-নানক কমিটিতে তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং সুলতান-রহমান কমিটিতে সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি হন। '৯০-এ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর '৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে গিয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। ওই বছর নৌকা প্রতীকে ভোট করলেও হেরে যান। পরে '৯৬ সালে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ওই বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কিছু দিন আগে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি ছেড়ে বিএনপিতে যোগদান করেন।
(ঢাকাটাইমস/৩১জানুয়ারি/এইচএফ)

মন্তব্য করুন