জিঙ্ক সমৃদ্ধ যেসব খাবারে বাড়াবে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা

বিশ্বজুড়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ জিঙ্কের অভাবজনিত সমস্যায় ভুগছেন। জিঙ্ক মানুষের শরীরের জন্য অত্যাবশ্যকীয় খনিজ। জিঙ্ক শরীরের ডিএনএ, কোলাজেন তৈরি করা থেকে শুরু করে প্রোটিন সিন্থেসিস, থাইরয়েডের কাজ, যৌন স্বাস্থ্য বজায় রাখা, প্রোস্টেট গ্রন্থির কাজ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, লিভারের কাজকর্ম ও সুস্থ দৃষ্টিশক্তি এবং গর্ভবতী মহিলা ও শিশুদের যথাযথ বৃদ্ধি ও বিকাশে সাহায্য করে।
জিঙ্ক সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নির্দিষ্ট কিছু অবস্থার উন্নতি ঘটায়। এটা দৌড়বীরদের শক্তি, ক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ায়। এটা সর্দি-কাশির দারুণ নিরাময়ক এবং ত্বকে লাগানো হলে ঠাণ্ডা ঘা ও ব্রণ ও বয়সের ছাপ পড়ার চিকিৎসা করে। যে কারণে বয়স বাড়ার সঙ্গে জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এটা সূর্য রশ্মির কারণে হওয়া ত্বকে ক্ষতি পোষায়, কোষকলার বৃদ্ধি ও পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রাখে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অফিসিয়াল তথ্য অনুসারে, বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ পর্যাপ্ত জিঙ্ক গ্রহণ করে না। ব্যাপকভাবে জিংকের ঘাটতির অন্যতম প্রধান কারণ হলো প্রোটিনের মতোই আমাদের শরীর এই পুষ্টি সংরক্ষণ করতে পারে না, তাই প্রত্যেককে তার জিংকের প্রয়োজনীয়তা নিয়মিত পূরণ করতে হয়।
গবেষণা অনুযায়ী ৮৫% মহিলা এবং ৬৭% পুরুষ রোজকার প্রয়োজনীয়তার তুলনায় কম পরিমাণ জিঙ্ক পায়। ১৪ বছরের বেশি বয়সী ছেলেদের দিনে ১১ মিলিগ্রাম জিঙ্ক প্রয়োজন, মেয়েদের ৮ মিলিগ্রাম ও স্তনপান করানো মায়েদের দরকার ১২ মিলিগ্রাম। জিঙ্কের অভাবে শরীরের প্রায় ২০০টি এনজাইমের কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। জিঙ্কের অভাবে কোষের কার্যকারিতা কমে, প্রোটিন তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটে। পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও এই খনিজের জুড়ি নেই।
পুষ্টি-বিজ্ঞানের তথ্যানুসারে বিভিন্ন খনিজের মধ্যে জিঙ্ক শুধু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই বাড়ায় না পাশাপাশি ত্বকে বার্ধক্যের ছাপ রুখতেও সাহায্য করে।
জিংকের ঘাটতি দেখা দিলে শরীরে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। এগুলো হলো: স্বাদ ও ঘ্রাণের অনুভূতি কমে যাওয়া, ক্ষুধামান্দ্য বা অরুচি, হতাশা ভাব, ক্ষত শুকাতে দেরি হওয়া, ডায়রিয়া, চুল পড়া ইত্যাদি।
চাহিদার অতিরিক্ত জিংক গ্রহণ করা যাবে না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। জিংকের আধিক্য কপার শোষণে বাধা দেয়। ফলে অ্যানিমিয়া হতে পারে। এ ছাড়া বমি ভাব, বমি, অরুচি, পেটব্যথা, মাথাব্যথা, পাতলা পায়খানা দেখা দিতে পারে। আবার অনেকের ক্ষেত্রেই খাদ্যে প্রাপ্ত জিংকের পাশাপাশি অতিরিক্ত সরবরাহের প্রয়োজন পড়ে কখনো কখনো।
খনিজ উপাদান জিঙ্ক বা দস্তার উৎকৃষ্ট উৎস মাংস। তবে যারা প্রাণিজ খাবার কম খান বা নিরামিষাশী তারাও উদ্ভিজ্জ খাবার থেকে জিঙ্ক পেতে পারেন। গাদা গাদা জিঙ্কের ওষুধ খাওয়া যে উচিত নয়, তা অনেক চিকিৎসকই এখন বলছেন। বরং নিজের ডায়েটে যদি বিশেষ কিছু খাবার রাখতে পারেন, তা হলে স্বাভাবিক নিয়মেই শরীরে জিঙ্কের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। জেনে নিন যেসব খাবার থেকে আপনি প্রয়োজনীয় জিংক গ্রহণ করতে পারবেন-
জিঙ্ক সমৃদ্ধ চাল
জিঙ্কের অভাবেই শিশুরা খাটো হচ্ছে এবং অপুষ্টিতে ভুগছে। চালের মাধ্যমে এই অপুষ্টি দূর করা সম্ভব। কারণ মোট চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ পুষ্টি চালে পাওয়া সম্ভব। ব্রি ধান ৮৪ একটি মিরাকেল জিংক সমৃদ্ধ জাত। এখন হাই জিংক সমৃদ্ধ চাল আনছে ব্রি। জিংকের পরিমাণ হবে ৪৫ পিপিএম।
দুধ-ডিম-দই
ডিমের মতো পুষ্টিকর খাবার খুব কম হয়। অনেক ডাক্তারই এখন বলছেন, দিনে একটা করে সিদ্ধ ডিম খেতে। এতে আপনার জিঙ্ক ছাড়াও নানা রকম পুষ্টির রসদ পেয়ে যাবেন। দুগ্ধজাত খাবারেও ডিমের মতোই অন্যান্য পুষ্টি ছাড়াও পাবেন জিঙ্ক।
সবজি
আলু, মাশরুম, কেল, বিনের মতো কিছু সবজিতে অল্প পরিমাণে জিঙ্ক থাকে। তাই নিয়মিত খেলে উপকার পাবেন।
মাংস
মাংস জিংকের একটি দুর্দান্ত উৎস। বিশেষ করে লাল মাংস। গরুর মাংসের পাশাপাশি ভেড়ার মাংসেও প্রচুর জিংক থাকে। গ্রাম বা উন্মুক্ত অঞ্চলের গরু যেটাকে আমরা অর্গানিক গরু বলে থাকি, সেই গরুর ১০০ গ্রাম মাংসে ৪.৮ মিলিগ্রাম জিংক থাকে। এছাড়াও গরুর মাংসে প্রোটিন, আয়রন, বি ভিটামিনসহ গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টির এক দুর্দান্ত উৎস।
পনির
যদিও উদ্ভিজ্জ খাবার নয়। তবে প্রোটিনের উৎস হিসেবে নিরামিষভোজীদের কাছে পনির বেশ জনপ্রিয়। পনির বা কটেজ চিজ ক্যালসিয়াম ও জিঙ্কের ভালো উৎস। স্যান্ডউইচ, সালাদ বা রুটিতে পনির যোগ করে খাওয়া যেতে পারে।
শেলফিশ
শেলফিশের তালিকায় রয়েছে অনেক কিছুই। তবে সবচেয়ে সহজলভ্য হল ঝিনুক, শামুক, কাঁকড়া, চিংড়ি, গলদা চিংড়ি। এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি১২ ও জিঙ্ক থাকে। রয়েছে পটাশিয়াম, ভিটামিন সি, সেলেনিয়াম ও আয়রন। সবচেয়ে পুষ্টিকর প্রাণির মধ্যে রয়েছে এই শেলফিশ।
মুরগির মাংস
মুরগির মাংস প্রোটিনের একটি দুর্দান্ত উৱস, যা পেশী বৃদ্ধি এবং বিকাশে অবদান রাখে। তবে আমাদের মধ্যে অনেকেই জানেন না যে এটি জিঙ্ক সমৃদ্ধ। নিয়মিত মুরগি খাওয়া আপনার হাড়, হার্টের স্বাস্থ্য এবং অনাক্রম্যতার জন্য ভাল। ৮৫ গ্রাম মুরগীতে ২.৪ গ্রাম জিঙ্ক থাকে।
কলাই
যদি আপনি প্রচুর পরিমাণে জিঙ্ক সমৃদ্ধ উদ্ভিদ-ভিত্তিক খাবারের সন্ধান করেন তবে আপনার ডায়েটে বিভিন্ন কলাই বা শিম জাতীয় খাবার অন্তর্ভুক্ত করুন। ছোলা, মটরশুটি এবং মসুর জাতীয় খাবার জিঙ্কের একটি ভাল উৎস। এগুলিতে ফ্যাট ও ক্যালোরি কম থাকে এবং প্রোটিন এবং ফাইবারের মতো অন্যান্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান থাকে। ১৬৪ গ্রাম ছোলাতে ২.৫ মিলিগ্রাম জিঙ্ক থাকে এবং ১০০ গ্রাম মসুর ডালে ৪.৭৮ মিলিগ্রাম থেকে ১.২৭ মিলিগ্রাম জিঙ্ক থাকে। এছাড়া ১৮০ গ্রাম মটরশুটিতে ৫.১ গ্রাম জিঙ্ক থাকে।
কুমড়ার বীজ
কুমড়ার বীজে পর্যাপ্ত পরিমাণে জিঙ্ক থাকে। ১০০ গ্রাম কুমড়োর বীজে ৬.৬ মিলিগ্রাম দস্তা থাকে, যা প্রতিদিনের প্রয়োজনের ৪৪% পূরণের জন্য পর্যাপ্ত। কুমড়ার বীজের তেলও দস্তার উত্স হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। একটি গবেষণা অনুসারে কুমড়োর বীজ এবং কুমড়োর বীজ তেল পোস্টম্যানোপসাল মহিলাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে। কুমড়োর বীজ প্রোস্টেট স্বাস্থ্যের জন্য এবং আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যও উপকারী।
রসুন
রসুনে কিছুটা জিঙ্ক থাকে। রসুনের চুল পড়া রোধের প্রভাব মূলত এটিতে জিঙ্ক রয়েছে এমন কারণে হয়। স্পষ্টতই, রসুন এককভাবে আপনার জিংকের প্রতিদিনের চাহিদা পূরণ করবে না, তবে আপনি যদি অন্যান্য সুবিধাগুলো বিবেচনা করেন, রসুন জিঙ্কের উত্স হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
চিনাবাদাম
চিনাবাদাম জিঙ্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উত্স। একমাত্র সমস্যাটি হল চিনাবাদাম খুব বেশি ক্যালোরিযুক্ত। ১০০ গ্রাম চিনাবাদাম প্রায় 317 ক্যালোরি।
লিভার
গরুর মাংসের লিভার জিঙ্কের একটি ভাল উত্স। আপনি নিজের পছন্দ মতো রান্না করে খেতে পারেন।
তিলের বীজ
তিলের বীজ পুষ্টির আঁধার। এটা জিঙ্ক, ক্যালসিয়াম, সেলেনিয়াম, লৌহ, ও ভিটামিন বি-সিক্স সমৃদ্ধ। এটা তাপ উৎপাদন করে, তাই দিনে দুই চামচের বেশি তিলের বীজ খাওয়া ঠিক নয়। অথবা সমস্যা এড়াতে সারা রাত পানিতে ভিজিয়ে বা হালকা ভেজে নাস্তা হিসেবে খেতে পারেন।
বিভিন্ন রকমের ডাল
কাঁচা মুগ, ছোলা, কাবুলি ছোলা, রাজমার মতো শস্যে খেলেও আপনি প্রচুর পরিমাণে জিঙ্ক পাবেন। তবে এগুলি কাঁচা খেলে পেট ফুলে যাওয়ার একটা সমস্যা দেখা যায়। তাই সিদ্ধ করে, পানিতে ভিজিয়ে বা ফার্মেন্ট করে খেতে পারেন।
ওটস
ওটসে রয়েছে প্রচুর ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, থিয়ামিন, ভিটামিন ইত্যাদি যা অন্যান্য শস্যজাতীয় খাবারের তুলনায় বেশি। কম পরিমাণে ফ্যাট-ওটসে প্রাকৃতিকভাবে ফ্যাটের পরিমাণ কম থাকে। তাছাড়াও রয়েছে উপকারি ফ্যাটি অ্যাসিড, মানে মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট। ওটসের বেটা-গ্লুকোন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি সিস্টেমকে বৃদ্ধি করে।
ডার্ক চকোলেট
ডার্ক চকোলেটে পর্যান্ত পরিমাণ জিঙ্ক পাওয়া যায়। ১০০ গ্রাম ওজনের একটি চকোলেটের বারে ৩.৩ মিলিগ্রাম জিংক থাকে।
মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্যগত কোনো প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং সুস্থ থাকতে স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে।
(ঢাকাটাইমস/২০ ফেব্রুয়ারি/আরজেড)

মন্তব্য করুন