যাত্রী সেজে চেতনানাশক দিয়ে অজ্ঞান করে ছিনতাই করতো কুখ্যাত ‘মামা পার্টি’

যাত্রী সেজে চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে অজ্ঞান করে ছিনতাইকারী চক্র ‘মামা পার্টি’-এর মূলহোতা শাহীন রানা ওরফে তজ্জমসহ পাঁচ সদস্যকে মঙ্গলবার মাঝরাতে অভিযান চালিয়ে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-১০।
চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে ফরিদপুর, শরীয়তপুর, মাদারিপুর, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জসহ রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রাইভেটকার/মাইক্রো ভাড়া করে যাত্রী সেজে চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের নিকট হতে সর্বস্ব লুট করে আসছিল।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- খুলনার খানজাহান আলী থানার শিরোমনি এলাকার মৃত শামছুর রহমানের ছেলে মো. রানা ওরফে মো. শাহীন ওরফে শাহীন রানা ওরফে তজ্জম (৪৯), শরীয়তপুরের জাজিরা থানার হরিয়াশা এলাকার মো. আব্দুর রহিমের ছেলে মো. মফিজুল ইসলাম ওরফে মো. ইসলাম ওরফে ইসলাম মিয়া (৪৮), মাদারীপুর সদরের ঘটমাঝি এলাকার মৃত আ. খালেকের ছেলে মো. সাগর ওরফে হাবিবুর রহমান শেখ ওরফে মো. হাবিব (৫১), মৌলভীবাজারের বড়লেখা থানার সুজানগর এলাকার আব্দুল খালেকের ছেলে মো. ফারুক আহমদ ওরফে মো. ফারুক মিয়া ওরফে মো. ফারুক (৩৪), শরীয়তপুরের নড়িয়া থানার সুরেশ্বর এলাকার মৃত খাদেম আলী সরদারের ছেলে মো. আবুল কালাম (৫৩)।
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টায় কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের এ বিষয়ে ব্রিফ করেন র্যাব-১০ এর অধিনায়ক এ্যাডিশনাল ডিআইজি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন।
এ্যাডিশনাল ডিআইজি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন বলেন, গত ২৬ জুন ফরিদপুরের ভাঙ্গা এলাকায় মো. শাহীন রানা ওরফে তজ্জম ও মো. মফিজুল ইসলামসহ আরও অন্যান্য আসামিরা যাত্রী সেজে মো. সাদ্দাম শেখ (৩৪) নামক একজন ইজিবাইক চালকের ইজিবাইকটি ভাড়া করেন। তারা ইজিবাইক চালক সাদ্দামকে মারধর করে এবং একপর্যায় চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে অচেতন করে একটি মেহগনি বাগানে আহত অবস্থায় ফেলে রেখে ইজিবাইকটি ছিনতাই করে পালিয়ে যান।
পরবর্তীতে ঐদিন আনুমানিক রাত সাড়ে আটটার দিকে ভিকটিম সাদ্দাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ফরিদপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়াও আসামিরা ভিকটিমের পরিবারের নিকট হতে ছিনতাইকৃত ইজিবাইকটি ফেরত দেওয়ার কথা বলে প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিকাশ নম্বরে মোট- ৩৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করে। এই হত্যাকান্ডের ঘটনা তদন্তকালে ‘মামা পার্টি’ চক্রটি সম্পর্কে জানা য়ায়। এই ‘মামা পার্টি’র মূলহোতা মো. শাহিন রানা ওরফে তজ্জম এবং এই পার্টির সক্রিয় সদস্য ১০ জন বলে জানা যায়।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৩ ফেব্রুয়ারি মাঝরাতে র্যাব-১০ এর একটি আভিযানিক দল গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ও তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানাধীন শনিরআখড়া এলাকায় একাধিক অভিযান পরিচালনা করে ‘মামা পার্টি’ খ্যাত ছিনতাইকারী চক্রের মূলহোতাসহ পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।
এ সময় তাদের নিকট হতে ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত একটি হাইএস গাড়ি ও একটি করোলা প্রাইভেট কার, একটি হাতকড়া, চেতনা নাশক ঔষধ (চার পাতার মোট ৪০টি), দুইটি সুইচ গিয়ার চাকু, দুইটি স্টীলের চাকু, একটি ক্ষুর, ছয়টি পুরাতন টাচ মোবাইল ফোন, পাঁচটি পুরাতন বাটন মোবাইল ও নগদ- ১ হাজার ৬০০ টাকা উদ্ধার করা হয়।
র্যাব-১০ এর অধিনায়ক আরও বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়- গ্রেপ্তারকৃত শাহীন রানা চক্রটির মূল পরিকল্পনাকারী এবং তার নেতৃত্বে চক্রটি দীর্ঘদিন যাবত গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, মাদারিপুর ও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রাইভেট কার/মাইক্রো ভাড়া করে যাত্রী সেজে চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করে ছিনতাই করে আসছিল। তাদের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রথমে তারা ছিনতাইয়ের জন্য উপযুক্ত ও নির্জন রুট সিলেক্ট করতো। এক্ষেত্রে তারা রাত তিনটা থেকে সকাল সাতটার মধ্যে যেকোন সময় এই ছিনতাইয়ের কাজ করতো। তারপর কখনও মফিজুলের প্রাইভেটকার ব্যবহার করতো। আবার কখনও মফিজুলের মাধ্যমে অন্য কোন প্রাইভেটকার/মাইক্রো ভাড়া নিতো। অতঃপর মফিজুল উক্ত গাড়ি চালাতো এবং শাহীন যাত্রী সেজে মফিজুলের পাশে বসে থাকতো। অন্যরা তাদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী নির্বাচিত রুটের এক-দুই কিলোমিটার পরপর যাত্রী বেশে অবস্থান করতো। পরবর্তীতে সবাই একত্রিত হওয়ার পর ভিকটিমকে কখনও দেশীয় অন্ত্রের ভয়ভীতি দেখিয়ে মারধর করে আবার কখনও চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করে অচেতন করে ভিকটিমের সবকিছু লুট করে তাদের সুবিধাজনক যেকোন নির্জন স্থানে ভিকটিমকে ফেলে রেখে সেখান থেকে পালিয়ে যেত।
তিনি বলেন, গ্রেপ্তারকৃত মো. শাহীন রানা ওরফে তজ্জম ‘মামা পার্টি’ চক্রটির দলনেতা। শাহীন দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই, ডাকাতি ও মলম পার্টির সক্রিয় সদস্য হিসেবে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে আসছে। সে উত্ত চক্রটির মাস্টার হিসেবে পরিচিত ছিল। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, শাহীন ২০০০ সালে একটি চুরির মামলায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে পাঁচ বছর কারাভোগ করে ছিলো। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতিসহ পাঁচটি মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।
গ্রেপ্তারকৃত মো. মফিজুল ইসলাম ওরফে ইসলাম পেশায় একজন ড্রাইভার। সে বিভিন্ন কোম্পানীর গাড়ি চালক হিসেবে কর্মরত ছিলো। সে বিভিন্ন ব্যক্তির গাড়ি ভাড়া করে অপরাধ করে আসছিল। পরবর্তীতে সে মলম পার্টি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ডাকাতি, ছিনতাই ও মাদক মামলাসহ তিনিটি মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।
গ্রেপ্তারকৃত মো. সাগর ওরফে হাবিবুর রহমান শেখ রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ড্রাইভার হিসেবে কাজ করতো। উক্ত পেশার আড়ালে সে মামা পার্টির সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করতো। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যা চেষ্টাসহ চারটি মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।
গ্রেপ্তারকৃত মো. ফারুক আহমদ ওরফে মো. ফারুক মিয়া ওরফে মো. ফারুক রাজধানীর ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় রেন্ট-এ কার এর গাড়ি চালাতো। উক্ত পেশার আড়ালে সে রাজধানীর সাইনবোর্ড, কদমতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় ভোর রাতে যাত্রীদের গাড়িতে তুলে বিভিন্ন মলম, চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করে ও দেশীয় অস্ত্রে ভয় দেখিয়ে ছিনতাই করতো। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাই ও ডাকাতির দুইটি মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।
গ্রেপ্তারকৃত মো. আবুল কালাম পেশায় গাড়ী চালক। সে উক্ত পেশার আড়ালে রাজধানীর ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন যাত্রীবাহী গাড়িতে উঠে জুস, চিপসহ বিভন্ন প্রকার খাদ্যদ্রব্যের সাথে কৌশলে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে যাত্রীদের অচেতন করে তাদের কাছে থাকা টাকা ও মোবাইলসহ বিভিন্ন মূল্যবান সম্পদ ছিনতাই করতো। তার বিরুদ্ধেও রাজধানীর কদমতলী থানায় একটি ছিনতাই মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।
আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন বলে জানান র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-১০ এর অধিনায়ক এ্যাডিশনাল ডিআইজি মোহাম্মদ ফরিদ।
(ঢাকাটাইমস/১৩ফেব্রুয়ারি/এমআই/এমআর)

মন্তব্য করুন