প্লাস্টিকের বোতলে লাখ লাখ ক্ষতিকর প্লাস্টিককণা, পানি পানে সাবধান

প্লাস্টিকের তৈরি জিনিস মানুষের জীবনকে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে রেখেছে। ঘরে-বাইরে এখন দেদার ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিকের বোতল। শিশু সন্তানের স্কুলে পানি নেওয়া থেকে শুরু করে অফিস, আদালতে কিংবা ঘুরতে যাওয়ার সময়ে পানি পান করার জন্য ব্যাগে ভরে নেওয়া হয় প্লাস্টিকের বোতলে পানি। অনেকে আবার কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতল ধুয়ে তাতে পানি ভরে মাসের পর মাস দিব্যি পান করছেন। কখনও ভেবে দেখেছেন, তা আদৌ স্বাস্থ্যসম্মত কি না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একই প্লাস্টিকের বোতলে দিনের পর দিন পানি পান ডেকে আনতে পারে বড় বিপদ। ক্ষতিকর প্লাস্টিক বোতলজাত পানীয় থেকে সাবধান। যার ফলে বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে শরীরের। দেখা দিতে পারে দুরারোগ্য ব্যাধিও।
সম্প্রতি আমেরিকান ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, প্লাস্টিকের বোতলে লাখ লাখ প্লাস্টিক-কণা পানির সঙ্গে মিশে থাকে। এই প্লাস্টিক পানি পান করার সময় শরীরে ঢোকে এবং শরীরে টক্সিনের মাত্রা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। বেশি মাত্রায় এই প্লাস্টিকের কণা শরীরে ঢুকলে তা শরীরে ইনসুলিনের তারতম্য ঘটায়। টাইপ টু ডায়াবিটিসের ঝুঁকি বাড়ে।
ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা প্লাস্টিকের বোতলের ক্ষতিকারক দিক নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই গবেষণা করছেন। গবেষকেরা জানাচ্ছেন, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্লাস্টিকের কণাকে বলা হয় 'ন্যানোপ্লাস্টিক'। গবেষণা বলছে, ১ লিটার প্লাস্টিকের বোতলের পানিতে (৩৩ আউন্স) কম করেও ২ লাখ ৪০ হাজার প্লাস্টিক-কণা মিশে থাকে। খালি চোখে এদের দেখা যায় না। এগুলি পানির সঙ্গে শরীরে ঢুকে রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। এদের দৈর্ঘ্য ১ থেকে ৫০০০ মাইক্রোমিটারের মতো। অর্থাৎ, মানুষের মাথার চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম। প্লাস্টিকের বোতলের পানিতে এই সূক্ষ্ম প্লাস্টিক-কণাগুলিই মিশে থাকে।
বাজারে যে পানির বোতলে পানীয় পানি বিক্রি করা হয়, তার অধিকাংশই এক বার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকে তৈরি। এই ধরনের বোতলে দিনের-পর-দিন পানি পান করলে ক্যানসারের আশঙ্কাও বাড়ে। প্লাস্টিকের বোতল তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ‘বিসফেনল এ’ বা ‘বিপিএ’-সহ একাধিক উপাদান, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
গবেষকেরা জানাচ্ছেন, ন্যানোপ্লাস্টিক ও ‘বিসফেনল এ’ যদি বেশি মাত্রায় মানুষের শরীরে ঢোকে, তা হলে তা বিভিন্ন জটিল রোগের কারণ হয়ে উঠতে পারে। কী কী রোগ হতে পারে, সেই নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে গিয়েই গবেষকেরা দেখেছেন, বোতল তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এমন কয়েক ধরনের প্লাস্টিক শরীরে ইনসুলিনের ক্ষরণে প্রভাব ফেলে। যা পরবর্তী সময়ে ডায়াবিটিসের কারণ হয়ে উঠতে পারে। ৪০ জন প্রাপ্তবয়স্কের উপর পরীক্ষা করে এমন প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে বলে দাবি গবেষকদের। শুধু তা-ই নয়, প্লাস্টিকের ‘বিপিএ’ হরমোন ও ক্রোমোজোম ঘটিত সমস্যাও ডেকে আনতে পারে। অধিক মাত্রায় প্লাস্টিক-কণা শরীরে জমলে পুরুষদের ক্ষেত্রে শুক্রাণুর পরিমাণ কমিয়ে দেয়। মহিলাদের হরমোন ক্ষরণে বাধা তৈরি করে। বিশেষ করে, ইস্ট্রোজেন হরমোনের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে।
প্লাস্ট্কি শুধু রাসায়নিকেই ভরা নয়, তারা ফ্লোরাইড, আর্সেনিক ও অ্যালুমিনিয়াম নির্গত করে, যা মানবশরীরের জন্য বিষাক্ত। প্লাস্টিকের বোতলে পানি পান করার অর্থ ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যের অবনতি করা।
প্লাস্টিক বোতলে ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদানকে বিজ্ঞানীরা মানবদেহের জন্য হরমোন বিপর্যয়কারী উপাদান বলেছেন। প্লাস্টিক বোতলে ব্যবহৃত উপাদান পানিতে খুব দ্রুত রাসায়নিক বিক্রিয়া সংগঠিত করে। এ বিক্রিয়া মিশে যায় বোতলজাত পানি, খাদ্য দ্রব্য ও ওষুধের মধ্যে। ফলে প্লাস্টিক বোতল দূষণ থেকে মুক্ত থাকে না।
প্লাস্টিক বোতল তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ‘বিসফেনল এ’ বা ‘বিপিএ’-সহ একাধিক উপাদান, যা দেহের জন্য ক্ষতিকর। এই ধরনের বোতলে দিনের পর দিন পাসি পান করতে থাকলে বোতল থেকে ক্রমাগত এই উপাদানগুলো শরীরে প্রবেশ করতে থাকে। এই উপাদানগুলো রক্তে মিশলে কিডনির সমস্যা তৈরি হতে পারে। প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। প্লাস্টিকে রয়েছে বাইফেনিল জাতীয় রাসায়নিক, যা ডায়াবেটিস ও উর্বরতায় সমস্যা সৃষ্টিকারী। প্লাস্টিকের বোতলে যদি গরম পানি ভরা হয়, তবে আরও বৃদ্ধি পায় এই সব রোগের ঝুঁকি।
মূলত দুই ধরনের প্লাস্টিক দিয়ে মিনারেল বা ড্রিংকিং ওয়াটারের বোতল তৈরি হয়। এর একটি পলিকার্বন, যা বিসফেনল এ (বিপিএ) থেকে উত্পাদিত এবং অন্যটি পলিইথিলিন টেরেফথালেট বা পিইটি, যা পলিইথিলিন থেকে উত্পাদিত। পলিইথিলিনকে নিরাপদ বিবেচনা করা হলেও বিপিএ ক্ষতিকর কারণ বিপিএ প্লাস্টিকের আধারে জমে থাকা উপাদান দ্রবীভূত করার ক্ষমতা রাখে। পানিতে এসব উপাদান মিশে যায় সহজেই। বিপিএর সঙ্গে এক প্রকার হরমোনের গাঠনিক মিল রয়েছে। এটি ওয়েসট্রোজেন মিকি হরমোন নামে পরিচিত। বিপিএ নানা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কারণ। যেমন— অনুর্বরতা, মোটা হয়ে যাওয়া, ডায়াবেটিস, গলার ক্যান্সার, এমনকি এ উপাদান কেন্দ্রীয় সংবেদনশীলতাকেও অবশ করে দিতে পারে। স্তন ও জরায়ু ক্যান্সারের কারণও হয়ে উঠতে পারে এ বিপিএ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) বলছে, প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহারের ফলে দেহে প্রবেশ করতে পারে ক্ষতিকর ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’। প্লাস্টিকের আণুবিক্ষণিক কণাকে বিজ্ঞানের ভাষায় ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ বলা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় ৯৩ শতাংশ প্লাস্টিক বোতলেই রয়েছে এই ক্ষতিকর উপাদান।
শুধু যিনি পানি পান করছেন তিনিই নন, এর ফলে ক্ষতি হতে পারে পরের প্রজন্মেরও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘টাইপ ৭’ নামক এক ধরনের প্লাস্টিক থেকে দেখা দিতে পারে প্রজননের সমস্যা। তা ছাড়া বিপিএ হরমোন ও ক্রোমোজোমের সমস্যাও ডেকে আনতে পারে। ক্রোমজোমের সমস্যা তৈরি হলে সন্তানের দেহে তার প্রভাব পড়তে পারে বলে মত কারও কারও।
বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয় পানির বোতল তৈরিতে। প্লাস্টিক তৈরির মূল উপাদান হচ্ছে খনিজ তেল। গবেষকরা অবশ্য বলেছেন, পানিতে বিদ্যমান কিছু মাইক্রো-অর্গানিজম মানব স্বাস্থ্যের জন্য খুব একটা বিপজ্জনক নয়। কিন্তু প্লাস্টিকের বোতলে ঢুকানোর পর তা সত্যি বিপজ্জনক হয়ে যেতে পারে।
গবেষকদের মতে, প্লাস্টিক বোতল-পানিতে যে মাত্রায় ক্লোরিন মেশানো হয়, তাতে পানির অপকারী ব্যাকটেরিয়ার পাশাপাশি উপকারী ব্যাকটেরিয়াও মারা যায়। আর এটার চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে, মানবদেহের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমশ দুর্বল বা অকার্যকর হয়ে যাওয়া। গবেষকরা এটাও বলেছেন, গ্লাস তৈরির জন্য কাচ তৈরিকালে যে পরিমাণ ক্ষতিকর পদার্থ নির্গত হয়, সমপরিমাণ প্লাস্টিক তৈরিতে তার চেয়ে একশ গুণ বেশি ক্ষতিকর পদার্থ নির্গত হয়। অস্ট্রেলিয়ার ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষবিদ্যার শিক্ষক ক্রিস উইনডার সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখিয়েছেন প্লাস্টিকের বিক্রিয়া ও মানবশরীরে এর ক্ষতিকর প্রভাব। তিনি জানিয়েছেন, প্লাস্টিক বোতলের পুনর্ব্যবহার ব্যাকটেরিয়াদূষণের জন্য দায়ী।
উন্নত বিশ্বে কিছু কিছু প্লাস্টিকের বোতল ফুড গ্রেড দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে। সাধারণত আন্তর্জাতিক মানের প্লাস্টিকের গায়ে ২, ৪ এবং ৫ নম্বর লেখা থাকলে সেগুলো তুলনামূলক নিরাপদ। নম্বর ১ লেখা বোতলও নিরাপদ হিসাবেই গণ্য হয়। ৬ এবং ৭ ভীষণভাবে ক্ষতিকর। তাই ৬ এবং ৭ লেখা নম্বরের বোতল অবশ্যই এড়িয়ে চলুন।
প্লাস্টিক বোতলের পানিতে তাপ লাগলে খুব দ্রুত রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। প্লাস্টিক বোতলে পানি মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ পানি প্রয়োজন। কারণ আমাদের শরীরের ওজনের প্রায় ৭০ শতাংশই পানি। মানবদেহ পানি ব্যবহার করে এর কোষ, প্রত্যঙ্গ ও টিস্যুগুলোর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও শরীরের কার্যক্রম ঠিকঠাক চালাতে। আর পানি পান করার সময় ক্ষতিকর প্লাস্টিককে দূরে রাখা জরুরি। প্লাস্টিকের বোতলের পরিবর্তে দূষণমুক্ত কাচের বোতল, স্টিলের পাত্র, তামার পাত্র কিংবা মাটির পাত্রে পানি রেখে খাওয়া নিরাপদ।
(ঢাকাটাইমস/৪ জুলাই/আরজেড)

মন্তব্য করুন