১১ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে ২ কোটি ১১ লাখ

নতুন জনশুমারি অনুযায়ী দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। যা ২০১১ সালে ছিল ১৪ কোটি ৪০ লাখ ৪৩ হাজার ৬৯৭ জন। অর্থাৎ গত ১১ বছরে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ২ কোটি ১১ লাখ ১৪ হাজার ৯১৯ জন। তবে সাধারণ মানুষের কাছে এই তথ্য অবিশ^াস্য বলে মনে হয়েছে।
গতকাল রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দেশের প্রথম ডিজিটাল ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২১’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ওই প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
জনশুমারি অনুযায়ী, দেশে প্রথমবারের মতো পুরুষের চেয়ে বেড়েছে নারী। দেশে মোট পুরুষের সংখ্যা ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪ জন, নারী ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের জনসংখ্যা ১২ হাজার ৬২৯ জন। জনশুমারি অনুযায়ী দেশে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি।
সধারণ মানুষের কাছে বিবিএসের এই তথ্য অবিশ^াস্য বলে মনে হয়েছে। তারা বলছেন, জনসংখ্যা কম হলে দেশের জন্য ভালো। তবে এই তথ্য সঠিক নয়। কারণ, অনেকেই জানেন না জনশুমারী কবে হলো? কারা জনশুমারীর তথ্য সংগ্রহ করেছে? এমন অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ মানুষের মনে।
লালবাগের বাসিন্দা মঈনুল ইসলাম মতে, জনশুমারীর এই তথ্য সঠিক নয়। কারণ, জনশুমারীর জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে কেউ তারা বাসায় যায় নি। তার পরিবারের সদস্যরাও এ বিষয়ে কিছু জানে না।
ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘দুঃখ জনক ব্যপার। আমার বাসায় গৃহগণনায় কেউ আসে নি। শুধু আমার বাসা না, রাজধানীতে আমার পরিচিত যারা আছেন তাদেরকে জিজ্ঞাসা করার পর কেউই জানেনা এ বিষয়ে।
মঈনুল ইসলাম বলেন, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। আমাদের দেশে জনসংখ্যা এতো কম। জনসংখ্যা কম হলে তো আমাদের দেশের জন্য ভালো। এ তথ্য আমার কাছে সঠিক মনে হচ্ছে না। কারন একটাই আমার বাসায়ই আসে নাই। তাহলে কেমনে কি?
গত ২৮ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক শেষে এনইসি সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘জনশুমারি ও গৃহগণনার কাজের দায়িত্বশীল মন্ত্রী হিসেবে স্বীকার করছি, এবারের মানুষ গোনার কাজে অবহেলা হয়েছে।’
কিন্তু গতকাল পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘জনসংখ্যার দিক থেকে আমরা যে অষ্টম স্থানে ছিলাম সেখানে থাকবো না। আমরা ২১তম স্থানে চলে যাবো। কয়েকটি দেশে জনসংখ্যা ভয়ঙ্করভাবে বাড়বে। জনমিতির যে সুবাতাস বইছে এটার সুবিধা আমরা পাচ্ছি। সেটা ২০৪৫ এর দিকে গিয়ে বন্ধ হয়ে যাবে। ২১ শতকে গিয়ে নির্ভরশীলতার সংখ্যা কমে যাবে। এটা জাপান ছাড়াও অন্যান্য উন্নত দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’
বিবিএস প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বর্তমানে রাজধানী ঢাকাতে বসবাস করেন ১ কোটি ১২ লাখ ১৯ হাজার ৭০৮ জন। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ১৬ ভাগের একভাগ। ঢাকা শহরে ৬০ লাখ ৭৯ হাজার ৩৬৫ জন পুরুষ ও ৫১ লাখ ৩৮ হাজার ৬৯২ জন নারী বসবাস করেন। আর তৃতীয় লিঙ্গের জনসংখ্যাও ঢাকা শহরে বেশি, ১ হাজার ৬১৫ জন।
দক্ষিণ বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা মিসবাহ্ ফরাজী ঢাকাটাইমসকে বলেন, আমি অবাক হয়ে গেছি আমাদের দেশে জনসংখ্যা এত কম কেমন করে হয়। আমার বাসায় তো গননা করতে আসেনি কেউ। তাহলে কি আমার পরিবারের সদস্য এই তালিকায় নেই। এ কেমন গৃহগণনা হলো, এটা কি সঠিক ভাবে নির্ণয় করা হয়েছে? আমার তো মনে হচ্ছে প্রতিটি বাসা-বাড়িতে গিয়ে তদন্ত বা তদারকি করে গণনার কাজ সঠিক ভাবে পরিচালনা করা হয় নাই।
আজিমপুর এলাকার বাসিন্দা আফরোজা লিপি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার পর্যন্ত হিসাব আছে আমাদের দেশে। তবে আমার বাসায় তো আসলো না। আমার হিসাব তো নিলো না। আমার মতো হাজার হাজার মানুষের বাসায় না গিয়েই করা হয়েছে এই লিস্ট।
চাঁনখারপুল এলাকার বাসিন্দা ঢাকাটাইমসকে বলেন, কিছু সংখ্যক ঘর বাড়িতে স্টিকার লাগানো ছাড়া এই গণনার আওতাভূক্ত কত জন এসেছে এর কি কোন তদন্ত বা তদারকি হয়েছে? আমাকে কেউ গণনার জন্য আসেনি এমন কি আমার আশপাশের বা পরিচিত জনদের অনেকেরই দাবী তারা গণনায় পড়েননি। এমনকি কখন গণনা কার্যক্রম শুরু কিংবা শেষ হয়েছে তাও তারা জানেননা।
যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহা-পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো: মতিয়ার রহমানের দাবি সঠিক পদ্ধতিতে গৃহগণনার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, আমি বলবো যে, সঠিক পদ্ধতিতে গৃহগণনার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তবে কোন ধরনের তথ্য ঘাটতি থাকলে পরবর্তিতে তা ঠিক করা হবে। আর অভিযোগ যারা করছেন। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই তারা আরো যাচাই-বাচাই করে তার পর অভিযোগ করুক। আমাদের লোক বাড়ি যায়নি এ বিষয়ে আরো বোঝার ও জানার আছে। আমরা অনেক প্রচার প্রচারণার কাজ করেছি। তখন কেউ কিছু বললো না। এখন ১ মাস ৭ দিন পর এসে যদি কেউ এসব কথা বলে যে আমার বাসায় যায় নি। এখন না বলে আগে বলা উচিত ছিলো তাদের।
বিবিএসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পল্লী এলাকার চেয়ে শহর এলাকায় সাক্ষরতার হার বেশি। জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী পল্লী এলাকার মোট সাক্ষরতার হার ৭১.৫৬ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষের সাক্ষরতার হার ৭৩.২৯ শতাংশ, নারীদের সাক্ষরতার হার ৬৯.৯৩ শতাংশ এবং হিজড়া জনগোষ্ঠীর সাক্ষরতার হার ৫১.৯৭ শতাংশ। এছাড়া, শহর এলাকায় মোট সাক্ষরতার হার ৮১.২৮ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষের ৮৩.১৮ শতাংশ ও নারীদের ৭৯.৩০ শতাংশ।
২০১১ সালের আদমশুমারিতেও পল্লী এলাকার চেয়ে শহর এলাকায় সাক্ষরতার হার বেশি ছিল। ২০১১ সালের আদমশুমারিতে পল্লী এলাকার মোট সাক্ষরতার হার ছিল ৪৭.১৬ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষের সাক্ষরতার হার ছিল ৪৯.০১ শতাংশ আর নারীদের সাক্ষরতার হার ৪৫.৩৮ শতাংশ। এছাড়া, ২০১১ সালে শহর এলাকায় মোট সাক্ষরতার হার ছিল ৬৬.৪০ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষের সাক্ষরতার হার ছিল ৬৯.৩০ শতাংশ, নারীদের সংখ্যা ছিল ৬৩.২২ শতাংশ।
জনশুমারি প্রকল্পের পরিচালক দিলদার হোসেন বলেন, মোট সাক্ষরতার সর্বোচ্চ হার ঢাকা বিভাগে; ৭৮.০৯ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন হার ময়মনসিংহ বিভাগে; ৬৭.০৯ শতাংশ।
দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে নির্ভরশীলতার অনুপাত ৫২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। যা পল্লী এলাকায় ৫৬ দশমিক ০৯ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ৪৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এ ছাড়া নির্ভরশীলতার অনুপাত ময়মনসিংহ বিভাগে সর্বোচ্চ ৬০ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং ঢাকা বিভাগে সর্বনিম্ন ৪৬ দশমিক ৩২ শতাংশ।
প্রকল্প পরিচালক মো. দিলদার হোসেন জানান, নির্ভরশীলতার হার বরিশালে ৫৭ দশমিক ৭২, চট্টগ্রামে ৫৯ দশমিক ৯৭, খুলনায় ৪৮, রাজশাহীতে ৪৮ দশমিক ৮৯, রংপুরে ৫৩ দশমিক ০৯ এবং সিলেটে ৬০ দশমিক ১০ শতাংশ।
বিবিএস এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের সব বিভাগেই মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়েছে। সেই সাথে প্রায় সব বিভাগেই কমছে হিন্দু, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মের জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। বর্তমান শুমারিতে হিন্দু জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ, ২০১১ সালে যা ছিল ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
২০২২ সালের শুমারি অনুযায়ী দেশের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার ০ দশমিক ৬১ শতাংশ, ২০১১ সালের যা ছিল ০ দশমিক ৬২ শতাংশ।
বর্তমান শুমারিতে খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার ০.৩০ শতাংশ; ২০১১ সালে যা ছিল ০.৩১ শতাংশ। এ ছাড়া অন্যান্য জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার ০.১২ শতাংশ; যা ২০১১ সালে ছিল ০.১৪ শতাংশ।
জনশুমারি ২০২২-এর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি ১০০ জনের মধ্যে গড়ে অবিবাহিত ২৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ। বিবাহিত ৬৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। বিধবা কিংবা বিপত্নীক ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। তালাকপ্রাপ্ত শূন্য দশমিক ৪২ শতাংশ। আলাদা থাকেন শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ।
শুমারির তথ্যানুযায়ী, দেশে জনসংখ্যার বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার কমছে। এবারের শুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.২২ শতাংশ। যা ২০১১ সালে বৃদ্ধির হার ছিল ১.৪৬ শতাংশ, ২০০১ সালে ছিল ১.৫৮ শতাংশ, ১৯৯১ সালে ছিল ২.০১ শতাংশ, ১৯৮১ সালে ছিল ২.৮৪ শতাংশ। অর্থাৎ শুমারির শুরু থেকে এ পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমছে।
২০০১ সালে ছিল দেশে জনসংখ্যা ছিল ১২ কোটি ৪৩ লাখ ৫৫ হাজার ২৬৩ জন। ১৯৯১ সালে ছিল ১০ কোটি ৬৩ লাখ ১৪ হাজার ৯৯২ জন। ১৯৮১ সালে ছিল ৮ কোটি ৭১ লাখ ১৯ হাজার ৯৬৫ জন এবং ১৯৭৪ সালের প্রথম শুমারিতে দেশে জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ১৪ লাখ ৭৯ হাজার ৭১ জন।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত আছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম প্রমুখ। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন।
উল্লেখ্য, সারাদেশে গত ১৫ জুন একযোগে শুরু হয় জনশুমারি ও গৃহগণনা কার্যক্রম। গত ২১ জুন জনশুমারি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলায় বন্যা শুরু হওয়ায় এসব জেলায় শুমারি কার্যক্রম ২৮ জুন পর্যন্ত চলে।
(ঢাকাটাইমস/২৭জুলাই/আরকেএইচ)

মন্তব্য করুন