রেলওয়ের কালো বিড়ালকে কেন থামানো যায় না?

আরিফুর রহমান দোলন
| আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০২২, ০৮:৩০ | প্রকাশিত : ০৬ আগস্ট ২০২২, ১৩:৪৩

তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছিল রেলওয়ে মন্ত্রণালয়। রেলের কালো বিড়াল তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে থামিয়ে দিয়েছিল?

না-কি বাগ্মী সুরঞ্জিতই থামাতে পারেননি রেলওয়ের কালো বিড়ালকে? এ প্রশ্ন হয়তো অমীমাংসিতই থেকে যাবে আজীবন।

প্রয়াত জাতীয় রাজনীতিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে নিয়ে যতটুকু বিতর্ক হয় এর সিংহভাগই রেলপথ মন্ত্রণালয়ে তাঁর দায়িত্বের সময়কালকে ঘিরে। তৎকালীন এক-এগারোর সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে দলীয় রাজনীতিক লাইনের সমান্তরাল কিছু একটায় সুরঞ্জিত সেনরা যুক্ত ছিলেন, গুঞ্জনে আচমকাই ছিটকে পড়েছিলেন দল ও সরকারের নীতি নির্ধারণী কর্মকাণ্ডে। সেইসব ধাক্কা সামলে মন্ত্রী হিসেবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যখন প্রচারের আলোয় ভেসে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন তখনই খাদের কিনারায় তিনি।

রেলপথ মন্ত্রণালয় কি কুফা ছিল মন্ত্রী সুরঞ্জিতের জন্য? তাঁর এপিএসের গাড়িতে নগদ কোটি টাকা উদ্ধারের ঘটনায় রাজনৈতিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগতভাবে হেনস্তা হয়েছিলেন তিনি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে রাজনৈতিক অস্বস্তি নিয়ে শেষ জীবনটা পার হয়েছে তাঁর। ২০০৯ সালের পর সরকারের নবগঠিত রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর বাকি সময়টা কেটেছে চরম অস্বস্তি আর গুমোট রাজনৈতিক পরিবেশে।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পর মন্ত্রী হিসেবে মুজিবুল হকের পারফরমেন্সের গ্রাফই বা কতটা ওঠানামা করেছে? কুমিল্লার চিরকুমার সমিতির একসময়ের অবিসংবাদিত নেতা মুজিবুল হক মন্ত্রী হয়ে সংসারী জীবনে দারুণ স্থিত হয়েছেন। কিন্তু তার নির্বাচনী এলাকা চৌদ্দগ্রামের রাজনৈতিক সংসারটা কেমন যেন ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছে। সত্যি!

সারল্য সাদামাটা আর সহজে মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়াই যে মুজিবুল হকের আজীবন পরিচিতি, তিনি কেন দলের তৃণমূল স্তরে কোন্দল সৃষ্টির দোষে দুষ্ট হবেন? কুমিল্লা আর চৌদ্দগ্রাম আওয়ামী লীগের অন্দরে কান পাতলেই শোনা যায় সাবেক রেলপথ মন্ত্রী বদলে গেছেন।

কেমন? কর্মীবান্ধব মুজিবুল হকের বাসায় আগের মতো আর সারাক্ষণ ভিড় লেগে থাকে না। কর্মীদের ‘প্রিয় মুজিব ভাই’ আর লিডারের বেডরুমে ঢুকে পড়া, ড্রইংরুমে বসে পড়া কিংবা দিনের পর দিন রাত কাটানো যেখানে একসময় অতি সাধারণ ঘটনা ছিল সেটিই এখন রেলপথ মন্ত্রী হওয়ার পর ভিন্ন চেহারা পায়। তাঁর অনেক নেতাকর্মীর অর্থনীতি হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে বটে কিন্তু জীর্ণশীর্ণ হয়ে যাচ্ছে একজন মাটি ও মানুষের নেতার সারল্যের ভাবমূর্তি।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ে আসলে আছে কী?

কেন উজ্জ্বল ভাবমূর্তির ব্যক্তিত্বের ঔজ্জ্বল্যও ফিকে হয় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সংস্পর্শে এলে? কেন উঁচু মাথাকে হেট করতে হয়? কেন রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তরা সাফল্য দেখাতে পারে না? রেলওয়ে কি বরাবরের মতোই ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে থাকবে? এমন হাজারো প্রশ্ন অনেকের মতো আমার মনেও। কিন্তু আদৌ কোনো উত্তর কখনো মিলবে কি?

দায়িত্ব নেওয়ার পর কতটা স্বস্তিতে থাকতে পেরেছেন নুরুল ইসলাম সুজন? কেন মাঝেমধ্যে অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে বর্তমান রেলমন্ত্রীকেও? পূর্বের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতির ছায়া এখনো কেন? সঙ্গে স্বজনপ্রীতির আধিপত্য। বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণ কিংবা এই অনিয়মে তাঁর স্ত্রীর নাম জড়িয়ে যাওয়া কি ছিল শুধুই কাকতালীয়! না-কি রেলওয়ে বিভাগে এমন ঘটনা হরহামেশাই হয়?

সজ্জন, সুবক্তা এবং সুদর্শন রাজনৈতিক নেতা ও পেশায় সফল আমাদের বর্তমান রেলমন্ত্রী। এতটাই যে রাজনৈতিক জীবনে ছাত্র, যুব ও মূল সংগঠনের কোনো না কোনো পর্যায়ে তিনি বরাবরই গুরুদায়িত্ব পেয়েছেন। ডাকসুতে ছাত্রলীগের মনোনয়ন নিয়ে যেমন নির্বাচিত হয়েছেন তেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের শীর্ষ পদও সামলেছেন। যুবলীগের আইন বিষয়ক সম্পাদকের পর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদকের পদেও নির্বাচিত হয়েছেন। মন্ত্রিত্বের পাশাপাশি এখন সামলাচ্ছেন পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদও। তাদের রাজনৈতিক প্রভাব, অবস্থানের শেকড় এতটাই গভীর যে, গত ১১টা সংসদ নির্বাচনের মধ্যে সাত বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছে তাঁর পরিবার থেকেই। চারবার তাঁর ভাই অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম। আর বিগত তিন নির্বাচনে মন্ত্রী নিজে।

সব রকম অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ তুখোড় এই আইনজীবী কেন রেলওয়েকে জাগিয়ে তুলতে পারছেন না? কেন সামান্য রেলওয়ে টিকিট বিক্রি ব্যবস্থাপনা সংকট এখনো আলোচনার শিরোনাম হবে? রেলের টিকিট কালোবাজারি রোধ করা কি খুব কঠিন কাজ? না-কি স্রেফ সদিচ্ছা আর সঠিক ব্যবস্থাপনাই এখানে মুখ্য? রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতার অভাব না-কি কারো কারো দুর্নীতিপরায়ণ মনমানসিকতায় হোঁচট খাচ্ছে সব? তথ্যপ্রযুক্তির আকাশছোঁয়া সাফল্য যখন সারা বিশ্বে তখন রেলওয়ের সামান্য টিকিট বিক্রির ঝামেলামুক্ত প্রযুক্তি আমরা ব্যবহার করতে পারছি না। কেন একজন রনিকে একক অনশন আর আন্দোলন করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হচ্ছে সব?

রেলওয়ে দুর্ঘটনায় বিগত কয়েক বছরে যে শত শত প্রাণহানি হয়েছে, এই দায় কার? হয়তো আমাদেরই। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই বলবেন, এই রেলওয়ে ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা হয় কেন, চালক সে সময় সতর্ক থাকেন না? রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন ওঠাতেই পারেন রেল ক্রসিংয়ে পতিত গাড়িগুলোর যাত্রীরা যদি চালককে সতর্ক রাখেন, তাহলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। হ্যাঁ, নাগরিক দায়িত্ব নিশ্চয়ই আছে।

কিন্তু রেল ক্রসিংয়ে দায়িত্বরত গেটকিপার নিজ কর্মঘণ্টা মেনে ডিউটিতে আছেন কি নেই এটা দেখার দায়িত্ব তো রেল কর্তৃপক্ষের। এখানে নাগরিকদের কী করার আছে? উল্টো এ নিয়ে সরাসরি গেটকিপারকে কিছু বলতে গেলে তো সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টির অভিযোগে যে কোনো নাগরিকের হয়রানি হওয়ার আশঙ্কা আছে।

রেলের চেহারা যতই জীর্ণশীর্ণ হোক রেলওয়েতে কর্মরত কেউ কেউ না-কি বেশ নাদুসনুদুস। রেলওয়ে ব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধা, সৈয়দ ফারুক আহমেদসহ অনেক কর্মকর্তা যেভাবে দুদকের জালে আটকেছেন এবং তাদের সহায় সম্পত্তির যে খতিয়ান মিলেছে তা বিস্ময়কর। এঁরা রেলওয়ের আরও অনেকের জন্য প্রতীকী নাম হয়তো। কেন দমানো যায় না এঁদের? এঁদের কারণেই কি বারবার ব্যর্থ হয়ে যায় সফল, সৎ আর আন্তরিক অনেক নেতৃত্ব? প্রশ্ন রেলওয়ের ভেতরে কালো বিড়ালরা নাদুসনুদুস হয়ে ওঠে কার, কাদের প্রশ্রয়ে? তাদের ফুলে ফেঁপে ওঠা কেন রোধ করা যায় না?

২০০৯ সাল থেকে রেলওয়ের উন্নয়নে সরকার অনেক প্রকল্প নিয়েছে। বছরের পর বছর বাজেট বেড়েছে। রেলপথের উন্নয়নে খরচ হয়েছে বিস্তর। কিন্তু রেলওয়ের এই উন্নয়ন কাজ করেছে কারা? নিন্দুকেরা বলেন, হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানই রেলওয়ের উন্নয়নের ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে। সত্যিই তাই! কেন? এর পেছনে কি কোনো রহস্য আছে? আছে কি কোনো সুবিধাভোগী গোষ্ঠী? এসব প্রশ্নের উত্তর না মিললে কীভাবে কাটবে রেলওয়ের ব্যবস্থাপনা সংকট?

তবে কি সর্ষের মধ্যেই ভূত?

সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাকে নিশ্চয়ই মনে আছে? রাজধানীতে রেলওয়ে ভবনের পেছনে রেলওয়ের মহামূল্যবান এক একর জমি স্ত্রীর নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিয়ে কার্যত প্রমাণ দিয়েছিলেন অনিয়মই সেখানে নিয়ম। সেই ধারাবাহিকতা আজও কতটা কার্যকর জানা নেই। কিন্তু রেলওয়ে যেভাবে চলা দরকার সেভাবে যে চলছে না সাদা চোখে সেটাই আমরা দেখছি।

রেলওয়ে কি সত্যি সঠিক লাইনে আসবে না? এটা কি একেবারেই অসম্ভব?

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকাটাইমস২৪.কম ও সাপ্তাহিক এই সময়

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজপাট বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা