কিডনি সুস্থ রাখে ঔষধি ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ফল রাম্বুটান

দৃষ্টিনন্দন, অত্যন্ত সুস্বাদু ও রসালো ফল রাম্বুটান। সাদা, স্বচ্ছ, অম্লীয় মিষ্টি গন্ধযুক্ত শাঁস এ ফলের ভক্ষণীয় অংশ। রাম্বুটানের বৈজ্ঞানিক নাম নেফেলিয়াম ল্যাপাসিয়াম। রাম্বুটান মালয়েশিয়ায় ‘রামভুটা’ নামে ব্যাপক পরিচিত। রাম্বুটানের আদি নিবাস মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। তাছাড়া কোস্টারিকা, হন্ডুরাস, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং ভিয়েতনামের পাশাপাশি বাংলাদেশ, ভারত, ফিলিপাইন, মিয়ানমার, শ্রীলংকা প্রভৃতি দেশে রাম্বুটান ভালো জন্মে। কোনো দেশের গড় তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেখানে প্রচুর ফল জন্মে। তবে ফলটি এখন থাইল্যান্ডে প্রচুর জন্মায়। জাভা বোর্নিও, কম্পুচিয়া, ফিলিপাইন এবং ভিয়েতনামে চাষ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ভালুকা ময়মনসিংহ এবং রাঙ্গামাটিতে ভালো ফলন হচ্ছে।
রাম্বুটান গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে প্রাপ্ত লিচুর মতো দেখতে এক ধরনের ফল। ইন্দোনেশীয় ভাষায় রাম্বুট শব্দের অর্থ চুল। বাসকপাতার মতোই রাম্বুটানের পাতা। ফলের খোসায় চুলের ন্যায় বস্তু থাকায় ফলটির এমন নাম হয়েছে। এই ফলটি পাকলে সবুজাভ হলদে রঙ ধারণ করে। জাতভেদে হালকা লাল, বাদামি, এমনকি কালচে রঙেরও হয়ে থাকে রাম্বুটান। ফলের খোসায় নরম কাঁটার মতো লোম থাকায় আমাদের দেশে অনেকে এটাকে ‘চুলওয়ালা লিচু’ বলে আখ্যায়িত করেন।
খোসা লম্বা, খাঁজকাটা, বাঁকা কাঁটাযুক্ত। তবে কাঁটাগুলো তত শক্ত নয়। খোসা ছাড়ালে ভেতরে লিচুর মতো সাদা শাঁস পাওয়া যায়। শাঁসের স্বাদ মিষ্টি টক, এবং শাঁস রসাল। ভেতরে বীজ থাকে একটি। প্রতিটি ফলের ওজন ৩০ থেকে ৬০ গ্রাম। ফল ধরে গ্রীষ্মকালে।
রাম্বুটানের গাছ মাঝারি আকারের বৃক্ষ প্রকৃতির। লম্বা হয় প্রায় ১০ থেকে ১২ মিটার। বেশ ঝোপাল স্বভাবের এই গাছে ২ থেকে ৪টি পাতা একত্রে থাকে। ফুলের রঙ সবুজাভ, ক্ষুদ্র, একটি ছড়ায় ৬০০-২০০০ টি ফুল ফোটে। কিন্তু থোকায় ফল তত ধরে না। যে সব বিদেশী ফল এ দেশে সফলভাবে লাভজনক হিসেবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে তার মধ্যে রাম্বুটান অন্যতম।
রাম্বুটান ফল আকারে ছোট আকৃতির হলেও এটি তে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। যা শরীরের অনাক্রমতা বাড়াতে এবং শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থগুলোকে বের করে দিতে সহায়তা করে। এছাড়াও রাম্বুটানের মধ্যে তামা রয়েছে, যা রক্তনালীগুলোকে এবং রক্ত কোষগুলির স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে লোহার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে কাজ করে। এটি আয়রনের একটি উৎকৃষ্ট উৎস হিসেবে পরিচিত।
প্রতি ১০০ গ্রাম রাম্বুটান এর মধ্যে প্রায় ৮৪ ক্যালোরি থাকে। এছাড়াও এটি পরিবেশনের সময় খুব কম পরিমাণে ফ্যাট থাকে। তাহলে জেনে নেওয়া যাক ১০০ গ্রাম রাম্বুটনের মধ্যে কত পরিমাণ পুষ্টি উপাদান উপস্থিত রয়েছে- পানি– ৭৮.০৪ গ্রাম, শক্তি – ৮৪ কিলোক্যালোরী, প্রোটিন – ০.৬৫ গ্রাম, ফ্যাট – ০.২১ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট – ২০.৮৭ গ্রাম, ফাইবার – ০.৯ গ্রাম, ক্যালশিয়াম – ২২ মিলিগ্রাম, আয়রন -০.৩৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি – ৪.৯ মিলিগ্রাম।
রাম্বুটন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ এক ধরনের উপাদান, যা ফ্রি রেডিকেলগুলোর সাথে লড়াই করে এবং সেগুলো শরীরে যে অসুস্থতা সৃষ্টি করতে পারে তা প্রতিরোধ করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে ক্যানসার, প্রদাহ এমনকি হৃদরোগ। এছাড়াও এর মধ্যে বেশকিছু ভিটামিন রয়েছে যেগুলো শরীরকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে এবং এর মন মুগ্ধকর স্বাদ ফলটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। এবার জেনে নেওয়া যাক এই ঔষধি ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ফল রাম্বুটানের যেসব স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে-
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে রাম্বুটান। একটি চীনা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, রাম্বুটনের খোসাগুলো অ্যান্টি ডায়াবেটিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। ডায়াবেটিক ইঁদুরের ওপর করা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, এই খোসা দিয়ে তৈরি খাদ্য উপাদান গ্রহণ করার ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা হ্রাস পেয়েছিল। রাম্বুটান ফলের বীজ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
কিডনির বর্জ্য দূর করে
রাম্বুটানে থাকা ফসফরাস কিডনি ও শরীর থেকে বর্জ্য দূর করতে ভূমিকা রাখে। এতে করে কিডনি ভালো থাকে। কিডনির ভেতর জমে থাকা ময়লা দূর করতে খেতে পারেন রাম্বুটান।
ক্যানসার প্রতিরোধ করে
রাম্বুটান হল উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সম্পন্ন একটি ফল। এটি ক্যানসার প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। এর মধ্যে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো প্রদাহের সাথে লড়াই করতে এবং দেহের কোষ গুলোকে আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। এই ফলের মধ্যে থাকা ভিটামিন সিও এ ক্ষেত্রে সহায়তা করে। এছাড়াও একটি ক্ষতিকারক ফ্রি রেডিক্যাল গুলিকে হ্রাস করতে এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে।
রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে
রাম্বুটান রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে থাকে । কারণ রাম্বুটানে রয়েছে ভিটামিন এ । যা রাতকানা, কর্নিয়ার অসুখ, চোখের ফুলা, চোখ উঠা ইত্যাদি প্রতিরোধে সাহায্য করে ।
হাঁড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়তা করে
রাম্বুটানের মধ্যে থাকা ফসফরাস শরীরে হাড়ের স্বাস্থ্যকে উন্নত করতে সহায়তা করে। এতে থাকে প্রচুর পরিমাণে ফসফরাস। এটি হাঁড় গঠনে এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণে সহায়তা করতে পারে।
হজমে সহায়তা করে
রাম্বুটানের মধ্যে থাকা ফাইবার হজম স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে সহায়তা করে। এটি হজমেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের মতন হজমের সমস্যা রোধ করতেও সহায়তা করে।
শুক্রাণুর ঘনত্ব বৃদ্ধি করে
রাম্বুটানের পাতাগুলো অ্যাপ্রোডিশিয়াক হিসেবে কাজ করে। এই পাতাগুলো পনিতে সিদ্ধ করে সেবন করলে শরীরের হরমোনগুলোকে সক্রিয় করার পাশাপাশি এগুলো শুক্রাণুর ঘনত্ব বৃদ্ধি করে সহায়তা করে।
হার্টকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে
রাম্বুটানের মধ্যে থাকা উচ্চ ফাইবার করোনারি হার্ট ডিজিজ এর ঝুঁকিকে কম করতে সহায়তা করে। এছাড়াও এটি উচ্চ রক্তচাপ কমাতে এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা কম করতে সহায়তা করে। এক্ষেত্রে এটি উভয়ভাবেই হৃদযন্ত্র কে ক্ষতি হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে।(2)
অ্যানিমিয়া রোগে রক্ত বৃদ্ধি করে
আয়রণে সমৃদ্ধ রাম্বুটান ফল দেহে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ায়। রক্তসল্পতার কারণে রক্তসল্পতাজনিত রোগীদের জন্যও এটি সুপারিশ করা হয়। তাই যাদের রক্তস্বল্পতা রয়েছে তারা রক্তস্বল্পতার সমস্যার সমাধান করতে খেতে পারেনি এই ফল ।
শরীরে শক্তি বৃদ্ধি করে
রাম্বুটানের মধ্যে কার্বোহাইড্রেট এবং প্রোটিন উভয়ই রয়েছে। এই দুটি খাদ্য উপাদানই শরীরে শক্তি বৃদ্ধির জন্য কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। এছাড়াও এটি প্রাকৃতিক শর্করার দিকটিও শরীরে বজায় রাখে।
ওজন কমায়
রাম্বুটান শরীরের ওজন বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। যদিও এর সুনির্দিষ্ট কোনো গবেষণা নেই। তবে এই ফল গ্রহণের ফলে শরীরের ওজন বৃদ্ধি কম হয়। কেননা এতে শক্তির ঘনত্ব কম। এছাড়া এই ফলের মধ্যে বেশকিছু পরিমাণে ফাইবার থাকে, যা আরও বেশি সময় ধরে পেটকে ভর্তি রাখতে সহায়তা করে। যা ওজন কম করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।
রোগ প্রতিরোধ করে রাম্বুটান
রাম্বুটান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, রাম্বুটানের মধ্যে থাকা ভিটামিন সি শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে। এছাড়াও এর মধ্যে থাকা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্যগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। যা শরীরকে অসংখ্য সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে এবং ক্ষত নিরাময়ে সহায়তা করে।
মাথার ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়তা করে
রাম্বুটানের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্যগুলো চুলকানির সমস্যা দূর রাখতে এবং মাথার ত্বকের সমস্যার সমাধান করতে সহায়তা করে। এছাড়াও এই ফলের মধ্যে থাকা ভিটামিন সি মাথার ত্বকের পুষ্টি জোগায়। রাম্বুটানের মধ্যে থাকা তামা চুল পড়া কম করতে এবং চুলের রং কে ঘনকালো করতে, অকালপক্কতা প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। রাম্বুটানের মধ্যে যে প্রোটিন রয়েছে তা চুলের গোড়া মজবুত করতে সহায়তা করে।
(ঢাকাটাইমস/৩ জুন/আরজেড)

মন্তব্য করুন